আমি আশাবরী

 


মনে করুন, ঘোর গরমচৈত্রের দুপুরের কাঠফাটা রোদ। দোতলা বাড়ীর নীচের তলাটিতে আপনি আছেন। পাথরের মেঝে। কাঁচের জানালাগুলো শুধু বন্ধই নয়, ভারী, মোটা পর্দা দেওয়া। হাল্কা এসি চলছে। আপনি বিছানার এক কোনায় বালিশ দিয়েছেন হেলান দেওয়ার জন্যেআপনার ঘরোয়া পোষাকটা একটু ঢিলেঢালা করে দিয়েছেন। ভারী লাঞ্চ শেষ। এবার একটু জোয়ান খেয়ে একটা পর্দা এমনভাবে অল্প ফাঁক করলেন, যে, যে তীব্র আলোটুকু মৃদু হয়ে ঢুকছে তাতে করে বালিশ পিঠে আধশোয়া হয়ে বই পড়া যাবে আয়াসে, যা আপনার দুপুরের একমাত্র প্রাণের আরাম, মনের আনন্দএবার বইটা নিয়ে নিশ্চিন্তে পড়তে শুরু করুন---

      ঠিক এমনভাবেই পড়ার বই ‘আমি আশাবরী’। মজার কথা, বইয়ের প্রচ্ছদেও ঠিক এমনই একটি ছবি আছে, তবে তা চেয়ারে বসে। তবে আমার ক্ষেত্রে বিছানায় একটু এলিয়ে না হলে এই উপন্যাসটা পড়ার সুখটা অসম্পূর্ণ মনে হল। প্রসঙ্গত, প্রচ্ছদ আমার একদমই পছন্দ হয় নি।

      তা এই বই এমন এলিয়ে যখন পড়বেন, তখন তাতে কি পাবেন? পাবেন একটি অগ্রগণ্য পাবলিশার্সের লড়াই, যে লড়াই এখনকার পাবলিশার্সরা লড়ছে নিজেদের মধ্যে (বোধহয়); পাবেন স্বামী-স্ত্রীর মানসিক এবং মানবিক দ্বন্দ্ব, যে দ্বন্দ্বে রয়েছে অতীত অসুস্থ সম্পর্ক এবং বর্তমান সুস্থ সম্পর্ক; আছে সেই চিরপরিচিত পারিবারিক বধূ-শাশুড়ী টক্কর; আছে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের চিরকালীন দ্বিধা; আছে একটি সাধারণ মেয়ে কিভাবে এই সময়ে সাধারণ জীবন যাপন করতে গিয়ে প্রতিপদে ঠোক্কর খায়; আছে একটি NGO চালানোর ক্যাপিটালের অভাবের সাথে সমাজের মঙ্গল করার প্রবল উৎসাহের লড়াই; আর আছে কিভাবে বইকে সাধারণ মানুষের সামনে আনা যায়, পড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা যায়, তার চিন্তাভাবনা।

      এই অনেকগুলো ‘আছে’ দিয়ে তৈরী হয়েছে উপন্যাসের খাঁচা। আর সেই খাঁচা ভরানো হয়েছে চরিত্রের পারস্পরিক কথোপকথন, আচার আচরণ, এবং, সেই কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে নিজেদের মধ্যেকার আশা-ভরসা আর ভালোবাসা-ঘৃণার কথা; আর আছে কিছু পাঞ্চলাইন---

      “কি অদ্ভুত মানুষের মন। অবচেতন মস্তিষ্কের যে কী খেলা কে জানে! এই আমরা হাসছি, কাজ করছি, খেলছি, চান করছি, অফিস কাছারি, ব্যবসা কত কি করছি, কিন্তু কখন যে অবচেতন মস্তিষ্ক বহু অতীতে জমে থাকা কোন স্মৃতির খোঁচা খেয়ে সবকিছু ওলট পালট করে দেবে, আমরা কেউ জানতেই পারি না!”

      এই লাইনগুলো চিরপরিচিত লাইন, কিন্তু নতুনভাবে আবার আমাদের সামনে পরিবেশিত। এই লাইনগুলো মনের ভেতরে ধাক্কা মারে না, কিন্তু, প্রশ্নটাকে আবার মনে করিয়ে দেয় --- “কিন্তু আমি? কি পেয়েছি সারাটা জীবন? আমিও তো একটা মানুষ। আমারও তো মন আছে; একটা শরীর আছে। আজীবন একা একা বাঁচা যায়?” --- এমনই বেশ কিছু চিন্তনের কোলাজ এই উপন্যাসের পরতে পরতে অজ্ঞাতবাস করে আছে, যা পড়তে পড়তে, চোখে পড়ে, কখনও বা মনেও ধরে।

      সমগ্র উপন্যাস জুড়ে চরিত্রেরা এমনভাবেই আসে-যায়, তৈরী করে একটা উপন্যাসের ইমারত, গরে তোলে অভ্যন্তরীন সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে না, এক স্বপ্নের মতো রেশ রেখে যাবে, যেখানে আশা এবং আশঙ্কার দোলাচল থাকবে, একটা জলছবির মতো...

 

=========================

 

আমি আশাবরী

লেখকঃ অতনু প্রজ্ঞান

প্রকাশকঃ মিত্র ও ঘোষ

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩০০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে