এবার কালী তোমায়...


আমাদের এদিককার সব কালী আজ জলে গেল। মানে যা বাকী ছিল আর কি। আজকে ভাইয়ের সাথে একটু বেরিয়েছিলাম বাজারে। রাস্তা দিয়ে একের পর এক কালীঠাকুর ভ্যানে চড়ে কাড়া-নাকাড়া আর ডিজে-র যুগলবন্দীতে নিকটবর্তী পুকুরের দিকে টলমল করতে করতে এগিয়ে চলছেন বটে, তবে একটা ব্যাপারে বেশ কয়েক দশকের অভিযোজন যেটা চোখে পড়েছে সেটা বলি।

       ভাসানে, যে কোন ক্লাবের ক্ষেত্রেই, গানের সাথে সাথে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল নাচ। সে এক তুমুল ব্যাপার। উৎপটাং নাচ দেখে মাঝে মাঝে নিজের শরীরটাই নেচে ওঠে। সে নাচের মহিমা কি বলা ভারী শক্ত। ছেলে-মেয়ে-বুড়ো-বুড়ি --- কারোরই নিরুৎসাহ নেই এই উদ্দাম আলপটকা নাচে। ছেলেরা নাচে জামা ঘুরিয়ে, কিম্বা না ঘুরিয়ে হরেকরকমবা টাইপে। আর মেয়েরা, সেটা যে ঠিক কি ধরনে নাচ তা বলা ভারি শক্ত। সব মেয়েই জন্মনাচিকা। তাদের প্রত্যেকেরই নাচে এক নিজস্ব স্বকীয়তার ছাপ থাকে। তা সে শাড়ি পড়েই হোক, কিম্বা সালোয়ার, কিম্বা টপ-জিন্স...

       আগে, বাবা-কাকাদের মুখে শুনেছিলাম, ভাসানের সময় ছেলেরা নাচত, মুর্তির ঠিক সামনে। ঢাক-ঢোল-কাঁসা বাজত। সিটি বাজত। আর মেয়েরা মুর্তির পেছন পেছন চোখের ভাষায় কিম্বা আপন শারীরী মূর্চ্ছনায় ছেলেদের নীরব উৎসাহ দিতে দিতে হেসে এলিয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে এগোত।

       পরবর্তীকালে দুতরফেই নাচের চ্যালেঞ্জ টাইপের ছুঁড়ে দেওয়া হল। দুই তরফেই নাচ শুরু হল। এদিকে এরা নাচে, তো ওদিকে ওরা। কে কাকে উৎসাহ দিত, কিম্বা কে কার থেকে উৎসাহ পেত --- জানি না।

আমার যখন চোখ ফুটল, তখন একটা পরিবর্তনের ঢেউ খেলে গেছে। নারী-পুরুষ সমান সমান ধরে নিয়ে মুর্তির সামনে ছেলে-মেয়ে উভয়েই একই সঙ্গে অক্লান্ত নেচে নেচে এগিয়ে গিয়ে মা-কে বিসর্জন দিয়ে আসতে শুরু করল। আমি নিজে দেখেছি এই যুগল কিম্বা গ্রুপ নৃত্য। বিস্মিত হয়েছি। অবশ্য এর কয়েকদিনের মধ্যেই শোনা যেতে লাগল অনেক কিছু। বিসর্জনের পর দেখা গেল, অনেক মেয়ে কিম্বা ছেলে তাদের অনেক কিছুই বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে। কারণ, আস্তে আস্তে নাচের অন্যান্য অনুসঙ্গ ছেলেমেয়েদের ঘিরে ঘিরে ধরছে। পাড়ায় ঢিঢিকার পরে গেলেও প্রগতির তাগিদে প্রগতিসংহার হল অবশেষে।

তার একটা বড়ো কারণ কিন্তু ছেলেরাই। মাদকতা এমনই যে সমস্ত পরিবেশকে নিজের অনুকূল মনে হয়। তা সে পৃথিবী হোক, কিম্বা নারী। এমন অনেক ঘটনা সামনে আসতে শুরু করল পরবর্তীকালে যে প্রমীলা বাহিনীকে নাচতে হলে খাঁড়া, কিম্বা নিদেনপক্ষে এক হাতে দাঁ নিয়ে না নাচলেই চলছিল না। কিন্তু ওভাবে কি নাচা যায়? আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন, যেদিন নিজের পাড়ার পূজোর ভাসানে আমার এক বান্ধবী ছেঁড়া জামা কোনরকমে সামলে সুমলে কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার বাড়ী এসে আমারই কাছে জামা ধার চাইতে চাইতে বলেছিল, তোর বাড়ি সামনে না পড়লে আর কোনদিন বোধহয় নিজের বাড়ী থেকেই আমার বেরোনো হত না।

সেই বান্ধবীটি নাচতে নাচতে ভুল করে, কিম্বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পুরুষ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। নেশায় উন্মত্ত পুরুষেরা তার জামা ধরে টানাটানি শুরু করেছিল সেই রাস্তাতেই, নাচের আনন্দে। কোনরকমে কয়েকজন বান্ধবী তাকে উদ্ধার করে, এবং ভীত সন্ত্রস্ত এই বান্ধবীটি আবিস্কার করে যে, তার জামা ছিঁড়ে গিয়েছে শুধু নয়, অন্তর্বাস দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট, এবং ঘাড়ে মোচড় লেগে গেছে একদল নৃত্যরত দস্যু ঠেকাতে গিয়ে। অবশেষে স্পষ্ট হয়ে গেল, পাড়ারই মেয়ে, পাড়াতেই আর নিরাপদ নেই। ঘটনাটা আমরা সেই কয়জন, মানে আমরা সবাই, চেপে গিয়েছিলাম। আজও কেউ জানে না।

       আজ, আবার দেখলাম, পট পরিবর্তন হয়েছে। আমি বেশ কয়েকবছর ভাসানের সময় রাস্তায় বের হই না। দূর থেকে ভাসানপার্টি আসছে দেখলে উলটোপথে কেটে পড়ি, বিশেষত কালীপূজো আমার কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। যে মা মানুষকে শুধুমাত্র প্রশ্রয় দেয় অবাধ স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচার করার, আমার জীবনে সেই মায়ের কোন অস্তিত্ব নেই। এমন ‘মা’ যেকোন সন্তানের পক্ষেই বিভীষিকা। এমন ‘মা’ উপকারের বদলে অপকারই বেশি করে। আমার মনে হয়, বাংলায় মাতৃপূজার নামে এত অনাচার আর কোন পূজায় হয় না।

       যা বলছিলাম, পট পরিবর্তন, দেখলাম, মুর্তির আগে আগে এবার প্রমীলা বাহিনী। সেই একই ঠাটের উদ্দাম নাচ। প্রত্যেকেই নিজস্ব তালে-লয়ে নাচছে। মুর্তির পেছনে সেই একই মাদকোউন্মাদ পুরুষপুঙ্গবেরা। জামা খুলে, কিম্বা না খুলে নাচছে, বা হাত-পা ছুঁড়ছে, ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না। কিন্তু এবারের পার্থক্য এই --- পুরো দলটাকেই, সামনে থেকে শেষ পর্যন্ত --- কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক শ্যোনদৃষ্টিতে পাহারা দিচ্ছে, বা হাতে হাত দিয়ে ব্যারিকেড করে রাখছে। আমার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। এ কেমন পূজো? যেখানে আনন্দের সময়েও সতর্ক প্রহরা রাখতে হয়, বিশেষত মেয়েদের, যাতে কোনরকম অশালীনতার মুখোমুখি তাদের না হতে হয়! এমন বিসর্জনের কি সত্যিই কোন প্রয়োজন আছে? কিম্বা এমন পূজোর?


       যাই হোক, মেয়েদের নাচতে দেখে আমারও শরীরটা নেচে নেচে উঠতে চাইছিল। নাচ বড়ো সংক্রামক। ভাইকে বললাম সেকথা। বাইকের মিরর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুখ বেঁকিয়ে বলে উঠল, থাক, আর নেচে কাজ নেই। তোর যা চেহারা! নাচতে শুরু করলে মাটি কাঁপবে। আর যা গায়ের রঙ তোর, চুল খুলে এসেছিস তার ওপর, কালীর বদলে ভুল করে তোকেই না ভাসান দিয়ে দেয়...

       কথা শেষ হতে না হতেই চটাস করে একটা আপন হস্তোদ্ধৃত চাটি ভাইয়ের মাথার পেছনে আছড়ে পড়ে তার ঘিলু নাড়িয়ে দিল।


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে