অন্তরীপ পূজাবার্ষিকী

 


এতদিন যখন আমি পূজাবার্ষিকীর লেখাগুলো পড়ছিলাম, কেন জানি না বারবার মনের মধ্যে প্রচণ্ড কলরোল চলত, মানে কেমন যেন আভাস হত। কলকাতার ব্যস্ত রাস্তার একধারে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত বসে থাকলে মনের মধ্যে যে অস্থিরতা তৈরী হয়, এক কলরোলের অস্থিরতা, তেমনটা, এবং তা বারংবার টের পেতাম। মনে হত, পূজাবার্ষিকীর ঝকঝকে পাতায়, চকচকে বিজ্ঞাপনের মাঝে এক অশান্ত কলরোলের যাঁতাকলে বন্দী আছে লেখক লেখিকাদের লেখনী। সেখানেই যেন পিষে যাচ্ছেন তারা, আর সেই পেষণযন্ত্র থেকে যে নির্যাস বেরিয়ে আসছে তা যেন কেবল বায়না করা, হিসেব করা, নিখুঁত কিন্তু কৃত্রিম, অশান্ত, অসম্পূর্ণ।

‘কবীশ্বরী’র প্রথম পর্বের প্রথম দশটি প্যারার মধ্যে সে কলরোল নেই। এক শান্ত নির্জনতা আমাকে যেন ঘিরে ধরল। মন নীরব হল। নাকে এল আঠারোশো সালের আশেপাশের বুনো গন্ধ। সেই গন্ধের সাথে সাথে রূপ আর রস মিলে স্পর্শ করল আমার মন।

অভীক মোহন দত্ত এই উপন্যাসটা সম্পূর্ণ করার পর কতবার কাটাছেঁড়া করেছেন জানি না, কিন্ত এটুকু স্পষ্ট বোঝা যায়, অন্তত মনের ভেতরে অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে। এবং সেই কাঁটাছেড়ার পর উপন্যাসটা এমন রূপ পরিগ্রহ করেছে তা হয়তো নিখুঁত নয়, কিন্তু পটভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস, যেন একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত।

এই উপন্যাসের দুটি ধাপ --- একটি সেই সময়ের গ্রামবাংলা, এবং অর্ধেক উপন্যাসের পরে এক পাতার মধ্যে ঘুরে যায় শহুরে কল্লোলিনী কলকাতায়। আর সেই সাথে এক লহমায় লেখক নির্মমভাবে বর্জন করেন গ্রামের বুনো গন্ধ, কলকাতার বেশ্যাপট্টির মধ্যে দিয়ে কবিয়ালের জগতের হাত ধরে তার লেখায় ঝরে পড়ে শহুরে কথকতার রঙ ও রূপ। এই দুটো ঘরানাকে সুন্দরভাবে ছেদ করেছেন অষ্টম পর্বে। আর সেই সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুঢ়ভাষাকে সুন্দরভাবে রূপদান করেছেন।

গল্প আমি বলব না, না, একদমই না। পল্লীগাঁয়ের দুর্দশা আর শহুরে দুর্দশার মাঝে দাড়িয়ে আছেন যে নারী সেই বিন্দুবাসিনী তথা যজ্ঞেশ্বরী --- তার দুটি রূপকে অনবদ্য ভঙ্গীমায় সাজিয়েছেন লেখক তার মায়াকলমে। একটি গ্রামের চপলবালা, আর আরেকটি শহুরে নেড়ি কবিয়াল। আর এই মায়াকলম তারাশঙ্করের মতোই গল্পের বাঁধুনিটাকে আঁটোসঁটো করে রাখেন। ফলে আগাগোড়া গল্পের টানবাঁধনে কোথাও ঢিলে পড়ে না।

রসভঙ্গ হয় বই কি। ‘নামগানে’ বা ‘চিতেন’ পর্যায়ের গানে যতটা দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায় ‘খেউড়’ গান ততটাই আবার আগুন ঝরায়। গ্রামের ঘটনার পর্যায়ে ‘ওয়াকিবহাল’ শব্দটা যেমন কানে বাজে, তেমনই শহুরে রাঁঢ়গিরিতে ‘ছয় পন্থা’র কথা বলে উপন্যাসকে সমৃদ্ধ করেন। বাক্যের গঠনের ভুলে (হতে পারে প্রিন্টিং মিস্টেক কিম্বা প্রুফ রিডিং-এ গন্ডগোল। উদাঃ পৃ - ২৮, ৩১, ৩৩, ৪৯, ৫২ ইত্যাদি) যতটা চোখ কটকট করে, কিছু কিছু বাক্যের গঠনের সৌন্দর্যে ততটাই মুগ্ধ হয়ে যেতে হয়।

 

“ব্যাটাছেলের দুনিয়া, মেয়েমানুষের তো কোনো দামই নেই এখানে। সব যখন জবরদস্তি করে নিয়েই নিচ্ছে, কলঙ্কই বা ফেলে রাখবে কেন আমাদের জন্য?” কিম্বা, “জোড়া জোড়া চোখ বিন্দুর বারোবছুরে পিঠটায় এসে বিঁধছে।” কি সাংঘাতিক লাইন! শহরে কিম্বা গ্রামে, সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে এই দুটো লাইনে তৎকালীন মেয়েদের অসহ অবস্থার কথার যেন সমস্তটাই বলা হয়ে যায়।

 

তবে তুলনামূলক গ্রামের আবহের বর্ণনায় যে মুন্সীয়ানা পাওয়া যায়, শহুরে কলকাতার রূপ বর্ণনায় একটু কাঠখোট্টা ঠেকে আমার চোখে। আবার পর্বগুলোকে যে দক্ষতায় ভেঙেছেন, যে হিসেবমতো আলাদা করেছেন, তাতে বেশ বিস্মিতই হই। সেখানে অনেক পরিশ্রমের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লেখার কোথাও কোথাও বিশেষ করে দশম পর্বের পরে একাদশ পর্বে গল্পের গতিময়তায় হুট করে তাল কেটে যায়, কিন্তু সেটাকে সামলে নিয়ে সপ্তদশ পর্ব পর্যন্ত যে এত সুন্দরভাবে এগোবে তা এক কথায় অভাবনীয়।

পরিশেষে বলি, রাজা রামমোহন রায়ের শতবর্ষে অনেকেই শ্রদ্ধাঞ্জলী দিয়েছেন। এই উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তাকে যে নমন জানানো হয়েছে আমার কাছে তা অভিনব, সুন্দর, সার্থক।

 

বিঃ দ্রঃ --- আমার এক বন্ধু বললেন, টুকটাক লিখলেও এটাই সম্ভবত ওনার প্রথম উপন্যাস। কারণবারি এবং পড়াশোনা দুটোই প্রচুর পরিমাণে করেন। বলা বাহুল্য, দ্বিতীয়টির প্রভাব উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। এবং এটির নির্মাণের পিছনের পরিশ্রমও অনেকটাই সফল। আমার অনেক অনেক অভিনন্দন লেখককে।




শুনেছি রাহুল দ্রাবিড়কে বল করতে একদম ইচ্ছা করত না শোয়েব আখতারের। স্টিভ ওয়া বলতেন, আধঘন্টার মধ্যে যদি ওকে আউট করতে পারো তো ভালো, না হলে ওকে বাদ দিয়ে বাকিদের আউট করো।

কৌশিক মজুমদারের ‘ভস্মবহ্নি’ সেই প্রকারের। উপক্রমণিকা পড়ে মনে হল মার্ভেল মুভিজের সিনেমার শুরু, একটু চমকানোর চেষ্টা। তারপর প্রথম পরিচ্ছেদের পুরোটাই, যখন লেখক গল্পটা গোছাচ্ছেন, একটু ঢিমে তেতালা। তারপর দারোগাবাবু ঢুকলেন, তারিণী রায় ঢুকলেন, টুকটাক দুই-তিন রান, আর তারপরেই ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ থেকে চার, শেষের দিকে তুমুল পেটাপেটি, থুড়ি সাসপেন্সের জয়জয়াকার।

কৌশিকবাবু জানেন, গল্প কিভাবে বলতে হয়। বিশেষ করে যে গল্পটা ১৮৯৮ সালের ডিসেম্বরে ঘটাচ্ছেন। সেই পুরাতন সময়ের পুরাতন জগতে রহস্যের এমন ঠাস বুনোট --- সহজ কথা নয়। এক্ষেত্রে চমক রাখতে হয়, রেখেছেন; দমক রাখতে হয় পরিবেশনায়, সুন্দর লাগল রিপ্রেসেন্টেশানে। চমকে গেলাম, যখন দেখলাম অলংকরণেই রেখেছেন সেই সময়ের ফন্টের (Font) প্যাটার্নে নিউজ পেপারে প্রকাশিত একটুকরো প্রতিবেদন, এমনকি সেই সময়ের ইংরাজী ভাষাতেই! রেখেছেন ম্যাপ, রেখেছেন জবানবন্দীগুলোর মধ্যেই খোঁচ, অর্থাৎ আপনি পড়তে পড়তে ম্যাপ ঘাঁটবেন, জবানবন্দীর পাতাগুলো আগেপিছে করবেন, নিজেই কখন খুনী খুঁজতে বসবেন, খেয়াল থাকবে না। রহস্য গল্প তো এমনই হওয়া উচিৎ। তা বলে এমন রিপ্রেশেন্টেশান কি এই প্রথম? উঁহু! তবে উপন্যাসটাকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে এই পরিবেশন।  

আর সাথে রঞ্জন দত্তের অলংকরণ। বিশেষত প্রচ্ছদ তো মারাত্মক চমকে দেওয়ার মতো বানিয়েছেন। ছবি দেখেই অর্ধেক আপনার কৌতুহল ঘুরে যাবে উপন্যাসে, সেই সাথে জীবনানন্দ দাশের ‘পিরামিড’-এর টুকরো। যদিও, টুকরোটা এই গল্পের আঙ্গিকে কতটা প্রযোজ্য, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, তবে ‘ভস্মবহ্নি’ শব্দটার উৎপত্তিগত কারণটা এখানে অবশ্যই বিদ্যমান। অর্থাৎ, বিরিয়ানী বানানোর যাবতীয় মশলা রেডী।

তা বানিয়েছেন বিরিয়ানী, খেলেছেন দ্রাবিড়ের মতোই। ধীরেসুস্থে আস্তে আস্তে জমাট বাধিয়েছেন উপন্যাসটাকে। প্রিয়নাথ দারোগা, কিম্বা তারিণী রায় --- যাকে যখন যতটা গুরুত্ব দেওয়ার দিয়েছেন। মনস্তত্বের অহেতুক টানহ্যাঁচড়ায় না গিয়ে সাসপেন্সের উথাল পাথালে ফেলেছেন। মনে হচ্ছিল যেন সিনেমা দেখছি। এবং সেই সাথে আছে বিস্তর পড়াশোনা। যেটা আমার খুব মনে ধরল। মানে, রহস্য গোয়েন্দা গল্পে লেখক গভীরভাবে মাথা খাটানোর উপকরণ দিলেন, মারণপন্থার গোলকধাঁধাঁয় ঘুরপাক খাওয়ালেন পাঠককূলকে। কেয়াবাৎ! অবশ্য ১৮৯৮ সালের পরিপ্রেক্ষিতে বেশি মানসিক জটিলতাটাও হয়তো বেমানান।

কৌশিক মজুমদার জানেন কিভাবে লিখতে হবে, যাতে করে পাঠককে ধরে রাখা যায়। ওই যে বললাম, প্রথম কয়েক পর্ব একটু ধরে পড়লেই বাকিটা আপনি এমনিই পড়বেন। আর সবচেয়ে বড়ো কথা, গোয়েন্দা আর দারোগার সাথে সাথে আপনিও ভাবতে বসবেন কে খুনী, বা কিভাবে খুনটা হল? তবে একদম শেষ পর্বে, মানে ‘উপসংহার’ পর্বে, আমার মনে হল, ‘পরোপকার’ খুনের একটি কারণ, এবং এই গল্পে ‘পরোপকার’ নামক যে বিষয়টি দেখানো হল, সেটাকে খুনের সমর্থনে এভাবে জাস্টিফাই করাটা কোথাও দুর্বল মানসিকতার। মানে গোয়েন্দা হয়তো আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন, সেই আবেগপ্রবণতায় গভীর রাত্রিবেলায় ‘সত্য সত্য’ করে দারোগার কাছে এসে ‘হাতে’ পড়বেন, আর মজার ব্যাপার, দারোগাও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন, মেনেও নেবেন, এটা কেমন যেন সনাতনী বাঙালী ‘সিরিয়াল’ প্রথার মধ্যে ঢুকে গেল।

অন্তরীপের দুটো উপন্যাসেই যেটা আমার খুব ভাল লাগল, তা হল পড়াশোনা। কৌশিকবাবু তো রীতিমতো লিস্ট ধরিয়ে দিয়েছেন। আপনার দুর্ভাগ্য, বাঙালী জাতটি আপনার এই উপন্যাসটা পড়ে খুব বাহবা দেবে বটে, কিন্তু ওই যে বইগুলো দিয়েছেন, খুব কম বাঙালীই উৎসাহিত হয়ে আপনার পথে হাটবেন। রহস্য গল্প পড়ে ঘুমানো যায়, কিন্তু রাত জেগে পড়াশোনা করা যায় না, তাতে অম্বলের প্রাদুর্ভাবটা বাড়ে।

কিন্তু তাতে কি? আপনার কাছে আমরা এই গভীরতাই আশা করব যতদিন আপনি লেখনী ধারণ করে থাকবেন।



আমি দেখেছি, ইদানীংকালে ঐতিহাসিক উপন্যাস বা গল্প লেখার একটা ট্রেন্ড চলছে। আমার নিজের ইতিহাস নিয়ে কৌতুহল আছে বলে আমি অনেক লেখা পড়েছি, আনন্দও পেয়েছি। কিন্তু, আমার একটা কথা মনে হয়, সুদূর অতীতকে নিয়ে লেখা যতটা সহজ, অদূর অতীতকে নিয়ে লেখা ততটাই কঠিন।

 

সূদূর অতীত = কম ডেটা + বেশি কল্পনা = লিখে সুখ, পড়ে সুখ

অদূর অতীত = অনেক বেশি ডেটা + কম কল্পনা / কষ্টকল্পনা = উতুঙ্গ বিতর্কের সমূহ সম্ভবনা

বঙ্গসমাজে রাজনীতি নিয়ে অতি সাধারণ মানুষও অনেক বেশি সচেতন হওয়াতে নিকটাতীত ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা আরও চ্যালেঞ্জিং।

 

আর সেই চ্যালেঞ্জটাই নেওয়ার চেষ্টা করেছেন পার্থ দে। যে উপন্যাসটা শুরুই হচ্ছে ১৯৪৬–এর ডিসেম্বর থেকে, এবং যেখানে বিষয়বস্তুটাই হল ‘দেশবিভাগ এবং উদ্বাস্তু সমস্যা’, সেখানে একটা আবেগকে ছাপিয়ে গিয়ে ব্যালান্সড উপন্যাস লেখা খুব কঠিন।

পার্থ দে-র উপন্যাসে জয়কালী ভট্টাচার্য নির্মিত একটি মুদিখানার দোকানকে কেন্দ্র করে শুরু এই উপন্যাস শেষ হচ্ছে ১৯৫৯ সালের মাঝমাঝি এক নিষ্ঠুর মধ্যরাত পেরিয়ে অনিকেত ব্রাহ্মমুহূর্তে। এখানে উপন্যাসটাতে যেমন বাঙাল পরিবারের মরণপন মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াই আছে, তেমনই ফল্গুধারার মতন কংগ্রেস-বামপন্থীর ‘টশন’ আছে।

প্রথমোক্ত ইতিহাসে, আবেগ আছে, উত্তেজনা আছে, আশা-আকাঙ্ক্ষার টানাপোড়েন আছে, ভালো আছে, মন্দ আছে; মুদিসদয়ের আটপৌরে বিবরণ আছে, কমিউনিস্ট শ্যালক আছে, কমিউনিস্ট হতে চাওয়া শিক্ষিত ও বিতাড়িত ‘বাপে খেদানো’ বড়োভাই আছে, প্রথমে বেবাক অশিক্ষিত এবং পরে ভবা পাগলার স্নেহচ্ছায়ায় থাকা লোভী ছোটছেলে আছে, দুঃখিনী নারী আছে, আর আছে চালাক, ফেরেব্বাজ, হর্তা-কর্তা-বিধাতা স্থানীয় পয়সাওয়ালা লোক। এরই মাঝে বোনা হয়েছে গল্পের জাল।

দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, নেহেরু আছে, বিধান চন্দ্র রায় আছে, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় আছে, জ্যোতি বসু আছে; আছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, আছে কালোবাজারি, খাদ্য আন্দোলন, আছে হিন্দু জাতপাতের বিভেদ আর আছে বেঙ্গল ল্যাম্পের ইতিহাস। এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি নিয়ে আমার কিছু বলার নেই, কারণ – মুর্খ মেয়েমানুষ। তবে রাজনীতিপ্রেমী মানুষ এই উপন্যাসটাকে পড়লে বুঝতে পারবেন, অনেক আলোচনার খোরাক আছে। কারণ বিবরণের পেছনে পড়াশোনার ছাপ আছে।

আর আছে সোমনাথ হোড়, বিখ্যাত চিত্রকর। পূর্বকথন জুড়ে আর পঞ্চম পর্বের শুরুতে --- এই দুইবার এসেছেন, কেন এসেছেন সেটাই ঠিক বোঝা গেল না। না এলেও পারতেন। ঐ আবহটাকে রচনা করার জন্যে শুধুমাত্র তাকে টানাটানি না করে নিখাদ আবহটার বর্ণনা করলেও ক্ষতি কিছু হত না। মানে ভবা পাগলা থেকে শুরু করে জ্যোতি বসু পর্যন্ত --- যাদের এফেক্ট পুরো উপন্যাসটা জুড়ে পড়ছে, সেখানে এই চিত্রকরটি নেহাত নিরীহ গোবেচারার মতন শুরুতে ‘হুট’ এসেই ‘ফুট’ মিলিয়ে গেলেন, পাঠকের মনে কোন ছাপ না রেখে। অথচ সোমনাথ হোড় তৎকালীন সময়ের বিরাট বিস্ময়, অনেকটা জয়নুল অবেদিনের মতন।

আরেকটা প্রশ্নও তাড়া করে বেড়ায়, যে জয়কালী ভট্টাচার্য নিয়মিত যুগান্তর পত্রিকা পড়েন খুঁটিয়ে, দিনের শেষে বাপে-ছেলেতে বসে মুদিখানার কূট হিসেব করেন, চাল নিয়ে হাহাকারের যাতাকলে পড়ে ব্যবসায় মার খাওয়ার ভয়ে থাকেন, সততাই যার একমাত্র মূলধন, সেই তারই মনে হল না দশ বস্তা চাল এই হাহাকারের সময়ে আসে কি করে? কিম্বা রোজ এক অচেনা লোক এসে বস্তার পর বস্তা চাল অবলীলায় দিয়ে যায়! সারা উপন্যাসে যেখানে নিজের দোকান নিয়ে এত সতর্ক থাকলেন, শেষে এসে এতটা নিরুদ্ধ আবেগে উদাসীন হয়ে পড়াটা একটু বেমানান ঠেকল।   

 

উপন্যাসটা গড়্গড় করে পড়ার মতো। মানে আপনি যদি পড়তে চান, এই উপন্যাস বিরক্ত করবে না, বিস্মিত করবে। আর যাদের পূর্বপুরুষ উদ্বাস্তু হয়ে এসেছেন --- কলোনী জীবন যাপন করেছেন, লড়াই করে বড়ো হয়েছেন, তাদের মুখ থেকে ওপার আর এপার বাংলার গল্প শুনে বড়ো হয়েছেন, তাদের কাছে এ উপন্যাস কোথাও হৃদয়ে মোচড় দেবেই দেবে।

 



আমার দাদু আমার মা-মাসী কিম্বা দিদার ওপর রেগে গেলে বলতেন, মুর্খ মেয়েমানুষের বুদ্ধি আর কত হবে! পুরোটাই হাটুর নীচে। যদিও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাকে হার মানতে হত। কারণ, সাংসারিক খুটিনাটিতে দিদা কিম্বা মা-মাসীর কাছে প্রায়ই তিনি হারতেন, কিন্তু, তা স্বত্ত্বেও, তার বয়ান কোনদিনও বদল করেন নি।

কথাটা কেন বলছি? এই দেখুন না, অর্ক পৈতণ্ডী-র লেখা যেই শুরু হল, এক পাতা যেতে না যেতেই অমনি মাথায় ঘুরতে লাগল খুন-খারাপি সব প্রশ্ন। এই যেমন- গ্যাবন নামের একটা জায়গা থেকে ইন্টারন্যাশনাল কল হচ্ছে। কথোপকথন যত বাড়ছে, তত মনে হচ্ছে, এই রে! কত ডলার যাচ্ছে রে বাবা কলে? না কি এটা হোয়াটস অ্যাপে কল করেছে, না কি সিন্ধুদা প্রচণ্ড বড়লোক। কিম্বা, “এখানকার আবহাওয়া বা জঙ্গলের চরিত্র তাই আমাদের দেশের চেয়ে অন্যরকম। এখানকার জঙ্গল হল --- যাকে বলে রেইন ফরেস্ট।” পড়তে পড়তে মনে হল খটকা লাগছে। রেইন ফরেস্ট তো ভারতে আছে, একটা-দুটো নয়, তিন-তিনটে মেজর রেইন ফরেস্ট! তাহলে ‘অন্যরকম’ কীসের হিসাবে ভিত্তি করে হল? না কি...

দাদুর কথা তক্ষুনি তক্ষুনি মনে পড়ল। আমি মন দিয়ে আবার গল্প পড়তে লাগলাম। প্রথম দিককার কাহিনীর বুনোট ঠাস নয়। থমাস উইলকক্সের ডায়রীর প্রথম দিকটা খুবই বোরিং। বেনিটো কান্ট্রি থেকে শুরু হল চাপাচাপি লেখা, যাকে বলে ঠাস বুনোট। আস্তে আস্তে আমারই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। আবার একটা জায়গায় চিতাকে গুলী করল, মরল কি মরল না আভাস দিল না। জিম করবেট পড়ার যা অভিজ্ঞতা, তাতে আহত চিতা আরও মারাত্মক। এরা এলাকায় থাকল তো মহামারীর থেকেও ভয়ানক। তখন মনে হল, তাহলে হয়তো মরেই গেছে। আবার মনে হল, লিখল না কেন? মন উত্তর দিল, গল্পে এর উল্লেখের প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন এল, তাহলে চিতার গল্প ফাঁদার কি প্রয়োজন ছিল। উত্তর এল, ছিল ছিল, এটা উপন্যাস না? ধ্যাত তেরি কা! মনকে শাসন করা দরকার।

তারপর আবার ঠাস বুনোট। এমপেংগো, এনগুইল্লা, জিভ কাটা ফাং-মেয়ে, লুয়ান্ডা অভিযান টপাটপ পড়ে ফেললাম। গল্পের সাথে সাথে আমিও খুব চিন্তায়, কি হয়, কি হয়! সত্যিই এখানটায় লেখক বেশ টানটান উত্তেজনা ধরে রাখতে পেরেছেন। আর তারপরেই রোমহর্ষক কিছু না হয়ে হঠাৎ করেই অভিযানের পরিসমাপ্তি। যাকে মনে হয়েছিল ভয়ঙ্কর সুন্দর, সে হয়ে গেল ভীতুর ডিম। আর এখানেই অভিযানের মজা, হতাশ হওয়ারও মজা আছে বৈ কি। আমার তো বেশ ভাল লাগল।

কিন্তু, তারপরেই সিন্ধুদার হাস্যকর কমিক্স হয়ে গেল। যে যুক্তিতে রহস্যের পরিসমাপ্তি ঘটল তা কনভিন্সিং, মন্দ নয়; কিন্তু যেভাবে পরিসমাপ্তি ঘটল তা বেজায় হাস্যকর। এখন আমি ভাবছি, ‘ভাব’টা পড়ে আমার হাসি পেল, না কি ‘ভাব’-এর পেছনের ভাবটা পড়ে হাসি পেল।

যাই হোক, সব মিলিয়ে মন্দ নয়।

 

অর্ক পৈতণ্ডীকে চিনি কার্টুনিস্ট হিসাবে। আমার খুব প্রিয়। এবারে দেখলাম লেখনী হাতে। ঠিক বুঝতে পারছি না কি বলা উচিৎ। তার লেখার ইলাস্ট্রেশান করেছেন ওঙ্কানাথ ভট্টাচার্য। এক কথায় চমৎকার। তবে বুঝতে পারলাম না, যেটা প্রচ্ছদে যাওয়া উচিৎ ছিল সেটা কেন ভেতরের পাতায়? আমার মনে হল, এই ছবিটাই তো এই উপন্যাসের মধ্যমণি হওয়া উচিৎ ছিল। যাই হোক, আমি এই ছবিটাকেই নিলাম।

শেষ কথা --- অন্তরীপের প্রকাশক বড়ই রসিক। ‘অন্ধকারের পথ বেয়ে’ উপন্যাসটাতে ‘ভালো’ শব্দটার ওপরে যেভাবে যান্ত্রিক গোলোযোগ ঘটিয়েছেন, তাতে সন্দেহ হয়, তিনি উপন্যাসটার মধ্যেকার ‘ভালোত্ব’টাকে বোধহয় কিছুতেই মানতে পারেন নি। এমনকি ভালুকের ‘ভাল’-কেও ছেড়ে কথা বলেন নি! বাকি খুচখাচ শব্দ বিপর্যয়, যেমন ক্যালানি > ক্যাল কিম্বা আফ্রিকা ও অ্যাফ্রিকা ইত্যাদি ইত্যাদি...

সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম অ্যাডভেঞ্চার হল...




বাপ্পাদিত্য চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসের পর এই প্রথম কোন উপন্যাস মনে হল সমাজের এত কাছাকাছি। কাল রাত্রে উপন্যাসটা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল আমি অতিকথন কিছু পড়ছি না। আমি অতিকল্পিত কোন সত্ত্বাদের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছি না। অতীতের স্মৃতিচারণ, কিম্বা ‘এমন হলে কেমন হত’ টাইপের কিছু পড়ছি না।

রাজা ভট্টাচার্যের এই উপন্যাস ‘নাছোড়বান্দা’ দুটো সমান্তরাল সময়কে নিয়ে এগিয়েছে। একটি আজ থেকে কুড়ি বছর আগের সময়, (“কুড়ি বছর তো অনলেরও হল!”) যেখানে বুথ থেকে পয়সা দিয়ে ফোন করার রেওয়াজ ছিল, আর কুড়ি বছর পরের সময়, যা করোনা পরবর্তী নবপ্রজন্মের সামনের সংকট।

একজন স্কুলশিক্ষক, নাম অনল, তাকে কেন্দ্র করে সমান্তরালে তার অতীত এবং বর্তমানকে নিয়ে উপন্যাসটি এগিয়েছে। গ্রামের একটি স্কুলের অতীত আর বর্তমানের করোনা সংকট পরবর্তী ফারাক --- এটাই উপন্যাসের মূল বিষয়।

আসলে করোনার পরে সবচেয়ে যদি কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে, আমার মতে, তা হল শিক্ষাব্যবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীদের মানসিকতার পরিবর্তনের সাথে সাথে সমাজের স্তরে স্তরে এর প্রভাব পড়েছে এক-একরকমভাবে। আমাদের কি তা চোখে পড়েছে? যদি পড়ে থাকে তা হলে এমন একটা লেখা আমার চোখে পড়েনি কেন? রাজা ভট্টাচার্য যেভাবে সামনে নিয়ে এসেছেন সেভাবে আর কেউ এবেছেন কি? জানি বা। থাকলে বলবেন। কিম্বা থেকে থাকলে তা নিয়ে আলোচনা হয় নি কেন? আসলেই আমরা কিন্তু সত্যিকারের বাস্তব থেকে অনেকটাই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আর সেই কারণেই এবারের পূজোসংখ্যায় সাধারণ জনসমাজে যে সমস্ত মারাত্মক ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে গেছে, তা নিয়ে সাবধান করার মতো কোন বুদ্ধিজীবী বেঁচে নেই। সবাইকে করোনা গ্রাস করে নিয়েছে নিজের মতোন করে। সবাই চুপ।

রাজা ভট্টাচার্য কি তাই করেছেন? কিছুটা তো বটেই। সভ্যতার সংকট একবারই আসে না। ইতিহাস সাক্ষী, তা বার বার আসে, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোন। কত কি যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তার ইয়ত্তা নেই। এবারে সবচেয়ে বেশি যেটা ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে, তা হলে স্বাভাবিক মানবিক সত্ত্বা। তারই প্রতিফলন এই উপন্যাসে পড়েছে। আর সেটাই আমার ভাল লেগেছে।

বাকিটার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। গল্প ঢিলেঢালা। খুবই প্রেডিক্টেবল। বরং প্রেমের পরিণতিটা সাতের দশকের মানসিকতার মতন হয়ে গেছে কোথাও। নব্বইয়ের দশকের এন্টালির এক যুবকের পরিপ্রেক্ষিতে এমন গ্রাম্য প্রেমের পরিণতি একটু বেমানানই বটে, অন্তত এই গল্পের আঙ্গিকে। তবে উপন্যাসের কাঠামো লেখকের হাতে। মুচমুচে প্রেমে না ডুবিয়ে কয়েকটা মাত্র বাক্যে প্রত্যাশাকেও ছাপিয়ে গিয়ে এমন পরিণতি দেবেন ভাবি নি। আবার শেষ যে এভাবে করবেন, আমরা যারা বিশেষত প্রফুল্ল রায় পড়েছি, তাদের কাছেও খুবই স্বাভাবিক ঠেকবে।

রাজা ভট্টাচার্যের লেখায় একটা জিনিস বেশ চোখে পড়ে, তা হল, পাঞ্চলাইন। কিছু কিছু বাক্য সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো। আমি যথেষ্টই চমকেছি। উদাহরণ দেওয়া যাক কয়েকটা ---

 

১) ওই যে বললাম না, আমার মতে, করোনা ক্ষতি করেছে শিক্ষাব্যবস্থায়। উনি লিখলেন – “শিক্ষাব্যবস্থা নামক একটা প্রকাণ্ড ম্যামথ মরে গেছে আসলে। ওরা টের পায়নি কেউ।” আবার এই ব্যাপারটাকেই অন্যভাবে লিখছেন আরেক জায়গায়, “সার সার গাছগুলো একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে বোকার মতো। তাদের নিচে শূন্যতা। বোবা মাটি প্রতিবছর এইসময় কলকল করে কথা বলে ওঠে অজস্র রঙের ফুলে ফুলে। নেই। গতবছরের ফুলগাছগুলো শুকিয়ে আছে সেখানে। সামনের মস্ত মাঠটা জুড়ে বুক সমান উঁচু জঙ্গল।” সমস্ত বাক্যগুলোর মাঝখানে এই ‘নেই’ নামক একশব্দিক বাক্যটা কেমন মন বিহ্বল করে দেয়। ধাক্কা দিয়ে যায়। 

২) একজন মন খারাপ, কিম্বা হৃদয় হারানো, বা প্রথম প্রেমে পড়া মানুষটা নিজের ঘরে কেমনভাবে ফিরে যায়? সন্ধ্যার গাঢ় অন্ধকারে ফিরছে অনল। বুকের মধ্যে সুখের মতো ব্যাথা নিয়ে। লিখছেন লেখক, “রূপের সমুদ্দুর পার হয়ে দুলতে দুলতে চলেছে একটা জাহাজ। ফিরে যাচ্ছে একটা দশ বাই আটের খুপরির দিকে।” পড়তে পড়তে মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, আহা! 

৩) আমার এই লেখাটা শেষের পথে। আমার মনের মধ্যে অনুরণন হয়ে যাচ্ছে একটা বাক্য, এক অমোঘ মন গলানো বাক্য। কয়েকটা বাক্যের একেবারে শেষে আসছে। পুরোটাই বরং লিখি--- “কথা বলতে বলতে হাটে ওরা দুজন। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায় রাতচরা পাখি, জ্যোৎস্নার সমুদ্দুরে সাঁতার দেয় তালচোঁচ। মস্ত ডানা মেলে উড়ে যায় সাদা বক। একটা নীল শাড়ি যেন তার প্রকাণ্ড আঁচলের মায়া ছড়িয়ে দেয় চরাচরে।” প্রকৃতির বর্ণনার মধ্যে থেকে হঠাৎ করে এমন একটা মায়াবতী লাইন উঠে এসে আমায় ঘিরে ধরে। যখন ঘুমিয়ে পড়ি তখনও ঘিরে থাকে…

===========================

অন্তরীপ পূজাবার্ষিকী

মুদ্রিত মূল্যঃ ২৪০/-

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে