উলটো পুরাণ




সক্কালবেলা ঘুম ঘুম চোখে ব্যালকানীতে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাদের বাড়ী থেকে দূরে বড়ো রাস্তার মোড়টা চোখে পড়ে। মোড়ের মাথায় একটা মুদীর দোকান। সেখানে রোববারের সকালে টুকটাক ভীড়। বেশিরভাগ ভীড়ই পাড়ার মা-কাকীমা টাইপের মহিলাদের। তাদের আঁচলে কিম্বা হাতের মুঠোয় টাকার নোট কিম্বা কয়েন। রান্নার ইমার্জেন্সী প্রয়োজনের সম্বল এই মুদীর দোকান। এই মুদীর দোকানে ‘হরেকরমবা’ জিনিস পাওয়া যায়। বেলুন থেকে শুরু করে পোস্ত। সব পাওয়া যায় এমন দোকানের মালিকের প্রায় কুবেরের টাইপ সম্পত্তি। বাংলাদেশে না কি অনেক জমি-জিরেত ছিল। সেগুলো বেচে এখানে এসে, এবং তার বিদেশবাসী আইটি ছেলের কৃপায় বেশ বড় দোকান ফেঁদে বসেছে। আমি, নাম দিলাম, ধরুন, রাজা কুবেরের দোকান।

      তো এই রাজা কুবেরের দোকানের ঠিক উল্টোদিকে জেমস বন্ড আর বাবা মুখোমুখি হয়ে কি যেন কথাবার্তা বলে চলছে।

      আমি দেখলাম বটে, তেমন পাত্তা দিলাম না। জেমস বন্ডের কাছে কোন দেনা-পাওনা নেই। ফলে আমার কোন ভয় নেই। আমি আশেপাশে চোখ বোলালাম। লীনা কাকীমা অনেক সকালেই স্নান করে। এখন হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে ছাদে কাপড় মেলছেন। কাকু সকালে ছাদে যোগ ব্যায়াম করেন, সেটাই করছিলেন বোধহয়। লীনা কাকীমার ঠোঁট নড়ল, কাকার ঠোঁট আর হাত-পা নড়ল; জবাবে লীনা কাকীমার ঠোঁট নড়ল, কাকার ঠোঁট একটু জোরে জোরে নড়ল; তারপর লীনা কাকীমার ঠোঁট অনেকক্ষণ নড়ল, কাকার ঠোঁট অল্প নড়ল, মাথা প্রবলবেগে দুইদিকে নড়ল; অতঃপর লীনা কাকীমার ঠোঁট আবার নড়তে লাগল, কাকা যোগব্যায়াম বন্ধ করে ছাদ থেকে নেমে গেল; একটু পরে কাকা সাইকেল আর বাজারের তিনটে ব্যাগ নিয়ে যখন ঠোঁট নাড়তে নাড়তে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছেন, লীনা কাকীমার ঠোঁট তখনও নড়ছে, ছাদে, এমনি এমনিই।

আর তখনও কুবের রাজার দোকানের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে জেমস বন্ড আর বাবা মুখোমুখি হয়ে কি যেন কথাবার্তা চালিয়েই যাচ্ছে।

আমি রান্নাঘরে এলাম। আমাকে দেখেই মায়ের ঠোঁট নড়তে শুরু করে দিল। এবার অবশ্য আমি কথাগুলো দিব্বি শুনতে পারছি, কিন্তু আপনাদের শোনাতে চাইছি না। কফি যতক্ষণ ধরে বানালাম, মায়ের ঠোঁট নড়তেই লাগল। আমি এক মগ কফি নিয়ে আবার ব্যালকানীতে এলাম।

এবং তখনও, কুবের রাজার দোকানের উল্টোদিকে জেমস বন্ড আর বাবা মুখোমুখি হয়ে কি যেন কথাবার্তা চালিয়েই যাচ্ছে!

এবার একটু শঙ্কা হল। জেমস বন্ডের সাথে এত কি কথা? নিজেকে নিয়ে শঙ্কা হচ্ছে। আমার আর জেমস বন্ডের অনেক গোপন ইতিহাস আছে। সেগুলো বাবার কর্ণপটহে ঢুকে মায়ের সামনে মুখ দিয়ে বের হলে চিত্তির। আমি তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলাম। বাবা জেমস বন্ডকে কি টাকা দিল! আই শ্লা! কি ব্যাপার? এখন তো মাস পড়েনি। পেপারের টাকা অগ্রিম আদায় করার বান্দা তো সে নয়। তাহলে? ন্যাঃ চাপ বাড়ছে মনে, হৃদয়ে। বাবা কুবের রাজার দোকানে ঢুকে গেল।

আমি ভাইয়ের ঘরে এলাম। কফি শেষ। ভাই কম্বল মুড়ি দিয়ে পিপের মতো পড়ে ঘুমাচ্ছে। আমি পর্দা সরিয়ে জানলার পাল্লা খুলে দিলাম। পিপে নিজের চোখের ওপর কম্বল ঢাকা দিয়ে, আহ্‌, ছি ছি! নিজের সহোদরাকে বিশ্রী কয়েকটা কথা বলল। আমি ছাড়ব না কি ব্যাটাকে? এর প্রতিশোধ চাই-ই চাই। পায়ের দিক থেকে কম্বল দুহাতে ধরে এক ঝটকায় টান মেরে নিজেই মেঝেতে ছিটকে পড়লাম। মাঝখান থেকে কম্বল আমার উপর এসে পড়ল। আমি এবার বেরোনোর পথ খুঁজছি। আর শুনছি ভাইয়ের অবিশ্রান্ত গালাগাল। ভাই আমার ওপর এবার ঝাপিয়ে পড়বেই। বাঁচার কোন চান্স নেই। আমি আশা এবং আশঙ্কা নিয়ে তখনও কম্বলের ভেতর থেকে বেরোনোর পথ খুঁজে চলেছি।

এবার আর রক্ষে নেই। মা ঢুকলেন ময়দা মাখা বেলন হাতে, আজ তাহলে লুচি হবে। আমি চোঁ করে পালাতে গিয়েও পিঠে একটা বেলনের ছোঁয়া পেলাম। আর বেরিয়েই বাবার বুকে আছড়ে পড়লাম। বাবা আমাকে নিয়ে সোফায় আছড়ে পড়ল। ওদিকে, মেঝেতে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, আহ্‌! এ কি! ম্যাগাজিন আর ম্যাগাজিন!

বাবা বলল, জেমস বন্ড পাঠিয়ে দিল। বলল, তোর চাকরী পরীক্ষার জন্যে না কি এইসব ম্যাগাজিন লাগবে। আমি কিনে নিলাম ওর থেকে, বুঝলি।

বুঝলাম। জেমস বন্ডের তুখোড় বুদ্ধি। মানীপেনীর টাকা বাঁচিয়ে খোদ সরকারের হাত দিয়েই স্মাগলিং করেছে! এই না হলে আমার জেমস বন্ড! ব্যাটাকে এলাইচি চা খাওয়াবো।

ভাই বেলনের মার খাচ্ছে। দেরী করে ওঠার পুরস্কার। পরিত্রাহি আওয়াজ পাশের ঘর জুড়ে। আমি যখন মেঝে থেকে ম্যাগাজিন তুলছি এক এক করে, ভাই উর্ধ্বশাসে বাথরুমের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে আমাকে বলল, আমি যদি এর প্রতিশোধ না নিয়েছি তো দ্যাখ।

আমি ম্যাগাজিনগুলো বুকের কাছে জড়ো করে দাঁড়ালাম। মা আমার পাশ দিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার সময় বললেন, এসব গুষ্টির পিন্ডি না চটকে দয়া করে রান্নাঘরে এসো। কাজ আছে...

না, সারাদিন কাজের চাপে ম্যাগাজিনগুলো দেখার সময় পাই নি। এখন দেখতে বসব। তার আগে লিস্টটা দিয়ে দিই। আপনারা কেউ কিনে থাকলে কেমন লাগল এগুলো জানাবেন---

১। রোববার প্রতিদিন – তারাপদ রায় আমার বড়ো প্রিয় – পাঁচটি টাকা দাম

২। দেশ ৯০ --- শখ করেই বাবা কিনেছেন – মুল্য ৩৫

৩। অনুবাদ পত্রিকা --- যার আশায় থাকি দুমাস ধরে --- ৫০ ট্যাকা

৪। পাক্ষিক কৃত্তিবাস --- মেসবাড়ীর ক্যাঁওক্যাচাল লেখা মনে হচ্ছে --- এটা ৫০

৫। নবকল্লোল --- অক্টোবরেরটা গছিয়েছে অনেক গল্প আছে বলে --- ৪০ লেখা, কত নিয়েছে ব্যাটা জানি না

     ৬। FRONTLINE --- এটা নাকি আমার চাকরীর পরীক্ষায় খুব লাগবে! আসলে কৌতুহলের কারণে আনতে বলেছিলাম --- ১২৫ টাকা দাম! এই মাগ্যির বাজারে একটা পাক্ষিকেই আগুন ঝরিয়ে দিয়েছে 'দ্য হিন্দু'!

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে