শারদীয়া নবকল্লোল

 


কিছু কিছু লেখা পড়ার সময় মনে হয় যে, এই লেখাটার পেছনে অনেক সতর্কতা, অনেক পরিশ্রম, অনেক রিসার্চ আছে। এমন একটা লেখাকে সঠিকভাবে পাঠকের সামনে আনাটা একটা চ্যালেঞ্জ। লেখক বা লেখিকা জানেন, বিতর্ক অবশ্যম্ভাবীহয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে বিপুল বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে। এক-এক পাঠকের মানদন্ড এক-একরকম, তবুও, একটা সাধারন মানদন্ডে ‘পালস্‌’টা বুঝে নেওয়া যায় এবং সেই মানদন্ড দিয়ে বিচার করলেও আমরা জানি, লেখাটা গ্রহণের বদলে বর্জিত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল, এবং সেই সাথে নিন্দামন্দও জুটতে পারে।

অপরদিকে যারা পাঠক, তারাও খুব বিপদে পড়ে যান। কোন লেখা তাকে যদি চ্যালেঞ্জ করে তাহলে সেই চ্যালেঞ্জটা তিনি নেবেন, না ছুঁড়ে ফেলে দেবেন? সেটা তার কাছে একটা বিশাল বড়ো ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। তার আজন্ম লালিত পছন্দ আর সংস্কারের বাইরে হঠাৎ তেমন কিছু এলে তার নিজের কাছেই নিজেকে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হয়। ফলে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বেরিয়ে এসে লেখাটা পড়াই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, পছন্দ-অপছন্দ বিচার করা তো আরও দুরূহ।

সর্বাণী মুখোপাধ্যায়ের ‘যোনিকীট’ পড়তে গিয়ে তেমনই এক সমস্যার মুখোমুখি হলাম খানিকটা। এ যেন এক আয়নার সামনে নিজেকে দাঁড় করানো, তা-ও নগ্নভাবে। আয়নার সামনে নগ্নভাবে দাঁড়াতে কেমন লাগে? বেশ অস্বস্তিকর। নিজেকে, নিজের জাতটাকে নগ্নভাবে দেখতে পারাটা কি খুব সহজ? না। নিজের জাত মানে আমি ‘মেয়েজাত’টার কথাই বলছি। যারা এলিট সোশাইটিতে বাস করে, যাদের হাতে অঢেল অর্থ, অথচ একা, কিম্বা স্বাধীনতার নামে উগ্র নারীবাদে যারা বিশ্বাস করে, কিম্বা যারা জানে, অর্থ তাদের ভেতরের মানুষটার ক্ষিধা মেটাতে সক্ষম, সেই মেয়েরা তবে তা করবে না কেন?

এখানে যদি তোলেন স্বাধীনতা বনাম স্বেচ্ছাচারিতার প্রসঙ্গ, আমি তাহলে আমার প্রতিক্রিয়াটা পড়তে মানা করব। আমি সেই দ্বন্দ্বের কথা বলছি না, আমি বলতে চাইছি নারীদেহের ভেতরের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কথা, যে আকাঙ্ক্ষা পূরণের সামর্থ্য আছে, এবং যা সে পূরণ করতে চায়। যেমনভাবে ‘বেশ্যা’ বা নারী ‘এসকর্ট’রা তাদের ক্লায়েন্টের চাহিদা পূরণ করে তাদেরকে তৃপ্ত করে।

আমাদের কাছে নারী দেহপোজীবী খুব সহজ বিষয়। এতবার এতভাবে তাদের কথা বলা হয়েছে শিল্পকে আশ্রয় করে, তার যে আরও একটা উলটো পিঠ আছে, সেটা ভুলে যাই। আর ভুলে যাই বলেই পুরুষ ‘জনপদসখা’ বা ‘মেল প্রস্টিটিউট’ নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। হয়তো বাংলায় কিছু কিছু লেখার ক্ষেত্রে উঠে এসেছে, যা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে, কিন্তু এমনভাবে গভীর করে তাকে সামনে আনে, যাকে বলে এক্কেবারে ‘র’, সেভাবে চোখে পড়ে নি।

 

গল্পের প্রথম ধাক্কা --- তার নামকরণ --- এই নামকরণ পাঠক টানার জন্যে নয়। পাঠককে ধাক্কা দেওয়ার জন্যে। জানি না, নামকরণ করতে লেখিকা কত সময় নিয়েছেন।

এ গল্পের নায়ক, অনঙ্গদেব, একজন মেল প্রস্টিটিউট। অনঙ্গদেব আসল নাম নয়, থাক, আমিও তাকে ঐ নামেই ডাকি, যেহেতু তার সামাজিক পরিচয় --- সে অনঙ্গদেব।

এইটুকুতেই যদি হয়ে যেত, তাহলে তো কথাই ছিল না। কিন্তু সমস্যা হল, অনঙ্গদেবের চোখে মহিলাদের দৈহিক চাহিদার বিভিন্নতা। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তীব্রতার কথা। সেটার মুখোমুখি হওয়া। “নারীর হৃদয় কখনো বৃদ্ধ হয় না। বয়েস, চেহারা, শরীর, ক্ষমতা-অক্ষমতা তার কাছে কোন ফ্যাক্টর না। নারীর হৃদয় অক্ষত যোনীর মতই চিরকুমারী।” তো এই নারীরা কতরকম? “এখানে সমকামীতা, বাইসেক্সুয়ালিটি বা দ্বিগামী, ট্রান্সজেন্ডার ইত্যাদি বিষয় অনেক খুল্লমখুল্লা।” আর কতরকমের তাদের চাহিদার বিভিন্নতা! “মর্ষকামী, ধর্ষপ্রেমী, প্রতিশোধপরায়ণ, অবহেলিত এবং অতৃপ্ত, আত্মসংশয়ী ও অনিরাপত্তায় ভোগা; এছাড়াও আছে ‘অনলি ফান’ --- শুধুই মজালোটা ক্লাস, আছে ট্রান্সজেন্ডার --- নারীতে রূপান্তরিত কাস্টমার, আছে ‘অরজি’ --- মহিলাদের গ্রুপসেক্স ইত্যাদি ইত্যাদি কতরকমের যে ভাগ।” পাশাপাশি রয়েছে বাৎসায়নের কামসূত্রের গুঢ়তত্ত্বের প্রতি তথ্যবহুল ইঙ্গিত।

এর পাশাপাশি এসেছে অনঙ্গদেবের অতীত। সে এক অদ্ভুত রকমের অতীত। যে অতীতে তার একমাত্র মরুদ্যান --- তার মা। এই একটা জায়গায় এসে সে একদম শিশু। সেখানেই একমাত্র তার নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। বাবা এবং পিতৃপরিবারের সাথে তার সম্পর্কই একটা সময় তাকে এপথে নিয়ে আসে। সেই মনস্তাত্বিক জটিলতাটা যদি আরেকটু বিষদে বলা যেত, তাহলে উপন্যাসের ‘কড়াভাব’টা এক্কেবারে জমে যেত। শুধুমাত্র তথ্যসমৃদ্ধ উপন্যাস বেশি ভাল লাগে না।

তবে, এ উপন্যাসের সবথেকে বড়ো চ্যালেঞ্জ, অদিপাউস কমপ্লেক্স। এই কমপ্লেক্সের সাথে যারা পরিচিত, বা যারা বিস্তারিত পড়াশোনা করেছেন, তারা জানেন, ফ্রয়েড এবং কার্ল জুং সাহেব এ নিয়ে অনেক গভীরে গিয়েছেন। আর এইখানেই মাত করে দিয়েছেন লেখিকা। এভাবে এই কমপ্লেক্সকে সামনে নিয়ে আসা, অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা এবং সংবেদনশীলভাবে, যাস্ট ভাবা যায় না। পড়তে পড়তে কোথাও সফোক্লিসকে মনে পড়ে যাচ্ছিল। আর এইখানেই হয়তো কোথাও আনএক্সপেক্টেড হয়ে যায় উপন্যাসটা। এক্কেবারে অন্যরকম। এ যেন এক অন্যরকম আয়না, যা চাপা পড়ে থাকে এতদিন ধরে, তা হঠাৎ করেই ঝকঝকে হয়ে যায়, আর তখন তার মুখোমুখি দাঁড়ানো খুব কঠিন হয়ে পড়ে।

“অস্বীকার করতে পারিস? ছেলেরা মায়ের মতো বউ চায়। কখোনো ভেবে দেখেছিস, কেন? কোন আদিম সত্য লুকিয়ে আছে এর ভেতরে যেটা আমরা দেখতে ভয় পাই? প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে অস্বীকার করি!”...

জানি না, সর্বানী মুখোপাধ্যায়ের কাছে আমার এই প্রতিক্রিয়া পৌছাবে কি না। তাকে একটা অনুরোধ। যদি পরবর্তীকালে এটা উপন্যাস হয়ে বের হয়, তাহলে আপনি আরেকটু বিস্তৃত করবেন। বিশেষ করে মানসিক টানাপোড়েনগুলোশব্দসংখ্যার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়ে আরোও গহীন গভীরে গিয়ে যদি অনঙ্গদেব চরিত্রটার পাশাপাশি মেয়েদের ভেতরের এই কমপ্লেক্সিটিগুলোর সাইকোলজিকাল অ্যানালিসিস আরোও বিস্তারিত হয়, বিশেষত কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে, তাহলে হয়তো এই উপন্যাসটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকতে পারে।

 

সবশেষে আপনার এই উপন্যাসটা পড়ার পর রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা লাইন মনে পড়ল---

“সত্য যে কঠিন,

কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,

সে কখনো করে না বঞ্চনা

 

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

 

======================

যোনিকীট

সর্বাণী মুখোপাধ্যায়

শারদীয়া নবকল্লোল

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে