শুভ্রঃ যাত্রা শুরু



কিছু কিছু উপহার চলার পথের সাথী হয়ে আসে। অঞ্জন দা’র উপহার ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় এসেছে ভাইফোঁটার স্নেহচ্ছায়ায়। এমন এক লেখকের বই যে লেখক আমার অনেক নির্জন রাতের সাথী; যার সঙ্গ কামনা করে কোনবার বিফল মনোরথ হই নি; আমার অনেক হাসিকান্নার নীরব সাক্ষী যে লেখক, তার এক অজ্ঞাত চরিত্রকে নিয়ে একটা সমগ্র! জাস্ট ভাবা যায় না।

হিমু, মিশির আলী শুনেছি, পড়েছি। কল্পবিজ্ঞান সমগ্র আছে, গল্প সমগ্র আছে। পড়েছি তার কিছু কিছুও। কিন্তু শুভ্র সমগ্র! কে এই শুভ্র? “শুভ্র যে খুব একটা জনপ্রিয় চরিত্র তা কিন্তু না। হিমুকে বা মিসির আলীকে সবাই যেভাবে চেনে শুভ্রকে সেভাবে চেনে না।সাদামাটা শুভ্রের আকর্ষণী ক্ষমতা মনে হয় কম। বেচারা তার জন্য দায়ী না, দায়ী আমি। আমিই তাকে দূরের মানুষ করে রেখেছি।” অথচ এই শুভ্রকে দিয়ে যাচ্ছেন কাকে? উৎসর্গপত্রে লেখা --- “জগতের কনিষ্টতম শুভ্র আমার ছোট্ট বাবু ‘নিষাদ’কে।” অর্থাৎ, তার জীবনের একটা অংশ, তার পুত্রের কাছে রইল।

এতএব, শুভ্র নিষ্পাপ। ছোট্ট নিষাদের মতোই নিষ্পাপ। শুভ্র সম্পর্কে আরেকটু খোঁজ খবর নিলাম। ‘শুভ্র’ নামক উপন্যাসের উৎসর্গপত্রে লেখা --- “শুদ্ধতম মানুষ কেমন হবে? ... শুদ্ধ মানুষ আমাকে সৃষ্টি করতে হয়েছে কল্পনায়। শুভ্র সে রকম একজন।” আমার মনে পড়ল ফিওদর দস্তয়েভস্কিকে।

ভ্রাতুষ্পুত্রী ইভানোভাকে লেখা একটি চিঠিতে আছে, "(ইডিয়ট) উপন্যাসের মূল আইডিয়া একজন আদর্শ নায়কের চরিত্রবর্ণন। পৃথিবীতে এর চেয়ে দুরূহ কাজ আর কিছু হতে পারে না --- বিশেষত আজকের দিনে। লেখকমাত্রেই --- শুধু আমাদের দেশে কেন, ইউরোপেও যারা প্রকৃত সুন্দরকে ফুটিয়ে তোলার সমস্যা সমাধানে ব্রতী হয়েছেন, তাঁরা সকলেই ব্যর্থ, কারণ এটা একটা বিশাল কাজ। সুন্দর হল একটা আদর্শ, আর আদর্শ বলতে যা বোঝায়, তার প্রতি না আমাদের দেশে, না ইউরোপে --- কোথাও তেমন একটা দৃষ্টি দেওয়া হয়নি।"

অর্থাৎ, এই সাধনার পথের পথিক হুমায়ূন আহমেদও। শুভ্রর সাথে মুখোমুখি হয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন তার প্রথম ছোটগল্প ‘সাদা গাড়ি’। পড়ে ফেললাম গল্প সমগ্র থেকে। হুমায়ূনের কথা সত্য বলে ধরে নিলে শুভ্র এখানে ‘সাব্বির’। লেখক নিজেও কি গুলিয়ে ফেলেছেন? কোথাও কি ভুল হয়েছে তার? জানি না। গল্পটা মনে তেমন রেখাপাত করল না। সাব্বির ওরফে শুভ্রও দাগ কাটতে, ওই যাকে বলে ইম্প্রেশন, চরম ব্যার্থ। দারুচিনি দ্বীপে আলাপ যখন হবে শুভ্রর সাথে তখন না হয় মিলিয়ে নেব।

অনন্যা পাবলিকেশান নাম দিয়েছে ‘শুভ্র সমগ্র’। অথচ শুভ্র সম্পর্কিত একটি উপন্যাস এখানে অনুপস্থিত --- মেঘের ছায়া। সংগ্রহ করলাম সেই উপন্যাসটিও। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে স্বয়ং লেখকের অনবধানতা একটা বড়ো ভুলযাই হোক, এখন আর কিছু করার না থাকলেও চতুর্থ মুদ্রণেও যখন সেই ভুল সংশোধন করা হয় নি, তখন বলতে হবে, পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গীতে এটা একটা মারাত্মক ভুলই বটে। কবে সংশোধন হবে? না হলে নামটা পালটে ‘শুভ্র অমনিবাস’ করাই বাঞ্ছনীয়। অন্তত শুদ্ধতম মানুষের ক্ষেত্রে সত্য কথনের সন্মাননা করা হোক।

একেবারে শেষ উপন্যাস ‘শুভ্র গেছে বনে’-র উৎসর্গপত্রে তিনি লিখছেন, “শুভ্রর মতো কাউকে কি আমি চিনি, যাকে এই বই উৎসর্গ করা যায়? না, চিনি না। প্রকৃতি শুদ্ধতম মানুষ তৈরী করে না। কিছু-না-কিছু খাদ ঢুকিয়ে দেয়।” অর্থাৎ, ২০১০ সালে এসে হুমায়ূনের উপলব্ধি, তিনিও এরকম একটা চরিত্র তৈরীতে ব্যর্থ।

শুভ্রর সাথে আমি যখন জীবন যাপন করব, তখন কি আমি তাকে বুঝতে পারব, যে সে সত্যিই শুদ্ধতম চরিত্র? জানি না। মনে হয় না। শুদ্ধতম মানুষকে চিনতে পারে শুদ্ধতম মানুষ, কিম্বা অশুদ্ধতম মানুষ। আমি দুটোর একটাও না। তবুও হুমায়ূনের অন্তরের শুদ্ধতমের বোধের মুখোমুখি হতে পারার সৌভাগ্যকে কে হেলায় হারাতে চায়? আমি চাই না।

শুভ্রকে যে সময়ের ব্যবধানে একটু একটু করে লেখক সৃষ্টি করেছেন, আমি সেই পথেই হাটতে চাই। অর্থাৎ, দারুচিনি দ্বীপ, রূপালী দ্বীপ, মেঘের ছায়া, শুভ্র, এই শুভ্র এই, শুভ্র গেছে বনে --- এইভাবে। যদিও মেঘের ছায়া প্রথম দুটি শুভ্র উপন্যাস রচনার মাঝে তৈরী, তবুও, রসভঙ্গ করতে চাই না। হুমায়ূনের শুদ্ধতম মানুষ সৃষ্টির যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে, ২০১০ সালে এসে রণে ভঙ্গ দিয়েছেন। আমাদের ছেড়ে লেখক স্বয়ং চলে গেছেন ২০১২ সালে।

বড় অবেলায় চলে গেলেন আপনি। এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিল? এখনও আমাদের মাঝে থাকলে শুভ্র কি আবার আসত আপনার হাত ধরে?

জানি এর কোন উত্তর হয় না। কেবল পড়ে থাকে শুভ্র সম্পর্কিত তার অমূল্য সৃষ্টিগুলি। যার মধ্যে দিয়ে আপনার এক অনাম্নী ভক্ত আপনাকে দেখতে চায়, আরেকবার আপনার হাত ধরতে চায়, বৃক্ষছায়ার তলে, শুভ্রের মধ্যে দিয়ে...

===========================

শুভ্র সমগ্র

অনন্যা প্রকাশনী

মুদ্রিত মূল্য – ৬০০ টাকা

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

  


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে