শারদীয়া বর্তমান



লালন ফকির নিয়ে বাংলাদেশে প্রচুর কাজ হয়েছে, হচ্ছেও। আমাদের এদিকে ততটা নয় বলেই মনে হয়। শক্তিনাথ ঝাঁ’র বা এমন কয়েকজন হাতে গোনা মানুষের কথা বাদ দিলে প্রথম লালন ফকিরের ওপর লেখা উপন্যাস ‘মনের মানুষ’, লেখেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বেশিদিনের পুরোনো নয়, অন্তত লালনের সময়কালের নিরিখে।

সেই দিক থেকে বলতে গেলে মহাত্মা কবীরের অবস্থা আরও খারাপ। বাঙালী তাকে পাঠ্য বা চিন্তনের যোগ্য বলে মনে করে না। রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি প্রায় একশোটা কবিতা (Songs Of Kabir) ইংরাজীতে অনুবাদ করে বিশ্বের দরবারে পেশ করেন। ক্ষিতিমোহন সেনকে ঠেলে পাঠান দোঁহা সংগ্রহ করার জন্যে, সেই একটা বাংলা অনুবাদে কবীর হল বটে, তারপরে এখনও বাংলায় কবীর সম্পর্কে পড়তে হলে ওটাই সবেধন নীলমণি। আবার রবীন্দ্রনাথই হাজারিপ্রসাদ দ্বিবেদীকে দিয়ে শান্তিনিকেতনে বসিয়ে হিন্দীতে লেখালেন ‘কবীর’। বলা হয়, ওটা না কি কবীরের ওপর লেখা এক আখর গ্রন্থ। হিন্দী আগ্রসন নিয়ে আমাদের নাটুকে চীল চিৎকার আছে বটে, অথচ ওটার বাংলা অনুবাদ করার কোন গরজ কারো নেই। ফলে হয়ও নি। তবে হয়তো ছোটখাটো একধিক অনুবাদ হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে কবীরের রিসার্চের তুলনায় সিন্ধুতে বিন্দুসম।

এই হল কবীরজির অবস্থা আমাদের বঙ্গসমাজে। অথচ, তিনি যে জাতের, অর্থাৎ, ‘জোলা’, তা না কি “উত্তর পাঞ্জাব থেকে আরম্ভ করে অবিভক্ত বাংলার ঢাকা বিভাগ পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এঁদের বাস।” সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কথায়।

কবীরজির তত্ত্ব খুব খটোমটো কি? আমার কথা ছেড়ে দিন, বাংলায় ভক্তিরসের যে প্রভাব সেখানেও যেমন তার প্রভাব পড়া উচিৎ ছিল, তেমনি অদ্বৈত তত্ত্ব তথা বাউল তত্ত্বের আলোকেও ওনাকে বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ারও কথা ছিল না। কিন্তু, কোন এক অদ্ভুত কারনে বাঙালী তাকে বর্জন করল।

কবীরজির যে কয়টা দোঁহা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, তাতে করে বলতে পারি, আমার তাকে কোনদিন আবেগসর্বস্ব প্রাণপুরুষ বলে মনে হয় নি। বরং তীক্ষ্ণধী বুদ্ধির এবং হৃদয়ের আবিলতা বর্জিত এক প্রেমিক বলে মনে হয়েছে। এমন বলিষ্ঠ মনের সাধক সাধনার জগতে বিরল – সঞ্জীব বাবু বলছেন। আর তাই কি আমরা তাকে ভুলে গেলাম? কারণ রামপ্রসাদী গানে, কিম্বা বৈষ্ণব পদাবলীতে যে আত্মসমর্পণ করার কথা আছে, তা যে কেবল আবেগের কল্পনায় এক নিশ্চিন্ততার ফানুশ বই কিছু নয়, সাধারণ মানুষের আঙ্গিকে, সেটাও তো ভেবে দেখার বিষয়। সম্ভবত ঋষি অরবিন্দ বলতেন, সমর্পণ করার কথা বললেই আগে তোমরা নিজেদের সাধারণ বুদ্ধিকে সমর্পণ করে দাও কেন? সেইটাই কি কবীরজিকে বর্জন করার কারণ হল? কবীরজি তো কোনদিন সাধারণ বুদ্ধিকে ত্যাগ করার কথা বলেন নি, বরং সেইসব ক্ষেত্রে তিনি রীতিমতো বিদ্রোহী পুরুষ। সমাজকে পর্যন্ত ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলেন একটা সময়।

না কি শ্রীচৈতন্য, রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের মতো সেলিব্রিটির কারণে তিনি ঠাঁই পেলেন না! যেমন পেলেন না লালন ফকির, যেমন পেলেন না গুরু নানক, যেমন পেলেন না মৌলানা রুমি। কি জানি। কবীরজী সম্পর্কে আমরা এত উদাস কেন।

সঞ্জীব বাবু লিখলেন, “কবীরজি আপনি যে আমাদের বড়ো ভালোবাসার ধন। বড় স্পষ্ট, সময় সময় ক্ষুরের মতো ধারালো। কখনও মাখনের মতো স্নেহ জড়িত কোমল।” কথাটার দ্বিতীয় ভাগ সত্যি, কিন্তু প্রথম ভাগ বাঙালীদের তাকালে সত্যি বলে মনে হয় না।

সঞ্জীব বাবুর প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ। কবীরজিকে আমাদের সামনে আরেকবার তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ইন্টালেকচুয়াল এবং ভক্তির আবিলতার মিশ্রণ করতে গিয়ে তার হাতে যে বেশি তথ্য নেই, এটাও পাশাপাশি পরিস্কার। ফলে কবীরজিকে নিয়ে সরাসরি খুব বেশি লিখতে পারলেন না। মানে আরেকটা ‘মনের মানুষ’ হল না। লালন ফকির, গুরু নানক, রুমী, স্বামীজী, মায় রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত টেনে এনেছেন। তার গুরু রামানন্দ স্বামীর কথা বলেছেন চার পাতা জুড়ে। মোট কথা হাতে রসদ কম, কিন্তু লিখতে হবে আখ্যান --  এই ক্ষেত্রে যা হওয়ার তাই হল। কিন্তু নামটি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। কবীরের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না হোক, তার এসেন্সটাকে তো ধরা যেতেই পারে। তিনি পেরেওছেন তার মতো করে। সেখানেই লেখাটার সার্থকতা। কয়েকদিন বাদে, আমরা জানি, এটাও বই হয়ে বেরোবে, কিন্তু বঙ্গকুলে কলকে পাবে কি না কে জানে, পাওয়ার মতো অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আখ্যান তো আমার মনে হল না। না পেলে এমন এক বিপ্লবী, প্রেমিক চিন্তাবিদ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যাবেন।

 


এই প্রবন্ধটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল, এটা রাজনীতির ইতিহাস, না ঐতিহাসিক রাজনীতি?

মাত্র এক বছরের ইতিহাসের কথা, যার সাথে সাথে বদলে গেছে অনেক মানুষের ভাগ্যলিপি, তাও কারো কারো ক্ষেত্রে হয়তো একরাত্রের মধ্যেই। এমন এক ইতিহাস, যে ইতিহাসে রক্তপাত হয়েছে নদীর স্রোতের মতো। মানুষে মানুষে এমন বিভেদ, এমন নির্লজ্জ কদাকার হানাহানি, যতবারই পড়ি না কেন, যেভাবেই পড়ি না কেন, গলার কাছটা দলা পাকিয়েই ওঠে...

কিন্তু, তবুও, ড্যান ব্রাউন একটা কথা বলতেন, “By its very nature, history is always a one-sided account.”

      সমৃদ্ধ দত্ত-ও কি তার লেখায় কোথাও পক্ষপাত করেছেন? কোনদিককে আড়াল করেছেন? আমি জানি না। অত বড় ইতিহাসবিদ আমি নই।

তবে একটা কথা মানতেই হবে, এভাবে একটা ইতিহাসকে বিবৃত করা অত্যন্ত দক্ষতার কাজ, রামচন্দ্র গুহ’র পর, বহুদিন বাদে কারো এমন প্রবন্ধ আমার ভালো লাগল।

ঠিক-ভুলের বিচার বাকিরা যারা পড়বেন, তারা করবেন।




কিছু কিছু লেখকের আপাত সাধারণ লেখার মধ্যে এমন কিছু থাকে যা পাঠককে কৌতুহলী করে তোলে। পাঠকেরা খোঁজ নিতে শুরু করেন, উদ্দিষ্ট লেখকের আর কোন লেখা আছে কি না। পড়তে থাকেন। পড়তে পড়তে হয়তো তার ‘ফ্যান’ হয়ে পড়েন, অথবা হতাশায় সেই লেখকটিকে বর্জন করেন।

শারদীয়া অন্তরীপে রাজা ভট্টাচার্যের ‘নাছোড়বান্দা’ উপন্যাসটা আমার মোটের ওপর ভালোই লেগেছিল। তার লেখার একটা বড়ো আকর্ষণ সহজ সরল সাদামাটা গল্প বলা, এবং তার পাশাপাশি কিছু পাঞ্চলাইন। আমার দেওয়া রিভিউয়ের একটি কমেন্টসে জানতে পারলাম লেখক শারদীয়া বর্তমানে একটি পৌরাণিক আখ্যান লিখেছেন, এবং সেই লেখাটিও বেশ প্রশংসনীয়। এতএব, আবার এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করলাম, শারদীয়া বর্তমান হাতের কাছেই ছিল, আখ্যানটি একটানা পড়ে শেষ করে এই লেখাটা লিখছি।

আখ্যানটি বানরকুল মহারাণী তারাকে নিয়ে। ‘তারা’ সম্পর্কে মোটামুটি যা ধারণা আছে তা হল, অঙ্গদজননীটির রামায়ণের পটভূমিকায় কিছু কিছু অংশে বেশ প্রভাব ছিল, এবং ছিল বলেই পঞ্চকন্যার এক কন্যায় পরবর্তীকালে ভূষিত হয়েছিলেন। এই পঞ্চকন্যায় ‘সীতা’র স্থান নেই।

 

অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং মহাপাতক নাশনম্‌।।

 

এবার আসি রাজা ভট্টাচার্যের আখ্যানে। এখানে বানরজাতি বলতে দণ্ডকারণ্যের এক বিস্তৃত এলাকা জুড়ে থাকা আদিবাসীকে বলতে চাইছেন, যারা নিজেদের শৌর্য প্রদর্শন করতে বস্ত্রনির্মিত একটি লাঙ্গুল বা লেজ নিজেদের দেহের সাথে যুক্ত করে রাখেন। অনেকটা পাঞ্জাবীদের পাগড়ীর মতন ব্যাপারটা। চমৎকার চিন্তাধারা। কেবল সুব্রত মাজী যদি লেখাটা মন দিয়ে পড়তেন (“মনুষ্যচরিত্র এক আশ্চর্য ধাঁধা” // পৃ - 454) তাহলে অলংকরণে বানরদের ছবি এঁকে এই লেখাটার ‘যাত্রাভঙ্গ’ করতেন না।

      ‘তারা’ চরিত্র রাজা ভট্টাচার্যের চোখে কেমনভাবে প্রতিফলিত হয়েছে? প্রথমত, তারা অপূর্ব সূন্দরী --- “এক পরমাসুন্দরী যুবতী বসে আছেন বাতায়নের পার্শ্বে রক্ষিত উচ্চ আসনটিতে”। যিনি “কোপনস্বভাবা নন, কলহপরায়ণা নন; সাংসারিক বিষয়ে কদাচিৎ তিনি অনুপ্রবেশ করেন। এমনকি অধিকাংশ মহিষীর ন্যায় ‘সিংহাসনের পশ্চাতে প্রকৃত শক্তি’ হয়ে ওঠার চেষ্টাও কখনও করেননি তিনি।” অর্থাৎ, তিনি নিজের সীমা সম্পর্কে যথেষ্ট মাত্রায় ওয়াকিবহাল। এবং নিজের আত্মসন্মান সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন --- “তারা স্বভাবতই সম্বৃত স্বভাবের নারী।

      দ্বিতীয়ত, তারা’র চরিত্রের আরেকটি শেড, তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতায়। প্রশংসনীয়ভাবে তারা-গুপ্তচর কথোপকথন বা তারা-বালী কথোপকথনে তা ফুটে উঠেছে, অনেকটা দ্বিতীয়ার চাঁদের মতন। কিন্তু পূর্ণিমা হয়ে উঠতে পারে নি, কেন? পরে আসছি সে কথায়। মোট কথা, এই দুই কথোপকথন, যেখানে অবশেষে তারার কাছে পরিস্কার হয়ে যায়, “এ এক ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র, যার উদ্দেশ্য বালী।”, বেশ সাবলীল।

      তৃতীয়ত, তারা’র মধ্যে নারীসুলভ দ্বন্দ্ব এবং দ্বিধা আছে, সেটাও উঠে এসেছে। সেটা তার মনোজগতে ‘সুখী’ হওয়ার প্রকৃত পন্থা বা সেখান থেকে উদ্ভুত দ্বিধা, আবার রুমার সাথে তার শীতল সম্পর্কের টানাপোড়েন --- সবকিছুর মধ্যেই এই ভাব দেখা যায়।

      রাজা ভট্টাচার্য তার লেখায় এই সব বৈশিষ্টগুলোই চুম্বক চুম্বক এনে সৃষ্টি করেছেন তার ‘তারা’কে। মহাকাব্যে যারা একটু আবডালে থাকেন তাদেরকে সামনে পেশ করা, তার চরিত্রকে পুনর্গঠন করা বেশ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। রাজা ভট্টাচার্যের এই রূপায়ণের প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়।

 

      তবুও, আমার মতে রাজা ভট্টাচার্যের ‘তারা’ সবশেষে পঞ্চকন্যার এক কন্যা হয়ে ওঠে নি। রামায়ণের মতন এক মহাকাব্যিক আখ্যানে যিনি এই সন্মানটি পেয়েছেন, তাকে বালীর মৃত্যুর সাথে সাথে নির্বাপিত করে দেওয়া তার চরিত্রের প্রতি সুবিচার হল কি? ‘তারা’ এইটুকুতেই ‘তারা’ নন। তারা’র স্বাভিমান ফুটে ওঠে বালীর মৃত্যুর ঠিক পর থেকেই, যেখানে লেখক গল্পটাকে শেষ করেছেন।

      “তারা বিকল দেখি রঘুরায়া। দীন্‌হ গ্যান লীন্‌হী মায়া।।” রামচরিতমানসে রাম আর তারার সংবাদ যে চৌপাইগুলোতে আছে, আধ্যাত্ম রামায়ণেও যার উল্লেখ আছে, এমনকি অন্যান্য বেশ কিছু রামকথার আখ্যানে যেখানে তারার ব্যাকুল বিলাপে তারার অসহায়তা ফুতে ওঠে। রামের উজ্বলতার পাশপাশি তারার অসহায়তা --- যেটা তারাকে এক নারীতে রূপান্তরিত করে, রামের কৃপায় অবশেষে যার মোহমুদগর হয় সেই তারাকে এই উপন্যাসে পেলাম কই? কিম্বা বিলঙ্ক রামায়ণ বা কৃত্তিবাসী রামায়ণে তারা’র দেওয়া অভিশাপ, যেখানে তার শুদ্ধতা আর ব্যাক্তিত্বের মহান দ্যোতক হিসাবে রামের ওপর নেমে আসে, এবং রাম তা মাথা পেতে নেয়, তা তারা’র চরিত্রকে আরোও শক্তিশালী করে তোলে। সে শক্তি এখানে অনুপস্থিত।

      পেলাম না লক্ষ্মণ-তারা বাদ-বিবাদ, যেখানে তারা রাজনৈতিক পটভূমিকায় এক মহান দ্যুতী। সুগ্রীবের দীর্ঘসূত্রীতায় লক্ষ্মণের ক্রোধকে শান্ত করা, সেটাও সহজ কাজ নয়। “তারা সহিত জাই হমুমানা। চরন বন্দি প্রভু সুজস বখানা।।” রামচরিতমানসে এর বেশি আর দুটি মাত্র চৌপাই আছে। কিন্তু সমাজ তথা রাজত্বের ভারকেন্দ্রকে ঠিক রাখার যে রাজনীতি, তা তারা’র ভালমতোই জানা ছিল। এবং লঙ্কাকাণ্ডের সময় তাবৎ বানরসমাজকে হয়তো একা তারা-ই বেঁধে রেখেছিলেন একসূত্রে, যেখানে বিদেশ-বিভুঁই-এর এক যুদ্ধে সমাজের অনেক বানর আর ফিরে আসবে না।

 

      তো, সব মিলিয়ে, কেমন লাগল উপন্যাসটা? কি জানি। উপন্যাসটা পড়ার পর এই কথাগুলোই ভাবছিলাম। 

====================================

শারদীয়া বর্তমান

      মুদ্রিত মূল্যঃ ১০০/- 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে