সলমন রুশদির হাত ধরে

 


সলমন রুশদিকে ছুরিকাঘাত করা হয় অগাস্ট মাসের বারো তারিখে। বলাই বাহুল্য, বাকি সময়টা মিডিয়ার দাপটে আমরা খুঁটিনাটির থেকেও যদি বেশি কিছু থেকে থাকে, তা জেনে গেছি। আর অনুমান করে নিয়েছি, ম্যাগাজিন বা মিডিয়া জগতের পরবর্তী প্রচ্ছদশীর্ষে অবশ্যই এই ব্যক্তিটিই থাকবেন।

তবে, তাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরাটা অত সহজ নয়। বিশেষত যিনি ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর লেখক। আমাদের দেশেও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা বর্তমানে চোখে পড়ার মতন। পাড়া-বেপাড়ায় ‘বয়কট’ কালচারই বলুন, কিম্বা সোশাল মিডিয়ায় মুণ্ডপাত করাই বলুন, সবকিছুতেই জনসাধারণের উন্মত্ততা চোখে পড়ার মতন।

এমতাবস্থায়, কৃত্তিবাসের এডিশনটা আশানুরূপই ছিল। তবে কৃত্তিবাস বলেই হয়তো আমি চমকে গেছি। প্রচ্ছদটা তো রীতিমতো ইন্টারন্যাশনাল মানের হয়েছে। সুদীপ দত্তকে ধন্যবাদ।

 

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমি ওনার একটা উপন্যাসও পড়িনি। তবে ওনার ‘রোববার লাইব্রেরী খোলা’ পড়েছি মনযোগ দিয়ে। বছরের পর বছর ধরে। দেখেছি, ওনার পড়াশোনার ক্ষেত্রের বিস্তৃতি সত্যিই প্রশংসনীয়। এবং কোন একটা বই, বা বিষয় সম্পর্কে ওনার মননশীলতা রীতিমতো উদাহরণযোগ্য। ‘রুদ্ধ কন্ঠের যুগযুগান্তর’ প্রবন্ধে উনি নিজেকে যথারীতি নিংড়ে দিয়েছেন। কি অগাধ পাণ্ডিত্য! চেতনার স্তর থেকে স্তরান্তরে গিয়ে তুলে এনেছেন একের পর এক লেখকের কথা। যীশু থেকে তসলিমা --- বিষয় একটাই --- যুগে যুগে রাষ্ট্র কীভাবে নবচিন্তনকে দমিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। প্রবন্ধটা সংগ্রহে রেখে দেওয়ার মতন।

অভিজিৎ দত্তের লেখাতেও একই সুর, সেন্সারশিপের ব্যর্থতা --- যুগে যুগে, কালে কালে। ‘বেলুনে দশ হাজার দিন’ চমকপ্রদ শিরোনাম, ভিতরে বলার মতো কথা একটাই লাগল, “এতদসত্ত্বেও কিন্তু সেন্সরশিপের প্রকল্প সফল হতে পারেনি। প্রাক্‌-মুদ্রণ অথবা পাণ্ডুলিপির যুগেই যদি এই অবস্থা, তাহলে মুদ্রণ-পরবর্তী যুগের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।

কিছু কিছু প্রবন্ধ হয় ধারালো তলোয়ারের মতো। আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করবেই, যতই উদাসীনতা নিয়ে পড়ুন না কেন। যেই মুহূর্তে প্রথম দুটো প্রবন্ধ পড়ে আপনার মনে সহানুভূতির জমজমাট ধারা নেমেছে, অংশুমান ভৌমিকের প্রবন্ধ ‘মিডনাইটস চিলড্রেন --- তাঁর পরিচিত উৎসমুখ’ এসে এক কোপে কেটে ফেলেছে সবকিছুকে। “পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক স্বাস্থ্য যত রুগ্‌ন হচ্ছে, তত ইংরাজীর ওপর নির্ভরতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ইংরাজী মাধ্যমে লেখাপড়া না শিখলে মোক্ষলাভ হওয়ার নয়, এটা যেন সবাই বুঝে গেছেন।” আসলে সলমন রুশদি’র উক্ত বইটা যে ভারতীয়দের ইংরাজীতে লেখার ঝোঁক বাড়িয়ে দিয়েছিল এবং সেখান থেকে একঝাক লেখকের বিশ্বমঞ্চে উঠে আসাটা যে আমাদের ভাষা সংষ্কৃতির ওপর একটা জোর আঘাত সেটাকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। একহাত নিয়েওছেন রুশদি’কে। লিখছেন, “সমকালকে তার পূর্ণ মাত্রায় চেনার জন্য একটা দূরত্ব লাগে। একটা নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব। ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’-এ তা ছিল না। সলমন রুশদি যা করেছিলেন তা হল সমকালকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেওয়া।” আমার মতে, এই মেগা কৃত্তিবাসের এই পর্বের সবচেয়ে শক্তিশালী লেখা এটি।

তবে, আমি সবথেকে ভয় পেয়েছি হামিম কামালের লেখাটাতে। “মানুষের কথা তো মানুষকেই ভাবতে হবে” শীর্ষক প্রবন্ধ। পড়ছি। আর আমার বুক ধড়াস ধড়াস করছে। বাংলাদেশের লেখক। অকুতোভয়। লিখছেন, “যে দেশে আমার বাস, বাংলাদেশ, সেখানে আমি দেখেছি, আমার মানুষদের শরীর কেমন রক্তাক্ত হয়েছে চিন্তার কারণে। চিন্তার জন্যে শরীরকে রক্তাক্ত করতে কত বড়ো নির্বুদ্ধিতার প্রয়োজন, তাই ভাবি।” আমি পড়ছি লেখাটা, আর ভাবছি, বাংলাদেশে কি কৃত্তিবাস উপলব্ধ? তবে আশার বিষয়, এ ধরণের ম্যাগাজিন লোকে কম পড়ে, প্রবন্ধ আরো কম, মন দিয়ে পড়ে আরও কম। হামিম ভাইয়ের জন্যে আমার প্রার্থনা, এমন সৎ ও সাহসী লেখার পুরষ্কার যেন কোন ধর্মান্ধ মানুষের হাত থেকে তাকে না পেতে হয়।

শানজিদ অর্ণব রুশদির গোটা তিনেক উপন্যাস নিয়ে লিখেছেন। আর রাহুল দাশগুপ্ত তার তুলনামূলক কম আলোচিত উপন্যাসগুলোকে, ছোট গল্পগুলোকে বা প্রবন্ধগুচ্ছগুলোকে নিয়ে সেগুলির পরিচয় করিয়েছেন। এনার লেখা পড়লে বোঝা যায়, রুশদিকে কি পরিমাণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন। লেখাটা নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ। কিন্তু তবুও, কোথাও যেন ছাড়া ছাড়া। এতগুলো বইয়ের ভীড়ে মূল সুরটা সম্পূর্ণ রূপ পায় নি। তবুও সলমন রুশদির লেখাকে জানতে এই প্রবন্ধদুটো বেশ কার্যকর। রূম্পা দাস ভট্টাচার্যের লেখাও যথাযথ।

আর সলমন রুশদির নিজের কথা? আছে বই কি। যেটা, আমার মতে, এই ম্যাগাজিনের ‘ক্রাউন’। ফেসবুকের ওয়াল থেকে উঠে আসা একটা ইন্টারভিউ। সেখানে একটা ইন্টারভিউ থেকে উঠে এসেছে লেখা নিয়ে তার চিন্তন। যেটা যে কোন লেখকের কাছে একটা ম্যানুয়াল হতে পারে। আমি যখন ইন্টারভিউটা শেষ করে বইটা বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে বসে আছি, তখনও মনে ভাসছে তার কথাগুলো –

সত্যিকার অর্থে আপনাকে জানতে হবে, কে আপনি? কোন জায়গাটি থেকে শুরু করতে চান? নিজের সঙ্গে এই বোঝাপড়াটি শেষ হলে আপনি নিজের পথটি খুঁজে পাবেন, আস্থা ও স্বচ্ছতাও খুঁজে পাবেন।

 

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]

==========================

কৃত্তিবাস ম্যাগাজিন

সেপ্টেম্বর ১, ২০২০

মুদ্রিত মূল্য – ৫০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে