শারদীয়া আনন্দমেলা
শারদীয়া যা কেনার কেনা হয়ে গেছে। এর বাইরে কেনার ইচ্ছা নেই। বিনামূল্যে দিলেও পড়ার বাসনা নেই। কিন্তু সে বাসনায় জল ঢালতে হল। শারদীয়া আনন্দমেলা নেটে PDF ভার্সান আসার পর। কৌতুহলী হয়ে নামিয়েই ফেললাম। কৌতুহল মূলত শীর্ষেন্দুবাবুর জন্য, এবং, আমার মনে হয়, অনেক বছর পর, এই প্রথম তিনি একটা উপন্যাস শেষ করলেন।
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ রমরমিয়ে বিক্রী
হয় এখনও। আমি বেশিরভাগ সিরিজই পড়েছি টানটান উত্তেজনা নিয়ে। গল্পের বিন্যাস, চোর-ভুত-পাগলের
সমাহার, গ্রামের অনবদ্য পরিবেশ, এবং সেই মজার মজার সংলাপ! ওনার আর সুকুমার রায়ের
(হ য ব র ল) লেখা সংলাপগুলো আমাদের নিজেদের বন্ধুদের মধ্যে মেয়েলি রহস্যঘণ
সাংকেতিক কথাবার্তা কিম্বা খিল্লির উপকরণ মেয়েবেলাতেও ছিল, বড়োবেলাতেও আছে।
গত কয়েক বছর ধরে সেগুলো অনুপস্থিত
ছিল। এবারেও অনুপস্থিত। তবে, এবারে কিন্তু সুন্দরভাবে শেষ করেছেন। আর গ্রামের বদলে
মফস্বল এসেছে, ফলে সম্পূর্ণ গ্রাম্যভাব থেকে বেরিয়ে না এসেও একটুখানি সেই ভাব বজায়
রেখে বেশ সুন্দরভাবে গল্প এগিয়েছে কালীচরণকে নিয়ে। এবারের গল্পে ভুত নেই, চোর আছে,
রণচন্ডী স্ত্রী এবং টাকালোভী চালাক কাজের লোক দ্বারা নিপীড়িত দুঃখী গজপতি আছেন,
যার মত, “প্রত্যেক মানুষের বেসিক বিজ্ঞান খানিকটা জানা উচিত।” আর আছে শ্যাডো
সেনগুপ্ত, যে কি না “জন্মসূত্রেই সে এক ধরণের নির্বিকারত্ব নিয়ে জন্মেছে।” যাকে কারণবশত একটা খুন
করতেই হবে। এদের নিয়েই মোটামুটি গল্পটা এগিয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দু কালীচরণ
ফেরিওয়ালা।
উপন্যাসের কয়েকটা লাইন মনে রাখার
মতো। যেমন “অস্ত্র সবসময়েই অন্যকে হত্যা করার প্ররোচনা দেয়।” কিম্বা “অ্যাকশন শুধু
হাত-পায়ের কাজ নয়, মগজেরও কিন্তু অ্যাকশন আছে, আর সেটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।” কিম্বা
“আপনি বড় সুন্দর শিস দেন আর যেন শিস বিক্রী করতে যাবেন না বাবু। সুর বড়ো শুদ্ধ
জিনিস।”
তবে ছোট
ছোট প্রবন্ধগুলোকে দেখে মায়া লাগল। দেবী দূর্গা একাধিকবার বধ করেছিলেন মহিষাষুরকে,
কিম্বা অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়রী সম্পর্কে নতুন করে জানানোর কিছু আছে কি? এখনাকার
বাচ্চারা কি জানে না ভ্যাম্পায়ার ব্যাট সম্পর্কে? এক থেকে দেড় পেজের ছোট ছোট
প্রবন্ধে কৌতুহল তৈরী হওয়ার আগেই ফুরিয়ে যায়! খেলার ইতিহাসে নতুনত্ব আছে, কিন্তু
কত ছোট্টর মধ্যে শেষ! আবার মশাদের সাতকাহন বা জুল ভের্নের অপ্রকাশিত বইয়ের কথা পড়ার
সময় মনে হয় যে, হ্যাঁ... একটু নতুন কিছু জানলাম বৈ কি!
গোগোলকে নিয়ে কমিক্স বেরিয়েছে
‘সোনালী পাড়ের রহস্য’। সত্যি কথা বলতে, পাঠিকা হিসাবে যে কোন লেখা পড়ার আগেই ‘ভুল
ধরব’ এই মনোভাব নিয়ে বসি না। তাই কি কেউ বসে? কিন্তু, এই কমিক্সটা পড়তে পড়তে মনে
হচ্ছিল, একটাই খেলা এটার সাথে খেলা যায়, সেটা হল একটা ঠিকঠাক ছবির ফ্রেম নির্ণয়
করা। আমার তো একটাও চোখে পড়ল না। শুধু তাই নয়। লেখক যদি একটু পুরী ঘুরে স্টাডি করে
আসতেন, এবং এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে এটার স্টোরি বোর্ডিং করতেন, আমার মনে হয় ভাল
হত। সামনের বছরেই তো আবার গোগোল কমিকস একটা বেরবে। তাহলে এখন থেকেই একটা গল্প বেশ
একটু ভালভাবে ফিনিশ করার মানসিকতা থাকবে না কেন?
এরকটা কথা মনে হয় মাঝে মাঝে, বেশ
কয়েক বছর ধরে সত্যজিৎ রায়, বা সমরেশ বসুর লেখা নিয়ে কমিক্স করে পূজাবার্ষিকী
চালাতে হচ্ছে। হয়তো কিছুদিন পরে কাকাবাবু, মিতিনমাসী বা শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে
সিরিজে ঢুকব। এইভাবেই কি কপি করে করে চলতে হবে আমাদের? আমরা মার্ভেল বা ডিসি
কমিক্স ভাবতে পারব না, জাপানী মাঙ্গা কমিক্সও বানাতে পারব না। এতটাই অক্ষমতা
আমাদের। কিন্তু এইভাবে চেনা পরিচিত গল্প নিয়ে কমিকস বানালে ছোটদের কি খুব ভাল
লাগবে? যত দিন যাবে সময়ের আধুনিকীকরণের পাশাপাশি এইসমস্ত গল্প আরও অতীতের দিকে
এগোবে। সেটা কিন্তু আস্তে আস্তে শিশু পাঠক ছাড়াও আমাদের মতোন বুড়ো পাঠকদের কাছে
রেলিভেন্সী হারাবে। স্মৃতিচারণ বা মধুর অতীত রোমন্থনের উদ্দেশ্য ছাড়া এইসব
কমিক্সের কি খুব একটা চাহিদা থাকবে? কি জানি!
তবে সত্যি কথা বলতে, সুযোগ
বন্দ্যোপাধ্যেয়ের কমিক্সই একমাত্র মরুভূমির মরুদ্যান। তার আঁকা, লেখা আর গল্প গোছানো
– তিনতেই আমাকে মুগ্ধ করে, প্রতিবার। আমি কমিক্স যখন পড়ি, তখন সবার শেষে এই
কমিক্সটাই রাখি। জানি, আমায় খালি হাতে ফিরতে হবে না রাপ্পা রায়ের কাছ থেকে।
‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ একমাত্র এই কমিক্সের দৌলতেই হওয়া সম্ভব।
===========================
আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকী
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৪০/-
Comments
Post a Comment