দোস্তোজী - এক সন্ধ্যাদীপের শিখা


সমগ্র বঙ্গমুলুক যখন আর্জেন্টিনার পরাজয়ে মুহ্যমান, নব্বইটা অবিশ্বাস্য মুহূর্ত পার হচ্ছে দর্শকের অবিশ্বাস্য চোখের যন্ত্রনাময় আবেদনে, মফস্বলের পড়ন্ত শীতের এক সন্ধ্যায়, তখন, আমার হতভাগার সাথে আমি সিনেমা দেখছিলাম।

সিনেমার নাম ‘দোস্তোজি’।

আমার সিনেমাটা দেখতে দেখতে আমার নিজের, কিছুদিন আগের লেখা একটা সিনেমার রিভিউয়ের কতকগুলো কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বাংলা সিনেমার জগতকে খানিকটা তুলোধনা করেই লিখেছিলাম, “কিন্তু এই ধরনের একটু অন্যরকমের সিনেমা এবং সেই সাথে পাল্লা দিয়ে তার পরিবেশনা যেমন সেখানে হচ্ছে, টলিউড, বোধহয়, সেই তুলনায়, ততটাই পিছোচ্ছে এমন সিনেমা দেখার আশা, অন্তত বাংলা সিনেমায় অদূর ভবিষ্যতেও হওয়ার সম্ভবনা কম

      আজকে, সিনেমাটা দেখতে দেখতে, আমার মনে হচ্ছিল, খানিকটা হলেও, ভুল প্রমাণিত হয়েছি আমি। এ ধরনের সিনেমা দেখার জন্যে, সিনেমা হলের বাইরে, সারারাত লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, অন্তত একটা ফ্রন্ট রো সীটের টিকিটের অপেক্ষায়। অনেক সময় নিজে ভুল প্রমানিত হলে, বেশ ভালোই লাগে। আজ ছিল সেইরকম একটা দিন।

      এই সিনেমা নিয়ে এত কথা হয়ে চলেছে যে নতুন করে কিছু বলার নেই। কেবলমাত্র আমার নিজের কিছু অনুভূতি প্রকাশ করার আছে। যখন ইন্টারভ্যাল হল, বলা ভাল, গল্পের যে জায়গায় এসে ইন্টারভ্যাল হল, আমি রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। পরিচালকের প্রথম সিনেমা। না হয় তিনি যে সমস্ত অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়ে অভিনয় করিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই ক্যামেরা ফেস করেনি কোনদিন। কিন্তু এত সাহস গল্পের প্লটে দেখান কি করে! এভাবে একটা ইন্টারভ্যাল! নবাগত লেখক-পরিচালক কোন দুঃসাহসে ভর করে এমন সিনেমার স্ক্রীপ্ট ফেঁদেছেন, যেটার ইন্টারভ্যালের আগের সময়টুকু নিয়ে অনায়াসে পুরো সিনেমা বানানো যায়। এবার কি হবে! ইন্টারভ্যালের পর কিভাবে সিনেমাটা এগোবে? সবথেকে সাংঘাতিক, শেষটাই বা হবে কি করে?

      বিরতির পর খানিকটা সময় ঝুলিয়ে দিয়েওছিলেন। একরাশ আশঙ্কা আর আতঙ্কের মাঝে দেখলাম, আধাঘন্টার মধ্যেই আবার সিনেমার রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন পরিচালক, বিস্মিত হলাম, আনন্দ হল, এবং, আয় হায়! কি অদ্ভুতভাবে শেষ করেছেন! এ যেন এক অসম্ভবকে সম্ভবপর করা! এমন সুন্দর একটা সিনেমার শেষ হতে পারে, আমি যাস্ট ভাবি নি! যখন নাম দেখানো হচ্ছে, তখনও আমি চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম, শেষ কবে এমন সুন্দর বাংলা সিনেমা দেখেছি? অনেক পরে মনে পড়ল --- মেঘে ঢাকা তারাতারপর বহুদিন, আমার চোখে, বাংলা সিনেমা বন্ধ্যা দশায় পড়েছিল। এ নিয়ে অতি অবশ্যই বিতর্কের ঢেউ তোলাই যেতে পারে, কিন্তু নন্দনে ভীড় না হওয়ার সাপেক্ষে যুক্তিপ্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে না। বলা বাহুল্য, সিনেমাটা কিন্তু নন্দনে দেখি নি। দেখেছি আমারই মফস্বলের এক প্রেক্ষাগৃহে, যে প্রেক্ষাগৃহ আমাকে আমার ছেলেবেলার খানিকটা ফিরিয়ে দিল।

      বাংলা সিনেমা উঠে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু পরিচালকরা কি সময় দেবেন? অর্থ দেবেন? প্রোডিউসারেরা? কিম্বা পরিবেশকরা? শুনেছি, পরিচালক সাত বছর সময় নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। অর্থাৎ, যে পরিমাণ সাধনা এই সিনেমাটার পেছনে ছিল, সেই সাধন কয়জন পরিচালক করতে রাজী আছেন? যদি থাকেন, তাহলে বাংলা সিনেমা অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। নচেৎ, এই সিনেমা একটা ব্যতিক্রম হয়ে থাকবেন। প্রসূন চ্যাটার্জীর পরের সিনেমার অপেক্ষায় রইলাম। আশঙ্কা হয়, জনপ্রিয়তার চোটে উনি না দ্বিতীয় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, কিম্বা সৃজিত মুখার্জী হয়ে যান।

      সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের ছায়া রয়েছে। বিশেষত পথের পাঁচালীর। আমার কিন্তু আরেকজন পরিচালকের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। বেশ কিছু ফ্রেম ওনার ফ্রেমের এত কাছাকাছি, যে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। তবে অবশ্যই, পরিচালক নিজের মতন করে বানিয়ে নিয়েছেন। আর এখানেই তার জিত।

       অভিনয় যে কিভাবে করতে হয়ে তা এই পুচকে দুটোকে দেখে শেখা উচিৎ। আরিফ শেখ আর আসিফ শেখ। এরা কেউই প্রথাগত অভিনয় তো দূরে থাক, ক্যামেরার সামনে দাড়ানোর মতন অভিজ্ঞতা ছিল। ডোমকলের পাড়া গাঁ এতটাই অজ। আর সেই সাথে মা – জয়িতা মুখোপাধ্যায় আর দিদি --- স্বাতীলেখা কুন্ডু। স্যালুট আপনাদের দু’জনের অভিনয়কে।

সত্যি কথা বলতে কি, পরিচালক অসাধ্য সাধন করেছেন। আরেকজনের কথাও বলার আছে, যিনি এই সিনেমার ক্যামেরাম্যান। স্থিরচিত্রের জন্যে যাকে ডাকা হয়েছিল, ক্যামেরাম্যানের অভাবে তাকেই গ্রহণ করতে হয়েছিল ক্যামেরার দায়িত্ব। ভাগ্যিস তিনি তা করেছিলেন। এমন মরমী গ্রাম্যদৃশ্যের পাশাপাশি ক্লোজড শটে অমন হৃদয় মোচড়ানো সব শট পাওয়া যেত কি না কে জানে!

 

========================

Dostoji

Cast: Arif Shaikh, Asik Shaikh, Jayati Chakraborty, Anujoy Chattopadhyay, Swatilekha Kundu

Directed and Written by : Prasun Chatterjee

Duration: 2 Hrs.


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে