আবার শারদীয়া কাণ্ড



একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা করে আনে।

এই লাইনটা মনে পড়ে? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। আর আমার জেমস বন্ডকে বললুম, একখানা শারদীয়া অনুবাদ পত্রিকা এনো তো, উনি আনলেন ছয়খানা অনুবাদ পত্রিকা, তাও আবার শারদীয়া!

জেমস বন্ড আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, বলল, কেমন লাগল সারপ্রাইজটা? তুই অনুবাদ পত্রিকা করে লাফাচ্ছিলিস, তোর কাছে তো এগুলো নেই। আমি নিয়ে এলাম কেবল তোরই জন্য। অনেক খুঁজেছি কেবল তোরই জন্য। অবশেষে পেয়েও গেছি। আরও আগেরগুলো পাওয়ার সম্ভবনা থাকলে এনে দেব। তবে এখন আর দিচ্ছি না। আপাতত এইগুলোই পড়।

       আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে মনে হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মিসেস জেমস বন্ডের কাছে গিয়ে কানভাঙানী দিয়ে মিস্টার জেমস বন্ডকে ঝ্যাটাপেটা খাওয়াই। কিম্বা তার গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলি, ওলে আমার বাবু লে, আমার কথা কত্তো ভাবে রে-এ-এ-এ-এ-এ..., বলে এক ঠাসিয়ে চড় মারি। কিন্তু আমি জানি এসব করেও কোনমতেই নিজেকে বাঁচাতে পারব না। ওদিকে আবার অরিত্রীর বাড়ীতে জেমস বন্ড আজ ভোরবেলায় শারদীয়া বর্তমান আর পাক্ষিক কৃত্তিবাস জমা করে দিয়েছে। ওগুলোকেও তো ছাড়াতে হবে! ঘরে এক নয়া পয়সাও নেই। এদিকে মায়ের রক্তচক্ষুকে এড়াতেও হবে, ওদিকে এগুলো পড়তেও হবে। আমি যে কি করি! বাবা গো! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে যে!

       জেমস বন্ড আমার মুখের অঙ্কট বঙ্কট বুঝতে পারল না। কিন্তু, তবুও, কি বুঝল কে জানে, আমায় বলল, টাকাটা তোর পরে দিলেও হবে। জানি এ মাসে অনেকগুলো কিনেছিস। আমার কোন তাড়া নেই। হ্যাঁ রে, এতগুলো বই কিনেছিস, সত্যি সত্যি পড়িস, না সাজিয়ে রাখিস? মানে অনেককে তো দেখি, বই কেনে, কিন্তু পড়ে না।

কি-ই-ই-ই-ই-ই-ই-ই.........!!! আমায় বই পড়ার খোঁটা! দেব না ব্যাটাকে একটা টাকাও। মুখে বললাম, ঐ আর কি।

জেমস বন্ড একটু ইতস্তত করে বললে, কাকীমা খুব বকে তোকে, না রে!

এই রে! হঠাৎ এরকম সুধাধারা ঢালছে কেন? বললাম, ইয়ে, মানে, ঐ আর কি...

“আসলে কি জানিস”, জেমস বন্ড উদাস মুখে বলল, “আমার পড়াশোনা করার শখ ছিল। পড়েওছিলাম তো খানিকটা। বাবা খবরের কাগজ বিক্রী করে আমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করছিলেন। গ্র্যাজুয়েশানটা হওয়ার পরে পরেই বাবা চলে গেলেন। সংসার কে টানবে? চাকরী কই?  এতএব, আমাকেও এই কাজে নেমে পড়তে হল। একে বোনটাকে পড়াতে হবে, তায় সংসার চালাতে হবে, আবার বিয়েও করে নিলাম হুট্‌ করে... আমার আর পড়া হল না রে। তাই তোকে দেখলে একটু হিংসেই হয় রে, তোর মাথার ওপর বাবা-মা আছেন। তারা তো আর সত্যি রাগ করেন না। মনে মনে হয়তো খুশিই হন, তোকে দেখাতে চান না...”

আমি একটু থতমত খেয়ে গেলাম। সত্যিই তো! জেমস বন্ডের সংসারিক বিপর্যয়টা আর সাধারণ মানুষের মতো হলেও তারও তো কিছু ইচ্ছা ছিল, শখ ছিল। সেখান থেকে সে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বটে, কিন্তু নিজেকে আহুতি দিয়েছে সংসারের হোমানলে।

“একটা কথা বলব?”

“কি? বলো না।”

“তোর থেকে আমি যদি বই ধার নিই, পড়তে দিবি? আসলে আমার দোকানে আগের মতো গল্পের বই আর বিক্রী হয় না। বই কেনা অনেক কমে গেছে। লাইব্রেরীটাও তো বন্ধ হয়ে গেল। তোরা মাত্র কয়েকজন কিনিস বটে কালেভদ্রে, কিন্তু বাকিদের বলতে পারি না, কেমন যেন বাধো বাধো লাগে। তোকে মনে হল বলা যায়। দিবি?”

“এ কি বলছ গো? তোমার যা বই ইচ্ছা হবে নেবে বই কি। আমার বাড়ীতে আসো না একদিন। আমি তোমাকে দেখাবো আমার কালেকশান। নিও যেটা ইচ্ছা। আমি আছি তো, পড়া আটকাবে না তোমার--”

 

অকারণে মানুষের চোখে যে কেন জল আসে। জেমস বন্ডের চোখের কোন চিকচিক। তার গমনপথের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমার চোখ ঝাপসা। আমার হাতে বইগুলো। না জানি কতটা পরিশ্রম করেছে এগুলো জোগাড় করতে! একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। আমি ঘরে ঢুকে আবার সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পেলাম।

দেখলাম, আগেরগুলোর তুলনায় এবারের শারদীয়াটা ধারে ভারে অনেক মোটাসোটা। আর সূচীপত্র দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। ‘প্রতিবেশী বাতায়নে’র কি সমারোহ! আস্ত একটা ভারতবর্ষ যেন এক জায়গায় এসেছে। ভারতেই কত ভাষায় কত মানুষ নিজের ভাব প্রকাশ করে --- গদ্যে কবিতায়! আবার এর সাথে আছে ‘এশিয়ার আয়নায়’ আছে মঙ্গোলিয়া থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম পর্যন্ত। সূচীপত্রের পাতায় তালিকার লাইন যেন শেষ হতে চায় না।

এর সাথে আছে ‘বিদেশের আয়নায়’। সেখানে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? এত কিছু একটাই পূজাবার্ষিকীতে? এত বিভিন্নতা! এর সাথে আছে প্রবন্ধ, নাটক, পত্রাবলী, নোবেল বক্তৃতা। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল কতটা চিন্তার প্রসারতা থাকলে শুধুমাত্র অনুবাদ দিয়ে ২৭২ পাতার এমন একটা পূজাবার্ষিকী বানানো যায়। তাও মাত্র ১৫০ টাকায়! বিতস্তা ঘোষাল অসাধ্য সাধন করেছেন।

উপন্যাস নেই? না নেই। বড়গল্প? একটা আছে বটে। কিন্তু তাতে কি? সবসময়ে যে গোলাপের সমারোহ হতেই হবে তার কি কোন মানে আছে? মাটির বুকের কাছে যে অসংখ্য জংলী ফুল হয় তার রূপের সমারোহের মাঝে চুপ করে বসে থাকলে বিশ্ববিধাতার বাঁশির আওয়াজ পাওয়া যায়। বইটা নাকের কাছে নিয়ে কাগজের ঘ্রাণ নিতে নিতে চোখ বুজে সেই আওয়াজের জন্যে কান পাতলাম।

 

       সন্ধ্যার দিকে ভাই ঘরে ঢুকল। হতচ্ছাড়াটার মতলবটা কি? আমার বইগুলোর দিকে নজর পড়েছে না কি? আমি কড়া গলায় বললাম, কি চাই?

ভাই শারদীয়া বর্তমান আর পাক্ষিক কৃত্তিবাসটা আমার বিছানায় রেখে দিয়ে বলল, “জেমস বন্ডকে শারদীয়াগুলোর টাকা আমি দিয়ে দিয়েছি। তোকে দিতে হবে না। অরিত্রীদির কাছ থেকে এগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম। আর হ্যাঁ, নীল কানের দুলটায় কিন্তু অরিত্রীদির থেকে তোকে বেশি মানায়। ওটা কিন্তু মনে করে ফিরিয়ে নিস।”

আমি হতবাক হয়ে দেখলাম, ভাই একটু মৃদু হেসে চলে গেল, আমার ঘরের দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিয়ে...

 

================================================

শারদীয়া অনুবাদ পত্রিকা – ১৫০/-

শারদীয়া বর্তমান – ১০০/-

পাক্ষিক কৃত্তিবাস – ৫০/-


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে