শুভ্রঃ হুমায়ূন আহমেদের আখরকথাঃ প্রথম পর্ব


‘শুভ্র’ চরিত্রের আগমন ঘটে ‘দারুচিনি দ্বীপ’ উপন্যাসে। উপন্যাসটা ভালো করে পড়লে দেখা যায় শুভ্র এখানে অতি সাদামাটা একজন চরিত্র। যে চরিত্র অন্যান্য অনেক চরিত্রের সাথে মিলেমিশে সহাবস্থান করছে। হুমায়ূন আহমেদের মতে ‘সাদা গাড়ি’ নামক ছোটগল্পের মধ্যে দিয়ে শুভ্রের পথ চলা শুরু হয়েছে। সম্ভবত তথ্যটি ভুল। লেখক নিজেই হয়তো সাব্বির আর শুভ্রের মধ্যে একটা মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন। হতে পারে, এই চরিত্রটা সৃষ্টি করার সময়ে শুভ্রের আইডিয়াটা মাথায় আসে।

      ‘সাদা গাড়ী’ কোন সময়ে লেখা হয় আমি জানি না। তবে দারুচিনি দ্বীপ লেখা হয় ১৯৯১ সালে। মূলত এখান থেকেই শুভ্রের পথ চলার শুরু। এই চরিত্রটিকে তৈরী করতে গিয়ে হয়তো হুমায়ুন আহমেদের মাথায় আসে, শুদ্ধতম মানুষ কেমন হবে? ... শুদ্ধ মানুষ আমাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে কল্পনায়। শুভ্র সে রকম একজন। এবং হয়তো অজান্তেই, শুভ্রের মধ্যে সেইসব বৈশিষ্ট্য ঢুকিয়ে দিতে থাকেন, যা একজন শুদ্ধতম মানুষের থাকা উচিৎ বলে তার মনে হয়েছে।

      আমি এখানে দুটি উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করব। ‘দারুচিনি দ্বীপ’ এবং ‘রূপালী দ্বীপ’। যারা উপন্যাস দুটি সম্পর্কে জানেন না, তাদের বলি, একুশ-বাইশ বছরের কয়েকজন কলেজে পড়া ছেলেমেয়ে ঠিক করল তারা সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে যাবে, এবং এক ভরা পূর্ণিমার রাত্রে সমুদ্রস্নান করবে। যাত্রা শুরু এবং শেষের মাঝে ঘটতে থাকে অদ্ভুত সব ঘটনা, এবং একে একে চরিত্ররা স্পষ্ট রূপ পায় আলো-আঁধারীর মধ্যে দিয়ে। উল্লেখ্য, শুভ্র কিন্তু এখানে নায়ক নয়। সে এখানে অন্যান্য চরিত্রের সাথেই সহাবস্থান করছে।

      এবার আসা যাক শুভ্রের কথায়। কেমনভাবে আস্তে আস্তে রূপ পাচ্ছে এক শুদ্ধতম মানুষের বৈশিষ্ট্য? লিস্ট করা যাক একটা ---

১। “দেবশিশু, মর্তের ধুলোকাদার পৃথিবীতে যেন ভুলক্রমে চলে এসেছে।” প্রথমেই তার ওপর এক দেবত্ব আরোপের প্রচেষ্টা। মনের অবচেতনেই পাঠক ভাবতে শুরু করবেন শুভ্র যেন রক্তমাংসের মানুষ হয়েও মানুষ নয়।

২। “শুভ্রর সবচে’ সুন্দর জিনিস তার চোখ” --- আর এই চোখকেই তিনি ঢেকে দিয়েছেন মোটা চশমায়, এবং, শুধু তাই নয়, তিনি ‘রূপালী দ্বীপ’-এ লিখছেন, দ্রুত শুভ্রের চোখের নার্ভ শুকিয়ে আসছে।

৩। শুভ্রের একটি উক্তি --- “বেশির ভাগ সময় আমরা মনের কথা বলতে পারি না বলে কষ্ট পাই। আমি ঠিক করেছি আমি এই ভুল করব না। যা বলতে ইচ্ছে করে --- তা বলব।” অর্থাৎ, সে মরান্তেও মনের কোন ভাব গোপন করবে না। অথচ আমরা দেখতে পাই, এই ভাব গোপন না করতে পারার ফলে ভয়-লজ্জা-সাহস সব ধরনের অনুভূতির মধ্যে দিয়েই সে যাচ্ছে, কিন্তু একবারের জন্যেও সিদ্ধান্ত থেকে চ্যুত হচ্ছে না।

৪। “অন্যায় অনুরোধ আর যে-ই করুক, সে করতে পারে না।“ অর্থাৎ, সে কখনও তার স্বাভাবিকী নীতির বিপক্ষে যাবে না।

৫। ক্রমাগত জ্ঞান আহরণ করে যাওয়া। শুভ্রকে ‘রূপালী দ্বীপ’ উপন্যাসের একটা পর্যায়ে দেখা যায়, সে যখন জেলখানায়, তখনও মন দিয়ে ‘ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ নামক একটি কঠিন বই পড়ে যাচ্ছে। সে যে নিজের ভয়কে গোপন করার জন্যে পড়ছে না, তার প্রমাণও পাওয়া যায় তার পরেই বইটার সারমর্ম যখন তার বন্ধুদের গুছিয়ে বলছে।

৬। প্রয়োজনে কঠিন এবং রুক্ষ হওয়া। অর্থাৎ কি না ভয়ঙ্কর। ‘রূপালী দ্বীপ’ উপন্যাসের এক পর্যায়ে সে মনিরুজ্জামান নামক এক ব্যক্তিকে হত্যার ভয় দেখাচ্ছে এবং কথোপকথনেই বোঝা যাচ্ছে যে সে ফাঁকা হুমকি দিচ্ছে না।

৭। ভয়হীনতা --- উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে তীব্র ঢেউয়ের মাঝে যখন তাদের নৌকা উলোট পালোট খাওয়ার উপক্রম, সে অবস্থাতেও সে শান্ত হয়ে ভীষণাকার সমুদ্রের রূপ দেখছে। (“শুভ্র নৌকা ধরল না”) আমার মনে হয়, এই একটা বৈশিষ্ট্যকে ধরেই লেখক আরোও এগোবেন। কারণ, যেকোন মানুষ আসলেই মানুষ যখন সে ভয়ডরহীন।

      ‘দারুচিনি দ্বীপ’ উপন্যাসে শুভ্র’র মধ্যে কোন কিছুই তেমন করে দেখা যায় নি, যেখানে মনে হবে শুভ্রকে নিয়ে লেখকের কোন পরিকল্পনা আছে। বরং ওই উপন্যাসের পরবর্তী পর্ব ‘রূপালী দ্বীপ’ পড়লে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এই উপন্যাসটাতে, বিশেষত, শুভ্রের ওপর লেখকের নজর বেশি। এখানে শুভ্রকে তৈরী করা হচ্ছে। লেখকও তৈরি হচ্ছেন। আমার মনে হয়, এর ইতিহাসের দিকেও নজর দেওয়া দরকার।

      এই দুটি উপন্যাসের মাঝে সময়ের পার্থক্য তিন বছরের। ‘রূপালী দ্বীপ’ লেখা হয় ১৯৯৪ সালে। কিন্তু এরই মাঝে, ১৯৯৩ সালে শুভ্রকে নিয়েই লেখা হয়েছে একক উপন্যাস, মেঘের ছায়া। আমি যখন পড়ব, আশা করব, সেখানে শুভ্র স্বমহিমায় বিদ্যমান হয়েছে। ‘দারুচিনি দ্বীপ’-এ যে শুভ্র অন্যান্য সকলের সাথে সহাবস্থান করছেন, রূপালী দ্বীপে সেই শুভ্রের জন্যে লেখক আলাদা করে মমত্ববোধ রেখে দিচ্ছেন, তার একটা বড়ো কারণ --- মেঘের ছায়া।

     

      লেখক হুমায়ূন আহমেদ আমার কাছে বড়ো বিস্ময়। তার লেখার ধরন একদম বয়ে যাওয়া নদীর মতো। কিন্তু তারই মাঝে মাঝে এমন সব বাক্য হঠাৎ করে চলে আসে যে মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়। “সব মানুষই দিনের কিছু সময় নিজের সঙ্গে কথা বলে। পাশের অতি প্রিয়জনও কি বলছে তা কানে যায় না।” অথবা, “মানুষ হয়ে জন্মগ্রহন করেছ, বিপদে তো পড়বেই। বিপদে পড়বে, আবার বিপদ থেকে বের হয়ে আসবে। আবার পড়বে। দিস ইজ দ্য গেম।” কিম্বা “কোটের বাটন হোলে পাতাসহ গোলাপের কুঁড়ি। গোলাপটা ঠিক আছে --- পাতা দুটি মরে গেছে।” একটি নেগেটিভ চরিত্রকে বোঝাতে কি মারাত্মক উপমা!

আবার এইসব বাক্য যে দার্শনিক হতে তার কোন মানে নেই। আবার হলেও এমন সহজ ভাবে আসবে যে তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এই যেমন ধরুন শুভ্র চশমা ছাড়া কেমন দেখে? “এক ধরনের প্যাটার্ন দেখি মা। লাইট এন্ড ডার্কনেস। কোথাও বেশি আলো, কোথাও কম, কোথাও অন্ধকার --- এই রকম। খুব ইন্টারেস্টিং।”

আমি বই বন্ধ করে দিই। নিজের চোখের চশমার ওজন নেহাত কম নয়। আমি নিজের চশমা খুলে রাখি। আর রঙিন প্যাটার্ন... দেখি, দেখি দেখতেই থাকি...

      সত্যিই ইন্টারেস্টিং!

==================================================

দারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপ

লেখকঃ হুমায়ুন আহমেদ

মূল গ্রন্থঃ শুভ্র সমগ্র

অনন্যা প্রকাশন

মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০০ টাকা

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে