ধ্যেত তেরি কা!
রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলতেন, গৃহিণীদের না কি একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি থাকে। যেখানে সে সব কিছুই একটু একটু করে জমিয়ে রাখে। সমুদ্রের ফেনা থেকে শুরু করে নীল বড়ি পর্যন্ত --- আমারও তেমনি একটা ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি, থুড়ি বাক্স আছে।
কাল সকাল
থেকেই আমার ডান চোখের পাতা কাঁপছিল। ঠাকুর হাঁচি-টিকটিকি মানতেন, আমারও কেন জানি
না, এই মৃদু কম্পনে প্রবল ভূকম্পনের আশঙ্কা হল। মন বলল, দ্যাক দিকিনি, ওই বাক্সতে
কি কি আছে।
তা দেখলাম, অনেক
হাবিজাবির মধ্যে একখান কড়কড়ে পাঁচশো টাকার নোট! এটা আবার এখানে কেন? মনে পড়ল না
কবে রেখেছিলাম। যাই হোক, সব দেখেশুনে আবার রেখে দিলাম যথাস্থানে।
পরদিন।
প্রাতঃকাল। আমি কফির মগ নিয়ে ব্যলকানীতে। চারপাশে বিড়াল ডাকছে, কুকুর ডাকছে, পাখী
ডাকছে, গরু ডাকছে, আর নীচে গেটের সামনে প্রবলভাবে হাত নাড়িয়ে ডাকছে – এই রে! জেমস
বন্ড! আবার কি হল!
আমি তো ঊর্ধশ্বাসে
একেবারে নীচে। রাধিকাও এত জোরে কৃষ্ণকে দেখলে দৌড়তেন কি না কে জানে, বোধহয় না। তার
তো আর প্রাণের আর মানের মায়া ছিল না, আমার আছে। কাছে গিয়েই দেখি... উরি শ্লা! এসব
কি জিনিস রে বাবা! একটা আনন্দবাজার পত্রিকার প্রবন্ধ ও কবিতার শতবর্ষ সংকলন, কি
পেল্লায় তার সাইজ রে বাবা! লুকোবো, সে কি আর আমার বাপের সাধ্যি! সাথে আরেকটু ছোট
কৃত্তিবাসের প্রাক পূজো সংখ্যা, এখানেও শেষ হয় নি, সাথে এই চুটকু রিডার্স
ডাইজেস্ট। একত্রে এই ত্রহ্যস্পর্শটা আমারই ডাইজেস্ট হচ্ছে না। সকালবেলা কার মুখ
দেখে উঠলাম রে বাবা! বোধহয় আয়নায় নিজের মুখই সবার আগে দেখেছি। জেমস বন্ড দেখছি
কিছুই ভোলে না। কবে যে অর্ডার দিয়েছিলাম, ভুলেই মেরে দিয়েছিলাম।
“এই দ্যাখ, প্রত্যেকটা
বই মনে করে দায়িত্ব নিয়ে তোর জন্যে এনেছি”।
“বেশ করেছ”,
আমি মনে মনে বলি, “এবার আমার ভাত-কাপড়ের দায়িত্বটাও নাও হে হতভাগা! জননীর চোখে
পড়লে যে কি হবে! সবচেয়ে বড়ো কথা, হাত পাতব কার কাছে! কি যে করি!” আমি দোতলার দিকে
তাকালাম, ব্যালকানী থেকে কি একটা মুখ সরে গেল? ওরে বাবা! আজ আমায় কে বাঁচাবে?
কিন্তু তার আগে এগুলোকে ছাড়াব কি করে!
হঠাৎ মনে পড়ল,
ন্যাতা-ক্যাতার হাঁড়ি!
সন্ধ্যেবেলা।
আবার সবাই ডাকছে। এবার কেমন একটা ক্লান্তির সুরে। আমি আবার কফির মগ হাতে বইগুলো
নিয়ে বসলাম। নিষিদ্ধ কাজ করছি মনে হচ্ছে। দরজায় ছিটকিনি দেওয়া। আমি প্রথম বইটা
হাতে নিলাম।
এটা বই! এটা
ম্যাগাজিন! আনন্দবাজারের কোন কি হুঁশ আছে। এ পড়তে গেলে তো আসন পিঁড়ি করে বসে পড়তে
হবে! না কি একশো বছর বয়সীদের কথা ভেবে বানানো। এখন তো ছেলে-ছোকরারা খুব একটা এইসব
ছাইপাঁশ পড়ে না, খালি গেলে। বইয়ের পেজ কোয়ালিটি থেকে শুরু করে বাঁধাই কোয়ালিটি,
কোনটাই মনঃপুত হল না। আমার মতন ভীম ভবানীর হাতে জরাসন্ধ না হয়ে যায়! প্রবন্ধ
সেকশানে সুনিতীবাবু থেকে মেঘনাদ --- সবাই আছেন। কবিতার সেকশানে জীবনানন্দের জয়জয়াকার।
কিছু কিছু কবির অনেক কবিতা --- রবি ঠাকুর থেকে সুনীল বাবু --- চমৎকার! কিন্তু যাই
করি না কেন, অতি সাবধানে পড়তে হবে। আর হ্যাঁ, বেশি পড়ার জো নেই। আমার মতন যারা
বুকের তলায় বালিশ দিয়ে উবদি খেয়ে বই পড়ে, কিম্বা সমর্পিতার মতন চিৎ হয়ে শুয়ে শুয়ে পড়ে
তাদের জন্য এই বই সাক্ষাৎ যমদূত। তবুও পড়তে হবে। কালেকশানটা মন্দ নয়।
কৃত্তিবাসটা
দেখে ভড়কি খেয়ে গেলাম। অকালে ভূতেদের স্মরণাপন্ন কেন? বর্ষায় ভূতের গপ্পো ভালো জমে,
তা বলে এই ভরা শরতে! না কি গভীর নিম্নপচাপের প্রভাব এখোনো দপ্তরে বিদ্যমান? না কি
এটা একটা পরীক্ষা নিরীক্ষা? দেখি তো, পূজোয় ভূত কেমন জমে? ফলে প্রাক্ পূজা সংখ্যায়
একটা আস্ত ভুতের উপন্যাস পেয়েছি।
রিডার্স
ডাইজেস্টের মতন বহুমুখী প্রতিভা বাংলা ম্যাগাজিনে আশা করা বৃথা। The Future
Tech থেকে শুরু করে conversation --- কি নেই।
এই ম্যাগাজিনটা নিয়ে বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে।
এতএব, এখানেই
দেখার ইতি টানি আমি। মেয়েদের কাপড় চেঞ্জ করতে সময় লাগে বটে, কিন্তু এতটা সময় আমার
মায়ের একমাত্র কন্যাটি নেয় না। সেক্ষেত্রে সন্দেহ হলে ধনে-প্রাণে মারা পড়ব। এতএব
বইগুলো গুপ্তস্থানে সুপ্তভাবে রেখে দিয়ে দরজা খুললাম।
খুলেই
দেখলাম, মাতৃদেবী সামনে দন্ডায়মান! হিক্...!
======================
আনন্দবাজার পত্রিকা
শতবার্ষিকী প্রবন্ধ ও কবিতা সংকলন –-- ৫০০/-
কৃত্তিবাস
প্রাক্ পুজো সংখ্যা --- ৬০/-
Reader’s
Digest --- ১০০/-
Comments
Post a Comment