বাবারা যেমন হয়...

 



কেমন হয়? বাবারা? মানে আমার আপনার বাবা তো সচিন তেন্ডুলকর কিম্বা অমিতাভ বচ্চন টাইপের লিজেন্ড কেউ নন, নিদেনপক্ষে লোকাল মস্তান বা থানার পুলিশ অফিসার ইন্‌ চার্জ-ও নন। আমার-আপনার বাবা এক্কেবারে দুধে-ভাতে থাকা, দশটা-পাঁচটার ডিউটি সেরে বাড়ী ফিরে প্রথমে ছেলেমেয়েদের দুটো-চারটে চড়-চাপড় মেরে, তারপরে খেয়েদেয়ে একটা ঢেকুর তুলে রাত দশটায় ঘুমাতে যাওয়া পাবলিক। মানে এক্কেবারে ছাপোষা গেরস্থ বাঙালী, যে কারো সাত-পাঁচে থাকে না।

       তবুও সেই বাবারও একটা জগত আছে, বেঁচে থাকার একটা তাগিদ আছে, প্রেম-অপ্রেম আছে, আর আছে ভবিষ্যতের আশা-আশঙ্কা নিয়ে লোকাল ট্রেনে আড্ডা দেওয়ার ক্ষমতা। ফলে, সে অর্থে, জাঁক করে জীবনী লেখার মতো উপাদান তাদের সন্তানাদির নেইও, থাকার কোন সম্ভবনাও নেই। সরকারী চাকরী হলে তেমন করে দেখানোর একটাই জিনিস থাকে, রিটায়ার করার পর পাওয়া একটা বাঁধানো হাতে-লেখা প্রশংসাপত্র, যা হয়তো, গত কয়েক বছরে ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়ে অর্থখরচ বাড়িয়েছে, খাটনি কমিয়েছে।

       আর, হয়তো আছে, কোন এক ছেলেবেলায় ফার্স্ট হওয়ার রেসাল্ট, অনেক যত্নে রাখা স্বত্ত্বেও যা মলিন, ছিন্নদশা; কিম্বা আছে, যুবক বয়সে অফিসে ফুটবল খেলে গোল করে ম্যান অফ দ্য ম্যাচের শংসাপত্র; অথবা আছে, নিজের অনভ্যস্ত হাতে বানানো মাটির পুতুল, তার মেয়ের খেলার জন্যে, স্মৃতি হয়ে; কিম্বা আছে, কবিতা বা আঁকা বা প্রবন্ধ বলে বা লিখে পাওয়া থার্ড প্রাইজ, যেটাতে, হয়তো প্রতিযোগীই ছিল তিনজন!

       সম্বল আছে, হয়তো, ছেলেবেলার প্রথম প্রেমে পড়ার স্মৃতি, যে স্মৃতির বালিকার মুখ এখন ঘষা কাঁচের মতোই অস্পষ্ট, এমনকি সেই প্রৌঢ়া বালিকা সামনে এসে দাঁড়ালেও যাকে চিনতে পারবেন না; কিম্বা আছে, যুবক বয়সে ঘন্টাখানেক হেঁটে স্টেশনে আসার দৈনিক লড়াইয়ের স্মৃতি, যে বাঁচানো পয়সা দিয়ে বান্ধবীকে তার বাবা-মায়ের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে নিয়ে সিনেমার সীটে পাশাপাশি বসে চিনেবাদাম খাওয়ার এডভেঞ্চার; অথবা, আছে, একটি চাকরীর জন্যে পায়ের জুতোর সোল ক্ষইয়ে ফেলা, টাইপ রাইটারের দোকানে ধর্না দেওয়া, এবং, অবশেষে উপায়ন্তর না দেখে পাড়াতেই একটা মুদিখানার দোকান খুলে ফেলার অভিজ্ঞতা; অতঃপর সেই পাড়ারই এক যুবতীকে দেখে আবার হৃদয়ের দুকুল ভাসিয়ে বিয়ে, অবশেষে সন্তান, শেষে বৃদ্ধত্বে এসে স্মৃতিবিজড়িত হয়ে থাকার মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্ব।

       সন্তানেরা এমন জনকের কথা বলবে কি করে? যিনি কপালগুণে লেখক বা লেখিকা হন সেই তারাও বা এমন জনকের কথা লিখবেন কি করে? দৈনিক আমজনতার মধ্যে মিশে থাকা বাবা, একটু বয়স হওয়ার সাথে সাথে নিরাপদ দূরত্ব রেখে সংসারে থাকা বাবা, এবং, পরবর্তীকালে বাইরে সেট্‌ল করা সন্তানের কাছে এমন আটপৌড়ে বিশেষত্বহীন বাবার কথা কি-ই বা বলা যায়? কিছুই না।

       তবুও বলা যায়। 

    “In Distinguished society, grief at the loss of a loved one is expressed by tears, silence and dignity.”


       এভাবেই শুরু করছেন Annie Ernox, তার 'A Man’s Place' বইতে। যে বই শুরু হয়েছে তার বাবা মারা যাওয়ার ঘটনার সাথে সাথে, “We slept in the only double bed, the one where my father had died.” এ থেকেই যেটা বোঝা যায়, তা হল, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা। যে বাবা পড়াশোনা করার সুযোগ পায় নি, তার মেয়েকে এবং পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল রাখতে তারই বাড়ীর নীচের তলায় একটা ক্যাফেটেরিয়া বসিয়ে জীবন ধারণ করলেন কোনরকমে, মেয়ে শিক্ষিকা হওয়ার প্রায় সাথে সাথেই যিনি চলে যান সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার বাইরের এক দেশে, সেই বাবার কথাই বলেছেন একশো পেজ জুড়ে। 

       মেয়ের সাথে কেমন ছিল তার সম্পর্ক? শীতলতায় তৈরী হওয়া সম্পর্ক শীতলতার মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে। অথচ তার মধ্যেই তৈরী হয়েছে মানসিক টানাপোড়েন। মানবিক চড়াই-উতরাই। স্নেহের দেওয়া-নেওয়া।

       এর মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে স্মৃতিচারণ। আমি আমার বাবার একটা অংশকে কোথাও খুঁজে পেলাম এই উপন্যাসে, যদিও, ছা-পোষা বাঙালী সরকারী চাকুরিরত বাবা আর ক্যাফেটেরিয়ায় টুকিটাকি খাবার বিক্রী করা ফ্রেঞ্চ বাবার মধ্যে খানিকটা পার্থক্য মানসিকতায়, খানিকটা স্নেহ-ভালোবাসায়, আর খানিকটা আশ্রয় হারানোর আশঙ্কায়...

       Annie Ernox, 1983 সালে লিখেছেন এই পিতৃজীবনী। যারা তার 'The Years' পড়েছেন, তারা যানেন, লেখার ঠিক কি ধরণের প্যাটার্নটায় তিনি স্বতন্ত্র। এই বইটাতে তার আভাস আছে। সে অর্থে বলতে হবে টাইপটা তিনি ধরতে পেরেছেন, গ্রিপ করতে পারেন নি। অর্থাৎ, পূর্ণতা পায় নি, কমপ্যাক্ট হয় নি। কিন্তু তাতে কি? তিনি যে নতুন কিছু একটা ধারাকে নিয়ে আসতে চলেছেন, তার কাটাছেঁড়ার ছাপ এই উপন্যাসে স্পষ্ট। বস্তুত, একজন বৈশিষ্ট্যহীন মানুষের কথা কোন ঘটনা ব্যতিরেকে টানা বলে যাওয়া --- বড়ই কঠিন। এবং সেটাই তিনি করার চেষ্টা করেছেন।


======================


A Man’s Place

Author: Annie Ernaux (France)

Translated by: Tania Leslie 

Seven Stories Press


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে