Annie Ernaux এবং বাঙালীর সংকট


Annie Ernaux এবারে সাহিত্যে নোবেল পেলেন, আমরা সবাই জানি। তার পর পরই আমার এক বান্ধবী সমর্পিতা আমাকে তার কিছু বই সংগ্রহ করে দিল। মোট সাতটি বই। কোন নোবেল প্রাপকের নোবেল পাওয়ার অব্যবহিত পরেই তার লেখা নিয়ে টানা দেড় মাসেরও বেশি সময় ধরে তার সাথে বাস করার অভিজ্ঞতা এই প্রথম, এবং এ নিয়ে সময়ে সময়ে আমার পাঠ-প্রতিক্রিয়া আপনাদের সাথে শেয়ারও করেছি। এবং, এর পাশাপাশি, কয়েকটা উপলব্ধি হয়েছে, যা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই, শেষবারের মতো।

      তাকে নিয়ে যে কবার লিখেছি, কোনবারই Annie Ernaux-র নামের বাংলা তর্জমা করে লেখার সাহস দেখাইনি। কারণ, এতদিনে বুঝে গেছি, অধিকাংশ বাঙালী পাঠকের, বই সম্পর্কিত কোন লেখায়, সেটা যদি ‘শরদিন্দু’ বা ‘সত্যজিৎ’ গোত্রের, কিম্বা ‘গোয়েন্দা’ বা ‘তন্ত্র’ জঁরের না হয়, তাহলে, বিদ্যা জাহির করার একমাত্র উপায় থাকে বানান ভুল ধরায়। এবং এই কাজে সে এমন এক আত্মপ্রসাদ লাভ করে যে ভুলগুলি সোচ্চারে তুলে ধরার পরে হয়তো আনন্দে ‘জ্যোমাটো’তে খাবার অর্ডার দেয়। আমার ক্ষেত্রে, এই নামের ভুল না থাকার কারণে প্রায় অধিকাংশ লেখায় দেখলাম তেমন কোন রেসপন্স নেই। অর্থাৎ, নামের বানান কিম্বা অন্যন্য বানানের ভুল না ধরতে পারার দুঃখ ভুলতে না পেরে অধিকাংশ পড়ুয়া মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নীরবে।

      এই বাঙালী পড়ুয়াদের মধ্যে যারা এটুকু পড়েই প্রতিবাদের ‘পোস্ট’ মিছিল করবেন ভাবছেন, তাদের জন্যে সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা লেখার অংশ তুলে ধরি, যেটি অনেক বাঙালীর সাধের ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সংখ্যায় ‘সাহিত্যে নোবেলজয়ী আনি এরনো শীর্ষক প্রবন্ধে। তিনি লিখছেন ---

আনি এরনোর নাম যে আমরা শুধু শুনিনি তাই নয়, গত পাঁচ বছরে যে-পাঁচজন নোবেল পেয়েছেন তাঁদের নামও হয়তো আমরা শুনে ভুলে গেছি।... আসলে আমার মনে হয় যাঁরা বাঙালি এবং সাহিত্য চর্চা করেন তাঁরা কেমন যেন আধুনিকতাকে ত্যাগ করেছেন, আর যাঁরা বাঙালি এবং আধুনিক ভাবনা ও জীবনযাপনকে আপন করে নিয়েছেন তাঁরা বাংলা সাহিত্যকে ত্যাগ করেছেন। দুটোর মধ্যে এখন আর মিলমিশ নেই। কারণ বাঙালির সাহিত্য চর্চা হল এখন একটা গিল্ট ট্রিপের মতো ব্যাপার ‘রক্তকরবী নোবেল পাওয়ার আগে লিখেছিলেন না পরে লিখেছিলেন জানো না?’, ‘সতীনাথ ভাদুরির জন্মদিন পালন করলে না?’, ‘রমেশচন্দ্র দত্তর প্রবন্ধ সংকলন কোথা থেকে বেরিয়েছে বলতে পারলে না?’ আর এই সময়ে বাঙালির সবচেয়ে বড় লুকোনোর থাম হলেন কমলকুমার মজুমদার। এক কমলকুমারকে দেখিয়ে কবে থেকে দেখছি অনেকেই বিশ্ব সাহিত্যের মুখের ওপর দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছেন।“

আমি ওনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত। Annie Ernaux নাম একটি সাহসের নাম, যা বাঙালী কোন লেখকপুঙ্গবের নেই, লেখিকাদের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। তার লেখা পড়তে পড়তে আমার একটা কথাই মনে হয়েছিল, কতটা মনের জোর থাকলে একটা Annie Ernaux হওয়া যায়! তার প্রত্যেকটা লেখা আত্মজৈবনিক। সে লেখায় নিজের যৌনতাকে সোচ্চারে বলার পাশাপাশি আশেপাশের মানুষদের প্রতি, সমাজের প্রতি, এমনকি দেশের প্রতি একটা তুমুল দরদ দেখা যায়। এই দরদ তাকে লিখতে বাধ্য করায়। স্রেফ মেয়েলি কূটকচাল নিয়ে রান্নাঘর গরম করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি লেখেন না। তিনি লেখেন সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা নিয়ে। একটা উদাহরণ --- HAPPENING --- উপন্যাসটা লেখার উদ্দেশ্য ফ্রান্সের আইনকে একহাত নেওয়া। এবং তার জন্যে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছেন তিনি। তিনি জানেন, নিজের গর্ভপাতের গল্প লিখলে তার জেল হতে পারে অতীত কুকর্মের জন্যে, কিন্তু এতদসত্ত্বেও, তিনি নিজেকেই সামনে এনেছেন, যাতে করে আরোও অনেক মেয়ে সাহস পায় এগিয়ে আসার, সাহস দেখায় এই প্রহসনের শেষ ঘটানোর জন্যে পর্যাপ্ত আওয়াজ তোলার।

এমন সাহস আমাদের এখানে দেখাতে কেউ পারবে কি? একটা নাম এ প্রসঙ্গে বারবার ঘুরে ফিরে আসে বটে --- তসলিমা নাসরিন। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, তিনি মূলত বাংলাদেশের লেখিকা। বর্তমানে তার নিজের কোন দেশ নেই। পশ্চিমবঙ্গে তিনি ত্যাজ্য। তার ‘মেয়েবেলা’ সিরিজ কেবলমাত্র তার যন্ত্রণাবিলাসের গল্প, সেখানে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা বড়ো হয়ে ওঠে নি, যতটা হয়েছে তার নিজের প্রতি। ‘নির্বাচিত কলাম’ কিম্বা ‘লজ্জা’ কিছুটা সাড়া ফেলেছিল বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। সমাজকে আয়নার মতো সমান্তরালভাবে দেখিয়ে চলার যে সাহস Annie Ernaux তার The Years–এ দেখিয়েছেন তা তসলিমার ক্ষেত্রে কোথায়? নিজের বাবা, কিম্বা মা-কে নিয়ে যে অনবদ্য অনুভূতির প্রকাশ একদম বাস্তবোচিত সত্যতার মোড়কে তিনি বলে গেছেন A Man’s Place, A Woman’s Story কিম্বা I remain in Darkness –এ, তা আর কেউ বলতে পেরেছেন কি?

Annie Ernaux একজন আপাদমস্তক ‘এক্সিস্টেনশিয়ালিস্ট’। তার লেখার মননে সার্ত্রে, বোয়াভেরা এবং সিলভিয়া প্লাথের ছাপ স্পষ্ট। প্রথম দুজন তাকে র‍্যাডিকাল ফেনিমিজমের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি সেই পথে হেঁটেছেন এবং সাহিত্যের মধ্যে দিয়েই মূলত তার প্রতিবাদের ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এমনটা বাংলা সাহিত্যে আশা করা বৃথা, অন্তত মহাশ্বেতা দেবী এক ধূসর অতীত হয়ে যাওয়ার পর।

এখন বাঙালী বিশ্বকাপ নিয়ে মেতেছে। এটা লজ্জার যে, আমরা ব্রাজিল-আর্জেন্তিনা নিয়ে পোস্টের পর পোস্ট করি, কিন্তু এটা আদতে একটা আত্মবিলাস ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা জানি, ভারত কোনদিন বিশ্বকাপ ফুটবল খেলবে না; আমরা জানি, সাহিত্যে অদূর ভবিষ্যতে বাঙালীর নোবেল পাওয়ার ক্ষমতা নেই; আমরা জানি, পেপার কিম্বা রিল ছাড়া আমাদের মস্তিষ্ক তার ওপরে ওঠার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে; ফলে অতীত নিয়ে চাপান উতোরে নেমে দুটো ভাত বেশি হজম করে সুগারের ওষুধ খেয়ে তন্ত্রের বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঘুমিয়ে পড়ছি, আর স্বপ্ন দেখছি নারীদেহের / পুরুষদেহের...

ধন্যবাদ।

 

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে