শুভ্রঃ হুমায়ূন আহমেদের আখরকথাঃ দ্বিতীয় পর্ব



অঘটন আজও ঘটেকথাটা বহুবার শুনেছিএবার নিজের ক্ষেত্রে দেখলাম। তার মানে কি আমার সাথে কোন অঘটন ঘটেনি? ঘটেছে। তবে মনে রাখার মতন নয়। এবারেরটা ভুলব না চট করে।

জেমস বন্ড ফোন করেছিল দিন কয়েক আগের এক শীতল সন্ধ্যায়। “হ্যালো প্রধন্যা, আমি কল্যাণীতে এসেছি। এখানে একটা বইমেলা হচ্ছে। কোনো বই দেখব না কি রে তোর জন্যে?”

শুনেই মেজাজ খিঁচড়ে গেল। আমাদের এদিকে শীতকালীন বইমেলার নামে ঢু ঢু। আর উনি ওদিকে শ্বশুরবাড়ীতে বেড়াতে গিয়েও আমাকে বইমেলার খোঁটা! নিশ্চই শালীসমভিব্যাহারে গেছে ব্যাটা। দাঁড়া! তোর প্রেস্টিজের টিউব ফুটো করছি। বললাম, “হুমায়ূন আহমেদের ‘মেঘের ছায়া’ উপন্যাসটা পেলে দেখো তো।”

      সারা সন্ধ্যে আর কোন আওয়াজ নেই। আমি ঘাটে বন্ধুনীদের সাথে গল্প করতে করতে মনে মনে হাসছি। দ্যাখ কেমন লাগে। সন্ধ্যার একটু পরেই মেসেজ, “বইটা পেয়ে গেছি। পরশুদিন ফিরে গিয়ে তোকে দিয়ে দেব। দাম নিয়েছে একশো টাকা।”

      বিশ্বাস করুন, লাইফে এমন তাজ্জব কখনও হই নি। কল্যাণী কোথায়? কত বড় শহর? কত বড়ো বইমেলা হয় সেখানে যে বাংলাদেশের বইও পাওয়া যায়! কলেজ স্ট্রীট যেখানে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়, সেখানে একটা গ্রাম্য বইমেলা এমন চমকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে!

      হাতে এল যথাসময়ে। ২০১২ সালের মুদ্রণ। পাওয়াটাই সৌভাগ্যের। আমি সৌভাগ্যবতী। জেমস বন্ডকে ডাবল টাকা দেওয়া উচিৎ ছিল। মাত্র একশো টাকায় প্রায় না পাওয়া উপন্যাসটি শুভ্র সিরিজের এমন একটি বই যেখানে শুভ্র আসলেই শুভ্রতে পরিণত হয়েছে।

      এই উপন্যাসে একক শুভ্রের পথ চলা শুরু। হয়তো এখান থেকেই শুদ্ধতম মানুষের নির্মাণের সূচনা। এখানে শুভ্র অন্ধকারে হাসে। এখানে রাজপুত্রের মতো দেখতে শুভ্রকে। এমনকি তার মা’রও মনে হচ্ছে, “আমার এই ছেলেটা এত সুন্দর হল কেন? ছেলেদের এত সুন্দর হতে নেই। শারীরিক সৌন্দর্য ছেলেদের মানায় না।” কিম্বা “শুভ্র’র হাসি সুন্দর। দেখতে ভালো লাগে। সব শিশুর হাসি সুন্দর। বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে হাসির সৌন্দর্য নষ্ট হতে থাকে। শুভ্র’র হয় নি।” তাই-ই তো! শুদ্ধতম যে, তার হাসি অমলিন হতেই হবে।

আমি মূল গল্পটাতে বিস্তারিত যেতে চাই না। হুমায়ূনপ্রেমীমাত্রই এই লেখাটা পড়েছেনশুভ্ররা মারকাটারি টাইপের বড়লোক। থাকে তার পরিবারের কড়া নজরে। কোন পরীক্ষেতেই ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয় না। বাইরে বেরোয় না যদিও এ উপন্যাসে এক পর্যায়ে দেখা যায়, সে উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে। হিমু কি শুভ্রকে ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল? দু-একজন ছাড়া তার কোন বন্ধু নেই। এক বন্ধু জাহেদ হুট করে বিয়ে করে ফেলেছে কেয়াকে, যার মাথা গোঁজার জায়গা পর্যন্ত নেইসে এক নাজেহাল অবস্থা। তার আরেক বন্ধু সাবের মারা গেছে বহু আগে, তবুও তাদের পরিবারের সাথে তার যোগাযোগ নিবিড়। সংযোগটা মূলত তার প্যারালাইজড বাবার সাথে হলেও শুভ্র ফল্গু আকর্ষণ বোধ করে তার দিদি মিতুর ওপর। জাহেদ-কেয়া-শুভ্র-মিতু --- সব মিলিয়ে এমনভাবে গল্প এগিয়েছে, যা এক সময় মনটাকে ভারাক্রান্ত করে তোলেএতদসত্ত্বেও মূল উপন্যাস এমন কিছু আহামরি লাগে না।

শুভ্র চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পারে না। প্রায় অন্ধ। অথচ তার বাবার বিশাল ব্যবসার উত্তরাধিকারী সে, এবং সময় হয়ে আসছে দ্রুত সেই দায়িত্ব নেওয়ার। এত কিছুর মধ্যেও তার মনের মধ্যে খুব বেশি জটিলতা নেই। আচ্ছা, যে লজিকাল, সে কি একই সাথে বালকবৎ হতে পারে? লজিকে তার বাবা হেরে যাচ্ছেন, কিন্তু শিশুর হৃদয় একইরকমভাবে চায় নিঃসহায় বন্ধুকে একটা বাগানবাড়ী উপহার দিতে

হুমায়ূনের সাঙ্ঘাতিক ক্ষমতা পাঞ্চলাইনে। মাহিন সাহেব, যিনি প্যারালাইজড, তিনি আর বোঝা হয়ে থাকতে চান না তার পরিবারের ওপর। তিনি বলছেন, “সমস্ত জীবজগতের একটা সহজ নিয়ম আছে। অসুস্থ, দুর্বল, অক্ষম কাউকে জীবজগৎ সহ্য করে না। সাধারণত তাকে মেরে ফেলে কিংবা এমন ব্যবস্থা করে যেন মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়।” ভয়ানক বাক্যবিন্যাস! অস্বীকার করা যায় না। এই মহিন সাহেবের স্ত্রী তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একটা সময় তাকে না বলেই চলে যায় তার বাপের বাড়ী। কন্যা মিতুর কাছে যখন এ নিয়ে খেদ করছেন তিনি, মিতুর সাপটা উত্তর, “মৃগনাভির গন্ধও একসময় শেষ হয়ে যায়। পড়ে থাকে এক খণ্ড পচা মাংসপিণ্ড।”

“ঠিক সন্ধ্যায় চশমা ছাড়া পৃথিবীকে দেখতে তার ভাল লাগে। সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগে। চারদিক অন্ধকার। এই অন্ধকারে বাতি জ্বলে উঠছে। চশমা ছাড়া এই বাতিগুলোকে অনেক উজ্জ্বল এবং ছড়ানো মনে হয়।” হুমায়ূনের মধ্যে একটা ক্ষমতা মারাত্মক। তা হল তার নিখুঁত দেখার ক্ষমতা। মানছি তারও চশমা আছে। কিন্তু এভাবে কয়জন দেখে? আবার আরেকটা জায়গায় আছে, “অন্ধকারে সিঁড়ি ভাঙা খুবই ক্লান্তিকর ব্যাপার। সবসময় মনে হয় এই বুঝি সিঁড়ি শেষ হল, কিন্তু শেষ হয় না। এক সময় মনে হয় সিঁড়ির ধাপগুলির উচ্চতার হেরফের ঘটছে। এক ধরনের টেনশান, সিঁড়িতে ঠিকমতো পা পড়ছে তো?” আমায় অভিভূত করে দেয়

আমার মনে হয়, এই উপন্যাস, শুভ্রের প্রস্তুতিপর্বের উপন্যাস। এখানে উপন্যাসটা এমন সাদামাটা যে আলাদা করে মনে ধরে না। হয়তো লেখক এই কারণেই, খুব সঙ্গত কারণেই শুভ্র সমগ্রে উপন্যাসটা রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন নি। হয়তো ২০১২ সালের পরে রিপ্রিন্ট হয় না। পাঠকের ক্ষেত্রেও আস্তে আস্তে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাচ্ছে।

 

===========================

মেঘের ছায়া

হুমায়ূন আহমেদ

প্রতীক প্রকাশনী

মুদ্রিত মূল্যঃ ১২০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে