এই চুপ! তুই নোংরা, তুই কথা কইস না
ভেবেছিলাম এই ব্যাপারে কিছু লিখব না। কিন্তু, আজকের রোববার ম্যাগাজিনের দুটো প্রবন্ধ ভেতরের পুরোনো স্মৃতি, বলা ভাল, বিশ্রী স্মৃতি জাগিয়ে দিল। তার পরিপ্রেক্ষিতেই এই লেখা।
নিজস্ব মত
বা বাক্ স্বাধীনতা --- খুব বিচিত্র বিষয়। তার একটাই কারণ, এর কোন নির্দিষ্ট রূপরেখা
নেই। নেই বললে ভুল হবে, অভিধানে কিম্বা বিভিন্ন দেশের সংবিধানগুলোতে আছে বটে,
কিন্তু তার বাস্তব রূপায়নের পথ এমনই বিচিত্র এবং বিপন্ন যে, স্বাধীনতা এবং
স্বেচ্ছাচারিতা দুটো একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হয়ে গেছে। সোশাল মিডিয়ার পোস্ট কিম্বা
কমেন্টসগুলো দেখলে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতাই বেশি চোখে পড়ে।
এই
রূপরেখাটা কি? পবিত্র সরকারের ভাষায়, গ্রাইস সাহেব বলেছিলেন, “যা বলা হবে তা
প্রাসঙ্গিক হবে, তাতে অসত্য-অবান্তর কিছু থাকবে না, কমও বলা যাবে না, ইত্যাদি
ইত্যাদি।” এখন এই ‘প্রাসঙ্গিক’ বা ‘অবান্তর’ এটা কে ঠিক করবে? সহজ উত্তর, সাধারণ
মানুষ। গন্ডগোলটা ঠিক এইখানেই। প্রত্যেকেরই বিচার বুদ্ধির একটা নিজস্ব মাপকাঠি
আছে, সেটা অন্যের সাথে এখন আর মিলছে না। ফলে, বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায়, যেখানে
গোপনে থেকেও স্বাধীন মতামত প্রকাশ করার মতন উদারতা দেখানো যায়, সেখানে নিজের
ক্ষোভ, বিদ্যা কিম্বা প্রতিস্পর্ধা জাহির করার নামে একটা উদ্ভট পরিস্থিতির সৃষ্টি
হয়েছে।
রঞ্জন
বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার ঠিক এর অতীত দিকটা উঠে এসেছে। এমনকি এই বিশাল
গ্লোবালাইজেশানের মাঝেও যে নিউক্লিয়ার গ্লোবালাইজেশান --- যাকে আমরা পরিবার বলি,
সেখানেও আদিকাল থেকেই চলে এসেছে স্বাধীনতা বনাম স্বেচ্ছাচারিতার দ্বন্দ্ব। যেখানে
একপ্রান্তে ফ্রয়েড মরতে মরতে বেঁচে গেলেন, কেন? না “মন খুলে কথা বলতে গেলেই
কতরকমের বাধা এসে দাঁড়ায় সামনে। এবং সবথেকে বড় বাধা, মন খুলে কথা বলে নিজের বিপদ
ডেকে আনার ভয়” --- সেখানে অন্যপ্রান্তে কোন এক বাঙালি পরিবারে একই সময়ে কি দেখা
যাচ্ছে? রঞ্জনবাবু লিখছেন, “আমার ছেলেবেলা বা কৈশোরের বাঙালি মেয়েদের কথা ভাবলে
ভারি কষ্ট হয় আমার! তাদের মতামতের কোনও মূল্যই ছিল না। প্রতি সংসারে, অন্তত
বেশিরভাগ সংসারে তো বটেই, পুরুষের দাপটই ছিল শেষকথা। সিদ্ধান্ত নিত পুরুষ, মেয়েরা
চলত সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে।” এই তো হল স্বাধীনতা! আজ অনেকটা তার পরিবর্তন হয়েছে,
যার বড় একটা কারণ, মেয়েদের অর্থনৈতিক দৃঢ়তা। ফ্রয়েড বা শেলির মতন মৃত্যুদন্ড আজ আর
তেমন হয় না বটে, তবে গৃহবন্দী ব্যাপারটা খুব জলভাত হয়ে গেছে, গৃহে ও বিশ্বে।
এই পর্যায়ের বড়ো মর্মস্পর্শী লেখা এসেছে শতাব্দী দাশের হাত ধরে। ‘ম্যানসপ্লেসিং’
শব্দটির পরিভাষা থেকে শুরু করলেন, এবং বললেন, “মতপ্রকাশ যে মূর্তিমান দুর্বিনয়, তা
বুঝতে গেলে দেশের সিডিশন অ্যাক্টে অভিযুক্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না।
রাষ্ট্রের বিশ্বস্ত ক্ষুদ্র প্রতিনিধি যে পরিবার, সেখানেই বশ্যতার পাঠ শুরু হয়।
ক্রমশ জানলাম, এ প্রবণতা কেবল পারিবারিকও নয়। ক্লাসরুম থেকে ইউনিয়ন রুম ---
গুরুবাদ সর্বত্র।” একদম রঞ্জনবাবুর প্রতিধ্বনি। একজন লেখক এবং একজন লেখিকা গার্হস্থ্য
সমাজে একই চিত্র দেখে চলেছেন।
আর, যেখানে সবচেয়ে বড়ো টার্গেট, সবচেয়ে বড়ো থ্রেট আসে, সেটার
কথাতেই এলেন তিনি এরপর --- “এই মুহূর্তে বাক্-স্বাধীনতার নামে সবচেয়ে ছাড় পাওয়া
যায় লিঙ্গগত-বর্ণগত প্রান্তিককে নির্যাতন করে, তা হল আন্তর্জালিক সমাজমাধ্যম।” আমি
যেন আমার উত্তর পেয়ে গেলাম। মেয়ে হওয়ার সুখ এই মাধ্যমে বেশ কয়েকবার উপভোগ করেছি,
জানি আরোও করতে হবে। “আন্তর্জাল ব্যাক্তিকে সহসা বিশাল জনসাগরের সামনে দাঁড়
করিয়েছে। সেখানে বাক্-স্বাধীনতার সুযোগে যে কেউ যখন খুশি যা খুশি হিংসা-ভাষ্যে
ঝাঁজরা করতে পারে ব্যক্তিকে, প্রান্তিক জাতিকে, লিঙ্ককে। ... আন্তর্জালে
নিগৃহীতদের ৭০ শতাংশই নারী।”
শেষোক্ত স্ট্যাটিষ্টিকসের সত্য-মিথ্যা আমি জানি না। তবে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। আমার প্রোফাইলে আমি স্পষ্ট করে দিয়েছি আমি আমার ব্যক্তিগত কোনও তথ্য শেয়ার করতে ইচ্ছুক নই। তা সত্ত্বেও, এবং বারংবার বলা সত্ত্বেও বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে বহু অচেনা মানুষ আমি ‘কি করি, কোথায় থাকি’ এই প্রশ্নে আমায় আজও জর্জরিত করে। স্পষ্টভাবে ‘না’ বললে তারা অপমানিত বোধ করে, শুধু তাই নয়, তা নিয়ে ক্রমাগত কটুক্তি, বক্রোক্তি, ব্যাঙ্গোক্তি করেই চলে যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের ব্লক করতে বাধ্য হই, কিম্বা নীরব থেকে তাদের ক্লান্ত করে তুলি। ফলে তথ্যটার পেছনের সত্যতার ব্যাপারে কোথাও অতিশয়োক্তি মনে হয় না।
আজ, এই
ম্যাগাজিনটার সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত একটা কথা বলতে ইচ্ছে করে, আন্তর্জাল আমাদের
সামনে আশীর্বাদ আর অভিশাপ দুটোই নিয়ে এসেছে। অভিশাপের দিকটাই এই মুহূর্তে বেশি করে
চোখে পড়ছে। কারণ মানুষ তার ভেতরের বিকৃত রুচিটাকে এক লহমায় বাইরে নিয়ে এসেছে।
অপদস্থ করার স্বাধীনতা দিয়ে দিয়েছে কোথাও এই বাক্-স্বাধীনতার নামে। দ্রুত এর পরিমার্জন
না হলে ভেতরের পশু একবার পুরোপুরি বাইরে বেরিয়ে এলে তাকে পুনরায় ভেতরে ঢুকিয়ে
শান্ত করে রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে। আর তা সমাজের পক্ষে আদৌ শুভঙ্করী হবে না।
[ছবি
কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
Comments
Post a Comment