তবু বিহঙ্গ, এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা
এক-একটা সময় আমার মনে হয়, ছুটি কি
আর হবে না আমার? এই প্রহরশেষের আলোয় রাঙা হয়ে যার হাত ধরে কোমল ঘাসবিছানো পথে আমি
হেঁটে চলেছি কাশের বনে বনে, যার নরম ওষ্ঠের স্পর্শ আর স্বাদ এখনও আমার গালে, ঘাড়ে,
ঠোঁটে, জিভে --- তার কাছেও কি আমার কোন ছুটিই পাওনা নেই?
“ছুটি হল যার কাছে
কিছু তার প্রাপ্য আছে,
নিঃশেষে কি হয় নাই সব পরিশোধ।”
পরিশোধ কি হয় নি? আরও কি অনেক
বাকি? আমার কি ছুটি হয় নি? আমি কি ডাক শুনতে পাই নি তোমার? সমস্ত দিনজুড়েই আমি
কারও কন্যা, কারও দিদি, কারও বন্ধু, কারও প্রেমিকা --- আমার কি সেখান থেকে ফেরার
ডাক আসবে না? কখনও কি এমন হবে না, যেখানে ‘তুমি’ আমি, আর ‘আমি’ই তুমি হব?
তোমার ডাক কি আসে নি? আমি কি
প্রস্তুত নই? না কি এই কাজের মাঝে তুমি আমায় ডাক দিয়েছিলে, বহুবার! স্তব্ধ দিনের
মাঝপ্রহরের কঠিন আলোয় “তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির
নিমন্ত্রণে”,
এই কাশের ফুলেরও ছুটি হয়ে গেছে।
কোন শুভ্রতাই আর অবশিষ্ট নেই। কাশের বনে বনে বিদায়ের হাতছানি। আমার নরম আঁচলে যে
খানিক শুভ্রতা লেগে আছে, কিছুদিনের মধ্যে তারও আর কোন অবশিষ্ট থাকবে না। কাশের
বনের ফাঁকে বিদায়ী সূর্যও ছুটি নিচ্ছে। তাকে বারণ করবে কে? তোমার ডাকের অমোঘ
আকর্ষণে সে যে বাধা,
“কূলে যখন এলেম ফিরে তখন অস্তশিখরশিরে
চাইল রবি শেষ
চাওয়া তার কনকচাঁপার বনে।”
আর সে অমোঘ আকর্ষণের মাঝেই আমার
মনে হল, ডেকেছিলে তো! আমায় তুমি ডেকেছিলে। হাজার কাজের মাঝেই ডেকেছিলে,
“আমার ছুটি অবেলাতেই দিনদুপুরে মধ্যখানে--
কাজের মাঝে ডাক পড়েছে কেন যে তাই
কেই বা জানে॥”
কিন্তু আমি সাড়া দিতে পারি নি। কারণ---
“তখন ছিলেম বহু দূরে কিসের অন্বেষণে॥”
কি খুঁজছিলাম? জানি না। কেন
খুঁজছিলাম, জানি না। তখন হয়তো তার মূল্য ছিল, চাহিদা ছিল, ভালো-মন্দের
আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল, আজ সে সব ‘রক্তিম মরিচীকা’। তার যেন আর কোন মূল্যই নেই। এখন
কেবল---
“ ভেসে
যেতে চায় মন,
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায়
সব চাওয়া সব পাওয়া॥”
কাকে ফেলব? কি ফেলব? আমার কি আর
সে অধিকার আছে? সে ছুটির অধিকার? যে ছুটিকে নিজের হাতে ত্যাগ করেছি, যে
নিমন্ত্রণের আবাহনকে অস্বীকার করেছি নিজ ঔদ্ধত্যে, তা কি আর মিলবে? জানি না।
“লিখন তোমার বিনিসুতোর শিউলিফুলের মালা,
বাণী সে তার সোনায়-ছোঁওয়া অরুণ-আলোয়-ঢালা--
এল আমার ক্লান্ত হাতে ফুল-ঝরানো শীতের
রাতে
কুহেলিকায় মন্থর কোন্
মৌন সমীরণে।”
জানি না মিলবে কি না। এখন আর বেলা
নেই। যে বেলায় আমার ডাক পড়েছিল, আমার যে সাথী আমায় ডেকেছিল, সে এখনও কি করুণ স্বরে
আমাকে ডাকছে? শেষ চেষ্টা? দিনান্তের শেষ আলোয়, নদীর ধারে, নৌকায় ওঠারও প্রাক্
মুহূর্তেও কি সে আমায় আশা করছে?
“মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে
খেটে গেছে তো দিন
অনেক কেটে,
অলস-বেলায় খেলার সাথি
এবার আমার হৃদয় টানে--”
তার ডাক যে এখনও শুনতে পাচ্ছি। অনেক অনেক দূরের ডাক সে, সন্ধ্যাতারার
আলোর মাঝে বিলীন হওয়ার আগের ডাক। আমায় ফিরতেই হবে। তার সাথে যে
আমার অনেক কথা বলার আছে। সুরে সুরে হোক, কিম্বা সুরে অ-সুরে, আমার যে তাকে চাই-ই
চাই... এবার তো থামুক সব কিছু। এবার তো বসি এই ঘাসের বনে। আমায় আস্তে আস্তে ঘিরে
ধরুক ঘাসবন, কাশবন আর উতল হাওয়া...
“কোলাহল তো বারণ হল, এবার
কথা কানে কানে।
এখন হবে
প্রাণের আলাপ কেবলমাত্র গানে গানে॥”
Comments
Post a Comment