কপালের ফোঁটার জোরে...
বৃহষ্পতিবার। সকাল সকাল উঠে স্নান করেছি, শ্যাম্পু
দিয়ে, অনেক কষ্টে চুল শুকিয়ে ফুরফুরে করেছি। তারপর সুন্দর করে শাড়ী পড়েছি, যা পড়তে
চিরকালই আনন্দ বোধ করি, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নিজেকে অনেকবার ঘরের বড়ো আয়নার সামনে
দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছি। কানের পাশে একটা হলুদ গোলাপ, এভাবে একটা লোকাল ট্রেন্ড আনা
যায় কি না ভাবছি, আজ থেকে শুরু করলাম, বাংলাদেশের মেয়েরা যেমন চুলে ফুল গোঁজে আর
কি। কপালে একটা টিপ, চোখে আইলাইনার আর ঠোঁটে হাল্কা লিপস্টিক দিয়ে ভাবছি আর কিছু
বাকি আছে কি? কোন গন্ডগোল হচ্ছে না তো? অঞ্জন দা অনেকদিন বাদে আসবে আজ, তার সামনে বিব্রত
হবো না তো? আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখলে কেমন হয়?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে
আরেকবার একিয়ে বেঁকিয়ে দেখার আগেই দুটো ক্যাংড়া কিন্তু শক্তিশালী হাত আমার কোমড়
জড়িয়ে ধরল। আমি ‘আই হাই’ করার আগেই দেখলাম আমি একটু শূন্যে উঠে গেছি, এবং তারপর ওই
অবস্থাতেই ঘরের থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে এগোচ্ছি প্রায় ভেসে ভেসে, সেই ঘরটায়,
যেখানে আজ আমার অগ্নিপরীক্ষা।
অগ্নিপরীক্ষাই বটে। শুনতে পেলাম ভাই
গজর গজর করতে করতে বলছে, এদিকে আমাদের খিদেয় পেট চুই চুই করছে, আর ওদিকে উনি
হিরোইন সাজছেন। দু মিনিটের কাজ, তার জন্যে তোর এত আদিখ্যেতার কি আছে র্যা? আমি
বলতে গেলাম, আরে ছবি তুলব যে, একটু সাজুগুজু করব না? বলার আগেই শুনলাম, রান্নাঘরের
পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় শুনলাম, মা গজর গজর করছে, সকাল থেকে খেটে খেটে মরি আমি,
আর উনি কি না পটের বিবি সেজেই চলেছেন। লুচি বেলার একটা লোক পাই না... এদিকে গুষ্টির
রান্না পড়ে রয়েছে...
কাঙ্ক্ষিত ঠাকুরঘরে গিয়ে আমার
অধঃপতন হল। ভাই হাপাতে হাপাতে অঞ্জন দাকে বলল, নিয়ে এসেছি। বাপ রে বাপ! কি ওয়েট গো!
ওর বিয়েতে আমি পিঁড়ি ধরতে পারব না। কোমর ভেঙে যাবে। অঞ্জন দা হাসল। আমার দিকে তাকিয়ে
বলল, তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে রে!
লাগছে না? লাগবেই তো। আমি কি খুব খারাপ
দেখতে? মোটেই না। একটু সাজলে আমাকে মন্দ দেখায় না আমিও বুঝতে পারি, তবু মানতে পারি
না।
অঞ্জন দা প্রবাসী। অনেকদিন পর এদেশে
এসেছে। আর আমি রিতীমতো হুজ্জুতি করে বলেছি, এবার ফোঁটায় আমার বাড়ী আসতেই হবে, কোন আপত্তি
শুনতে চাই না। এখানে আসার আগে বাংলাদেশে গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্যে কাজের ফিকিরে।
ওখান থেকে আমার জন্যে কিছু এনেছি কি? না মনে হয়। এতটা আশা করা অনুচিত। যাই হোক, যা
আছে কপালে। আমার কাছে ভাইফোঁটা নেবে বহু বছর পর। ভাই ছাড়া আরেকজন ফোকলা বুড়ো আছেন,
সে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমার জন্নে কি কিনেছিস? বলেই ইতিউতি তাকাতে লাগলেন।
ও বাবা! এ যে সরাসরি দেনা-পাওনায়!
সাড়ে চার বছরের ছেলের এদিক নেই ওদিক আছে। দিদির ছেলে। কোন বোন নেই। আমার কাছে
ফোঁটা নেবে বলে বায়না ধরেছে দুদিন ধরে। এতএব, বাবার সাথে সেও বসে গেছে। জামাইবাবুও
আমার কাছে ফোঁটা নেয়। ফোঁটা নিয়ে অফিস যাবে। শালী না কি আধি ঘরওয়ালী। জামাইবাবু
দুঃখ করে, আমার রকম সকম দেখে তার সে আশা ঘুচে গেছে। তাই ভাইফোঁটাটা নাকি বুকে পাথর
দিয়েই প্রতি বছর নেয়। অঞ্জন দা’র কথার উত্তরে বলল, কার শালী দেখতে হবে তো। আহা! কি
কথা! পাশের প্যাকেটটা তো মোটাই লাগছে। কি আছে রে বাবা কে জানে!
এতএব, তিনজন ‘ভাইফোঁটা’ নিল, একজন
‘মাসীফোঁটা’ নিল। চারজনের থেকেই আমার অল্পবিস্তর লাভ হল। আমি খুব মুখরা। ফলে
প্রত্যেকেই জানে জামা-কাপড় দিয়ে দায় সারলে আর রক্ষে থাকবে না। ভাই খালি বলেছে, তোর
জন্যে বই কিনতে কিনতে ফতুর হয়ে গেছি। এতএব আমার কাছে কিচ্ছু আশা করবি না। যা দেব
মুখ বুজে নিয়ে নিবি। না নিলে ফেরত দিবি।
প্রত্যেককেই ফোঁটা দেওয়ার সময় বুক
ভরে যাচ্ছিল আনন্দে। কি একটা মধুর উৎসব। যেখানে মনে হয়, আমার কেউ আছে, যে সময়ে
অসময়ে কোথাও আমাকে দেখবে, বুঝবে। যার কাছে আমি Unwanted নই। যে আমাকে অসন্মান করবে
না, অন্ততঃ ভালো না বাসতে পারলেও। তাদের চোখে আমি নারী পরে, ভগিনী আগে। সেখানে আদর
আছে, আবদার আছে, খুনসুটিও আছে। কেবল মাসীফোঁটা যিনি নিলেন, তিনি আমার কোলে চড়ে
নিলেন, আর প্রণাম করার সময়ে বললেন, দুসসসস... ওকে কেন পণাম কোরবো? বাবাকে পণাম
করেছে, আমাকেও পণাম কববে। জামাইবাবুর কান গরম হয়ে গেল লজ্জায়।
উপহার যা পেলাম, তার ছবি দিলাম--- বই, বই, আর বই। অঞ্জন দা কথা রেখেছে। বাংলাদেশ থেকে দুটো বই এনেছে। অজান্তেই আমার অনেকদিনের স্বপ্ন পুরণ হয়েছে --- হুমায়ুন আহমেদ! শুভ্র সমগ্র! যে শুভ্রকে আমি চিনি না, জানি না। আর প্লেটো! রিপাওবলিক --- তাও বঙ্গানুবাদে! সোনায় সোহাগা। আর জামাইবাবু? দিলেন সুনীলের সেই বিখ্যাত কলকাতা ট্রিলজি! বললেন, তিনটে বই একটু পুরোনো এডিশন পেয়েছেন, ফলে একলপ্তে তিনটেই কিনে ফেলছেন। ভাই দিয়েছে লেডিজ ব্যাগ। অমন ব্যাগ একটা মনে মনে চাইছিলাম অনেক দিন ধরেই। টুকিটাকি বেশ কাজে লাগে।
আর বোনপো?
তিনি দিলেন পার্কার পেন... দেওয়ার পরেই ছিনিয়ে নিয়ে নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল ওই
পেন দিয়ে আমার গোফ আর দাড়ি আঁকবে। আমাকে নাকি দেখতে আরোও সুন্দর লাগবে! সব ইচ্ছা
না পূরণ হওয়াই ভাল।
এতএব বইয়ের লিস্ট নীচে দিলাম, ছবিসমেত------
১। শুভ্র সমগ্র – হুমায়ুন আহমেদ –
অনন্যা পাবলিকেশন – ৬০০/-
২। প্লেটোর রিপাবলিক – সরদার ফজলুল
করিম – মওলা ব্রাদার্স – ৪৫০/-
৩। সেই সময় – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় –
আনন্দ পাবলিশার্স – ৪০০/-
৪। প্রথম আলো - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
– আনন্দ পাবলিশার্স – ৬০০/-
৫। পূর্ব পশ্চিম - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
– আনন্দ পাবলিশার্স – ৫০০/-
Comments
Post a Comment