অপরাজিত
নিজের হাত আমি নিজে অনেকবার পুড়িয়েছি। কিন্তু এই
প্রথম, আমি ঝলসে যাওয়ার ভয় পাচ্ছি। মাঝে মাঝে, লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে, লেখাটা না
লিখলেই কি ভালো হয় না? তবুও, কোন একটা মূক যন্ত্রণায় আমি লিখতে বাধ্য হচ্ছি---
অনীক স্যার, আপনি সিনেমাটা কেন
বানালেন?
নিঃসন্দেহে, বাঙালী হিসাবে যে
কয়েকজন মানুষকে আমরা অনেকদিন পর্যন্ত মাথায় তুলে রাখব তার মধ্যে সত্যজিৎ রায় একজন।
তিনি এমনই এক বহুমুখী প্রতিভা, যার পরবর্তী জেনারেশান আর তৈরী হল না। আঁকায়,
লেখায়, সুরারোপে কিম্বা পরিচালনায় এই মাপের মানুষ সারা ভারতে জন্মেছে কি? আতস কাঁচ
নিয়ে খুঁজতে হবে। মুস্কিল হল, সত্যজিৎ রায় তো আর এমনি এমনি হয় নি, এই আলোকোজ্জ্বল
মানুষটি কত অন্ধকারের সাথে লড়েছিলেন, কিম্বা নিজের ভেতরের কতটা অন্ধকারকে জয় করে
বা দাবিয়ে দিয়ে এমন মহান পথিকৃৎ হলেন, তার খবর অনীকবাবুর সিনেমায় নেই। ফলে সিনেমায় সত্যজিৎ
রায়কে এমন এক আলোকবৃত্তে রাখা হল, যেখানে কোন অন্ধকার নেই। এমনকি তার নিজের ছায়াটুকুও
নেই। ফলে এই সিনেমায় তিনি আপাদমস্তক অপাপবিদ্ধ মানুষ, যিনি এলেন, দেখলেন, আর জয়
করলেন।
সত্যজিৎ রায় এমন একটা আবেগ, যেখানে আর
সবকিছুই ঢাকা পড়ে যায়। তিনি যে পারফেক্ট নন, কোথাও এইটাই আমরা ভুলে যাই। আমরা ভুলে
যাই, মন্দ-ভালোর দ্বন্দ্বে যে মানুষটি আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় সেই-ই প্রকৃত মানুষ।
এবং এই প্রকৃত মানুষের মূল্যায়ন তখনই শুরু হয় যখন আমরা এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে
তার দিকে এগোই। কিন্তু সাধারণ মানুষের আবেগময়তাকে যখন আমরা ভয় করতে শুরু করি তখন
শুধুমাত্র ভালোটাকেই রেখে দিতে বাধ্য হই। ফলে দ্বন্দ্বের অমোঘ সংঘর্ষে যে বিদ্যুতের
ঝলক আমরা দেখতে পেতাম, এই সিনেমায় কেবল কুয়াশার মরীচিকাতেই বিমুগ্ধ হলাম। সত্যজিৎ
রায় --- এই একটি বাঙালী আবেগ এবং জিতু কামালের নিখুঁত অভিনয় --- সিনেমার বাকি সব
দুর্বলতাকেই ঢেকে দিয়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় অভিনয়
করেছেন জিতু কামাল। এটা নিঃসন্দেহে জিতু কামালের সেরা কাজ। এই মাপের কপি করা সহজ
কাজ নয়। এবং শুধু তাই নয়, সত্যজিৎ রায়ের ম্যানারিজমকে এমন স্বাভাবিকভাবে পোরট্রে
করা আরও কঠিন। দেখতে
দেখতে মনে হচ্ছিল আমি যেন সত্যজিৎ রায়কেই দেখছি। আর সেইসাথে চন্দ্রাশীষ রায়ের
ব্যারিটোন ভয়েস। চমৎকার। একবারের জন্যেও মনে হয় নি সত্যজিৎ রায়ের বদলে জিতু কামাল –
চন্দ্রাশীষ রায়ের যুগলবন্দী দেখছি। আমি বিস্মিত হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি। সাথে সায়নী ঘোষের যথাযথ
সাপোর্ট। কিন্তু ব্যাস, এর বেশি কিছু আর বলা যাচ্ছে না। অন্তত অনীক দত্তের
ক্ষেত্রে আমি বলতে পারব না যে দাদা আপনি ফাটিয়ে দিয়েছেন। বরং ফাঁকি আছে বিস্তর।
সিনেমার দুর্বল কাহিনী, দুর্বল চিত্রনাট্য, নাটকীয় ডায়ালগ, ভুল অভিনেতা অভিনেত্রী
নির্বাচন, তাদের দিয়ে কাষ্ঠল অভিনয় --- সবই সিনেমাটাকেই কোথাও শেষ করে দিয়েছে।
অভিনেতা - অভিনেত্রীদের কেমন যেন ছোটদের নাটক করার মতন যন্ত্রবৎ ডায়ালগ বলা, বড়ই
যন্ত্রণাদায়ক। ‘সব কিছুই ভালো’র সিনেমায় এটা আরোও বেশি বিরক্তিকর। ফলে এক-এক সময়
হাফিয়ে উঠছিলাম যে এটা কি দেখছি। তবুও দেখছি। আর ভাবছি, কেন দেখছি।
অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটা ছোট্ট
উদাহরণ, ননীবালা দেবীকে দেখে প্রথম থেকেই কেমন যেন খটকা লাগছিল। তার চাহনি
মহিলাচিত নয়, তার গলা অমন হেড়ে হতে পারে না। সিনেমা ‘পজ’ করে পথের পাঁচালীর
চুনীবালা দেবীর কাছে ফিরে গেলাম। দেখতে দেখতে কোথাও মনে হল না খটকা লাগছে, বরং মনে
হল অনেক সহজ, সরল ও স্বাভাবিক অভিনয় দেখছি। সিনেমার শেষে আবিস্কার করলাম, ও বাবা!
অনীক স্যার হর কুমার গুপ্ত নামের একজনকে দিয়ে অভিনয়টা করিয়েছেন, শুধু তাই নয়, ভয়েস
দিয়েছেন তিনি নিজে। ফলে মহিলা পুরুষ হয়ে এক বিকটাকার রূপ ধারণ করেছেন। সত্যজিৎ
বাবু তার ইন্দির ঠাকরণকে খুঁজতে যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছিলেন, এ যুগে সেরকম পরিশ্রম
করে কি একটা ননীবালা দেবী পাওয়া যেত না?
এরকম হাজার একটা উদাহরণ দেওয়া
যায়। আমি পোস্টের আকার আয়তন বাড়িয়ে আর নিন্দা কুড়াতে চাই না।
শেষে বলি, সত্যজিৎ রায়ের পথ এতটা
মসৃণ ছিল না। তিনিও আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন, পাশাপাশি তিনিও অনেককে আহত,
জর্জরিত করেছেন। সব মিলিয়েই তিনি সত্যজিৎ রায় হয়েছেন। অনীক দত্ত আবেগের চশমায় তাকে
দেখিয়ে বিপুল হাততালি না কুড়িয়ে বাস্তবের পর্দায় তাকে দেখিয়ে যদি মিশ্র
প্রতিক্রিয়া কুড়ানোর সাহস রাখতেন তাহলে তার এই সিনেমা হয়তো ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে
একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকত।
============================
অপরাজিত
অভিনয়ঃ জিতু কামাল, সায়নী ঘোষ
পরিচালনাঃ অনীক দত্ত
OTT Platform: ZEE5
Comments
Post a Comment