চুমু আর আদরের টোপ



একটা প্রশ্ন মাঝে মাঝেই আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? ‘সম্পর্ক’ না ‘কাজ’? ‘Relation’ না ‘Profession’? কোনটাকে মানুষ বেশি গুরুত্ব দেবে? ঋত্বিক ঘটক না কি বলেছিলেন, মানুষ থাকবে না, কিন্তু তার কাজটা থেকে যাবে। আবার মানুষ সামাজিক জীব। পরিবার ও সমাজের কারনে অনেক সম্ভবনা বিনষ্ট হয়েছে।

কেমন জানেন? এই অলোক কাকুর কথাই ধরুন না কেন। গতকাল সকালবেলায় রাস্তায় দেখা। আমার হাতে ‘দেশ’ পত্রিকাটাসদ্য পেয়েছি। কাকু বলল, “এইসব ম্যাগাজিন পড়ে সময় নষ্ট করিস কেন?” আমি একটু চমকে গেলাম। বললাম, কেন? হাতে ম্যাগাজিনটা নিয়ে একটু পাতা উল্টালো রাস্তার ধারেই, কোন তাড়া নেই যেন তার, অথচ যাচ্ছিল হন্তদন্ত হয়েতারপর বলল, চিঠির পূর্ণ পাঠ লিখেছেন বারিদবাবু। এটাকে একটু মিলিয়ে নিস। আমি বললাম, মেলাব কোথা থেকে? মাথায় আলগা চাটি মেরে বলে গেলেন, ভাবো ভাবোভাবা প্র্যাকটিস করো।

রাত্রে ঘুমাতে যাওয়ার ঠিক আগে মাথায় এল কাকু কি বলতে চাইছিলচিঠিপত্রের ১৮ নম্বর খন্ড! দেখলাম, আমার সংগ্রহে নেই। আউট অফ প্রিন্ট অনেকদিন ধরেই। কিন্তু তাতে আমার ভারী বয়েই গেল? PDF নিয়ে যতই গালাগাল করুক না কেন লোকে, আমি কোথাও এসব ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা পাই। ১৮ নম্বর খন্ডের পরিশিষ্টে রয়েছে লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়ের ৬৮টা চিঠি, অথচ, বারিদবাবু লিখছেন, “রবীন্দ্রভবন কর্তৃপক্ষকে লেডি রাণুর চিঠিটি দিতেই সযত্নে রাণুর প্রদত্ত চিঠিগুলি --- সংখ্যায় ৬৭ --- ফটোকপি করিয়ে দিলেন।” আমার একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল, অতনুকাকুর জন্য। এত পড়াশোনা, এমন ব্রেন, অথচ পরিবার-সামাজিকতা-দায়িত্ব পিছু ছাড়ে না।

      মজার ব্যাপার বলি, “মনে হয়েছে সমস্ত চিঠির ক্রম কালানুযায়ী নয়।” বারিদবাবু লিখছেন, অথচ পরিশিষ্টের সব চিঠিগুলো কালানুযায়ী সাজানো। তবে, বারিদবাবুর সাথে সংখ্যানুযায়ী মিলিয়ে দেখলাম, মিলছে না। বারিদবাবু চিঠিগুলি সাজিয়েছেন সম্ভবত নিজের মতন করে। যেমন, পত্রিকার ১৪ নম্বর চিঠি পত্রাবলীর ১৫ নম্বর চিঠি, পত্রিকার ২০ নম্বর চিঠি পত্রাবলীর ৫ নম্বর চিঠি, পত্রিকার ৪৫ নম্বর চিঠি পত্রাবলীর ২৩ নম্বর চিঠি। সেখানে লেখার পার্থক্য তো কিছুই বুঝলাম না। দুই জায়গাতেই একই চিঠি। কোথাও একটা লাইন বাদ নেই বা অতিরিক্ত নেই।

আর রইল বাকি ‘চুমু’ আর ‘আদর’, যা দিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকা বিজ্ঞাপন করেছে, এমনকি অনেক বছর আগে রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন তার কুখ্যাত উপন্যাসে, “আঠেরো বছরের রাণু লিখলেন তেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথকে, ... একদিন আমি তোমার সমস্ত আদর পেয়েছি।” ইত্যাদি ইত্যাদি, সেইসব আদর আর চুমু মূল পত্রাবলীতেও বাদ যায় নি। বিশ্বাস না হলে ২৩ থেকে ২৭ কিম্বা ৩০ থেকে ৫০ নম্বর চিঠিগুলোতে চোখ বুলিয়ে দেখুন। এদিকে বারিদবাবু লিখেছেন, “যে পর্বে উভয়েই বাঁধনছাড়া মন্তব্য করেছেন --- সেই পর্বের চিঠিগুলি ঘটনাক্রমে আমাদের সংকলনে স্থান পায়নি।” ভয় পাইয়ে দিলেন স্যার আপনি! সত্যিটা তাহলে কি? চিঠিপত্রের সংকলনেও কি তাহলে বাদ আছে? আমার মনে হয়, যদি তেমনই আপত্তিকর থাকত, তাহলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষই আপনাকে দেখতে দিত না, কিম্বা লেডি রানু মুখোপাধ্যায়ই আপনাকে অনুমতি দিতেন না। সত্যি কথা এই, চিঠি এমনই জিনিস, যে কারো হাতে এক্কেবারে প্রমাণসমেত দাখিল হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে তাকে লোপাট করে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। তবে এটাও ঠিক, কিছু কিছু চিঠিতে অনেক লাইন কেটে দিয়েছিলেন পত্রলেখক/লেখিকা। সেগুলোকেও ধরলে বড়ো মুশকিলকালির আঁচড়ে যাকে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে, তাকে টেনে বার করার কোন যুক্তি আছে কি? সেখানে ঠিক বোঝার চাইতে ভুল বোঝার সম্ভবনাই যে বেশি। ফ্রয়েড আর কজন জন্মায়? যে কারনে কাদম্বরী দেবীর লেখা মহর্ষির আদেশে বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল বলে আমরা শুনতে পাই।

যেকটি চিঠিপত্র বারিদবাবু দিয়েছেন, তা না কি পূর্ণ পাঠ! তিনি বলছেন, “হুবহু প্রতিলিপি কোনও লেখায় পাই নি।” প্রশান্তকুমার পালের ‘রবিজীবনী’তে আংশিক প্রকাশিত। পত্রধারায় প্রকাশিত চিঠিগুলি রবীন্দ্রনাথের এবং স্বয়ং কবিকর্তৃক সম্পাদিত। যা পরবর্তীকালে ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ নামে প্রকাশিত। সেখানে ৫৯ খানা চিঠি থাকলেও চিঠিপত্রের ১৮ নম্বর খন্ডে কিন্তু মোট ২০৮ খানা চিঠি প্রকাশিত।

আনন্দ কর্তৃপক্ষ লিখছেন, “ভানুদাদা-কে লেখা রাণুর চিঠিপত্রের পূর্ণাঙ্গ পাঠ সেভাবে সামনে আসেনি। ... এই প্রথম পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হল” এবার কর্তৃপক্ষের কেউ বা বারিদবরণবাবু কি বলতে পারেন, কোথায় কোথায় পার্থক্য আছে? মানে কি বাদ আছে পত্রাবলীতে, যা এখানে স্থান পেয়েছে? আমি তো খুঁজে পেলাম না তেমন। পাঠকেরা কেউ যদি পান তাহলে দয়া করে এ অভাগিনীকে জানাবেন

চুমু আর আদরের চক্করে এই সংখ্যা অনেক বিক্রী হবে ঠিকই, কিন্তু আসলেই কোথাও একটা বড়ো গোলকধাঁধাঁয় পড়ে গেলাম আমি। একটা কথা মনে হয় আমার, অনেকেই দেখলাম দেশের এই বিজ্ঞাপনে কমেন্টস করেছেন যার মূল বক্তব্য, এ সবই বিক্রী বাড়ানোর ধান্দা। অর্থাৎ, এ ম্যাগাজিন বিক্রী হবে। মানে এ ধরণের রসালো গসিপ পড়ার পাঠকের সংখ্যা নেহাত মন্দ নয়। কারো ‘সম্পর্ক’ নিয়ে এত মাথা না ঘামিয়ে যদি ‘কাজ’ নিয়ে মাথা ঘামানো যেত তাহলে কিন্তু আখেরে আমরাই ঋদ্ধ হতাম। রাণু, মৃণালিনী, কাদম্বরী, ভিক্টোরিয়া কিম্বা রানী মহলানবিশ --- এদের সাথে তার কিরকম রহস্যঘন সম্পর্ক ছিল, তার থেকে অনেক বেশি গবেষণা হওয়া উচিৎ ছিল ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধগুচ্ছ, কিম্বা ‘গল্পগুচ্ছ’ কিম্বা ‘বলাকা’, ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থ নিয়ে, কিম্বা তার আরও অনেক অনেক কাজ নিয়ে। তা কিন্তু হয় না। মানে আমার খুব একটা চোখে পড়ে না। এ এক দুর্ভাগ্যই বটে।

 

========================

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা

দেশ পত্রিকা

২ অক্টোবর ২০২২

মুদ্রিত মূল্যঃ ৩৫টাকা

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে