শারদীয়া অনুবাদ পত্রিকা

 


প্রতিবেশি বাতায়ন - গল্প


ছেলেবেলায় আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে ছিল, যে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবত। সে জানত, খেলাধুলায় কেউ তার সমকক্ষ নেই। লেখাপড়াতে উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিরা তার থেকে বেশি জানে বটে, তবে এ ক্লাসের কেউই তার মতন জানে না। সে নিজের মতো করে নিজের জগতেই কাটাত, যে জগতে কারো ঠাঁই নেই। ফলত আমার সেই সহপাঠীটি কারোরই সাথে স্থায়ী বন্ধুত্ব পাতাতে পারে নি। এবং মাধ্যমিক পাশ করার পরে সে যে কোথায় হারিয়ে গেছে, জানি না।

এখনকার বাংলা সাহিত্য পড়ার সময় আমার কেন জানি না বারবার ওই সহপাঠীর মুখটা আবছা আবছা মনে পড়ে। গত মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে টানা পড়ে যাচ্ছি আধুনিক কালের বাংলা সাহিত্যের লেখাপত্র। কিন্তু বারবার পড়া শেষে ঐ বন্ধুটার মুখ একবার ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

নিজের বাড়ীর দরজা-জানলা বন্ধ করে নিজের জাত্যাভিমান নিয়ে থাকলে এক ধরণের আত্মশ্লাঘা অনুভব করা যায় ঠিকই, কিন্তু প্রতিবেশির জানলা দিয়ে যে আনন্দের অন্যরূপ আমাদেরকেও বিমোহিত করতে পারে, তাদের রঙে নিজেকে রাঙালে নিজের কাছে নিজেকেই অন্যভাবে আবিষ্কার করা যেতে পারে, তা আমরা ভুলতে বসেছি।

অনুবাদ পত্রিকা এক্ষেত্রে চরম ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের পূজাবার্ষিকীর ‘প্রতিবেশি বাতায়ন’-এর সবকটি গল্প পড়ার পর আমি লিখতে বসেছি এক অন্যরকমের অনুভূতি নিয়ে। আমাদের ভারতবর্ষেই যে মানুষের মধ্যে এত রকমের চেতনার চড়াই-উতরাই আছে, তার সাথে যত পরিচিত হচ্ছিলাম, মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম।

এই যেমন মনোজকুমার গোস্বামীর লেখা ‘পরিচয়বিহীন’ গল্পটা। মূল গল্প অসমীয়া ভাষার। “পুলিশ থানার ভেতরে বহু সত্য মিথায় হয়ে যায়।” একই বাস্তব, কিন্তু কি তার প্রকাশ! পুলিশের চোখে সমাজ, এবং তাদের অস্তিত্বের সংগ্রামে যখন নিরীহ মানুষ বলি হয় --- “কী হবে এইসব মানুষের? কেন বেঁচে আছে ওরা? রাস্তার কুকুরের মতো, নর্দমার কীটের মতো অবাঞ্ছিত তুচ্ছ মানুষগুলি কোথা থেকে আসে?” এরই মাঝে থমকে যায় আমাদের মনুষ্যত্ব। কিম্বা ভাস্বতী বসুর ‘চোখ’! মূল গল্প ওড়িয়া। দু’পাতার ছোট্ট গল্প, মানুষের প্রতি মানুষের ক্ষুদ্র ব্যবহারের বেদনা --- কতটা অনুভূতিপ্রবণ হলে এভাবে লেখা যেতে পারে! আর শেষ লাইনটা কি বাস্তব! “কাউকে রূঢ় ভাবে কিছু বলতে গেলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঐ অন্যমনস্ক চোখ দুটি।” জি কুমারাপ্পার কন্নড় ভাষার ‘বোবা’ গল্পটা আরোও ভয়ঙ্কর। একটি বলদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কারোও বুক ফেটে যায়, তো কারো কারো বাড়ী উৎসব মুখরিত হয়ে ওঠে। একই সমাজের দুই বিপরীত চিত্রের সংঘর্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে মূক গৌড়া।

হরিকৃষ্ণ কৌলের কাশ্মিরী গল্প ‘বোকাদের বয়স বাড়ে না’ এক ব্যঙ্গকথা। দুই বন্ধু একই ক্লাসে থেকে যায় বছরের পর বছর। যেন সমাজের অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে তাদের বয়স স্থির। কিন্তু সমাজ এগিয়ে চলে। আর সুক্ষ্মভাবে তাদের এই অবুঝপনাকে ব্যবহারও করে। হিমানশি ইন্দুলাল সেহলাতের গুজরাটি গল্প ‘দরজা’ পড়তে পড়তে বুক হিম হয়ে যায়। যে মেয়েটা বাহ্যের জন্য একটা দরজাওয়ালা বাথরুম চেয়েছিল, সেই মেয়েটাই অবশেষে সেই বাথরুম পেল, তবে তা নিষিদ্ধ পল্লীতে।

এস কৃষ্ণমূর্তির তামিল গল্প ‘শিল্পী’ এক দ্বন্দ্বের গল্প। শিল্পীর কাছে শিল্প বড়ো না পাশের মানুষটা বড়ো? --- এই দ্বন্দ্ব চিরকাল ছিল, আছে, থাকবে। আর এই দ্বন্দ্বটাকেই অন্যরকম ভঙ্গিতে পেশ করেছেন তিনি। কয়েকটা লাইন দিই, কারণ আমাকে লাইনগুলো বড্ডো ভাবিয়েছে--- “জীবনের প্রতিস্তরে শিল্পের অধিকার নেই। বিশেষ বিশেষ স্তর ব্যতিরেকে। যখন এই জীবন ও শিল্পকে পাশাপাশি বসানো হবে একই মর্যাদায় তখন বাধবে বিরোধ। শিল্পী যখন তার শিল্পে মগ্ন থাকে সে ভুলে যায় যে, তার চারপাশে যারা আছে তারা রক্ত-মাংসের মানুষ। তখন সে শুধু তার শিল্পের খাতিরে যেটুকু সম্পর্ক তাদের সঙ্গে রাখা যায় সেটুকু করে, তার বেশি নয়। আসলে সত্যকে খুঁজি আমরা ক-জন? সবাই খোঁজার মিথ্যে ভান করেই বেড়াচ্ছি। আর এই মিথ্যের বেড়াজালই হচ্ছে শিল্পের সব থেকে বড়ো ট্র্যাজেডি।”

সানাটোম্বি নিঙ্গোমবাম মণীপুরী লেখিকা। তার লেখা ‘ইন্টারভিউ’ নারীদুর্গতির টানাপোড়েন। সমাজের ব্যঙ্গ ধেয়ে আসে প্রোটাগোনিস্টের স্বামীর মুখ দিয়ে, “সব রান্নাঘর থেকে যদি অধিকারের জন্য চিৎকার শুরু হয়, গোল্লায় যাবে দেশটা।” ঊষা কিরণ খানের মৈথিলী গল্প ‘ডুবধান’ এক নারীর তার গ্রামে ফিরে আসার গল্প। ফিরে এসে কি পায় সে? “সব হারানো জিনিসের জন্যে সে কাঁদছিল, এমনভাবে কাঁদছিল যেন আগামীকাল বলে কিছু নেই।”

যোশেফ আব্রাহামের কাব্যিক সুষমায় সুষমান্বিত মলায়লম গল্প ‘দগ্ধদহন’ আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। ঝড়-জলের রাতে আশ্রয় চাওয়া যুবক যখন সেই বাড়ীরই এক কিশোরীর সঙ্গে যৌনাচার করে অপরাধবোধে দগ্ধ হচ্ছিল তখন এমন এক নির্মম সত্য উঠে আসে (আমি অবশ্যই সেটা বলে রসভঙ্গ করব না) যে আমি পড়ার পরেও অনেকক্ষণ থ মেরে বসে থাকি। “এই আলো-ভরা সকাল রাতের চেয়েও ভয়ঙ্কর মনে হল।” কি লাইন! যোশেফ আব্রাহামকে যেন মনে হচ্ছিল ও হেনরি’র মলায়লম সংস্করণ! আর সবশেষে হিন্দী লেখিকা অলকা সরাওগির ‘বীজ’। এক অসুস্থা নারীর মনোজাগতিক টানাপোড়েন, এবং সেখান থেকে উত্তোরণ।

সব মিলিয়ে আমি যখন ছোট্ট ভারত ভ্রমণ করে ফিরে এলাম নিজের কুঞ্জে, মনে হল এই হাসিকান্নাগুলোর সাথে আমরা কেন আরও বেশি করে পরিচিত হচ্ছি না? লেখা মানে কি মস্তিষ্কের ব্যায়াম? আবেগের বিস্ফোরণ? না তো! আর তাই এই ‘অনুবাদ পত্রিকা’ অন্য সব শারদীয়া পত্রিকার চাইতে অনেক বেশি দামী মনে হয়। মনে হয়, এতদিন পরে ভারতভূমির অশ্রু-বেদনার সাথে নিজেকে খানিকটা হলেও যুক্ত করতে পারলাম।

===============================

অনুবাদ পত্রিকা

মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০/-

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে