অর্জুন, তুমি অর্জুন
মহাভারত আর রামায়ণ --- দুটোই আমার অত্যন্ত প্রিয়। কারণ,
যদি ভারতবর্ষের ইতিহাসের দিক থেকে দেখি তাহলে যে দুটো সময়ের সমাজ জীবন এবং
মানবচরিত্র অঙ্কন করেছেন দুই মহাকবি, তা এককথায় অনবদ্য। আর এই মহাভারতের ওপর
সবচেয়ে বেশি মনন ছড়িয়েছেন যিনি তিনি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। তার একটা বই ‘কৃষ্ণা
কুন্তী এবং কৌন্তেয়’ নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছিলাম।
না, আমি বইটার রিভিউ লিখতে বসিনি।
‘অর্জুন’ নামক অংশটির শুরুর এবং শেষের স্তবকদুটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিল।
প্রসঙ্গত, সারা মহাভারতের যত চরিত্র আছে তার মধ্যে অর্জুন আমার কাছে নায়ক। কিন্তু
কেন? তার যে উত্তর আমি এতদিন মনে মনে পোষণ করে রেখেছিলাম, আজ তার উত্তর পেলাম। নৃসিংহপ্রসাদ
ভাদুড়ী, আপনার কলম অক্ষয় হোক, লিখিত উক্ত অংশের সেই দুটো প্যারা তুলে দিলাম
পরপর---
“অর্জুনের কথা মনে হলেই আমার পুব-বাংলা থেকে আসা
সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ে। ছেলে জলপানি পেয়েছিল বলে তাকে তার বাবা-মা কলকাতায় পড়তে
পাঠিয়েছিল। মনে আশা --- এই ছেলে বড় হয়ে, বড় চাকরি করে সংসারের সাত-আটটা প্রাণীর
অন্ন-ব্যঞ্জনের ব্যবস্থা করবে, বাড়ি করবে, স্থায়ী আবাস দেবে, আর বাবা-মায়ের হাতে
তুলে দেবে উদ্বৃত্ত কিছু পয়সা --- যা ইচ্ছে করো। হ্যাঁ, বড় হওয়া, বড় চাকরি, পাকা
বাসা --- সব তার হয়েছে। কিন্তু সে এককালীন সব পারেনি, তারই মধ্যে কালচক্রে কারও
প্রস্থান, সংসার-চক্রে কারও আগমন, এটা, ওটা, সেটা --- শেষ পর্যন্ত দেখা গেল কেউই
সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হলেন না --- না পিতাঠাকুর, না স্নেহময়ী জননী, না গৃহিণী, না
ভাই-বোন। কোথায় যেন খোঁচ রয়েই গেল। অথচ মনের গহনে সবাই পরিস্কার জানে --- এই
মানুষটি না থাকলে কে কোথায় ভেসে যেত।
* * * * *
... অর্জুনের কাছে চাওয়া হয়েছে বড় বেশি। দ্রৌপদী
তার কাছে একপত্নীব্রত পুরুষের প্রেম চেয়েছেন, যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে সদা নম্রতা এবং
সমরশীঘ্রতা চেয়েছেন, ভীম তাঁর কাছে চেয়েছেন প্রতি পদে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, জননী
কুন্তী অর্জুনের কাছে চেয়েছেন সন্তান ধারণের সার্থকতা, আর সর্বোপরি কৃষ্ণ তাঁর
কাছে চান প্রত্যেক কর্মে সকর্মক, অথচ নির্লিপ্ত ভূমিকা। তাঁর কাছে জায়া, জননী, ভাই
এবং সখার মতো পরস্পরবিরোধী চরিত্রের এই যে প্রত্যাশা --- সেই প্রত্যাশাপূরণ কোনও
একটি ব্যক্তি-পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি অর্জুন হলেও, নয়। তাছাড়া সমতা বা সমদৃষ্টি
এমনই এক দার্শনিক পদার্থ, যা সংসারের বাইরের মানুষের বোধ যতটা তৃপ্ত করে, ঘরের মানুষের
মন ততটা নয়। ফলত যুধিষ্ঠির, ভীম, কৃষ্ণা, কুন্তী --- সবাইকে তৃপ্ত করতে গিয়ে, তিনি
কাউকেই পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পারেন নি; অথচ সবাই ভেবেছে --- আসলে তাঁর শক্তি,
নিপুণতা এবং সহৃদয়তার নিরিখে সবাই ভেবেছে --- তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি
প্রত্যেককে তৃপ্ত করতে পারতেন। এও এক বিড়ম্বনা। সর্বাঙ্গীনভাবে যাঁর মহাভারতের
নায়ক হবার কথা, এই বিড়ম্বনাই হয়তো সমালোচকের মনে তাঁর নায়কত্ব প্রতিষেধ করেছে।
হয়তো এই বিড়ম্বনাই তাঁকে আস্তে আস্তে ঠেলে দিয়েছে গীতোক্ত নিস্তরঙ্গ দার্শনিকতার
দিকে। হয়তো এই বিড়ম্বনাই মহামতি কৃষ্ণের ওপরে তাঁর নির্ভরতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যাতে
জায়া, জননী, ভাই --- সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নেবে তখন একজন, অন্তত একজন তাঁর রথের রশি
ধরে সংসারের যুদ্ধক্ষেত্র পার করে দেবে, আর বলবে --- তুমি শুধু যুদ্ধের জন্যই
যুদ্ধ করে যাও অর্জুন, কী হবে, কী ঘটবে --- তা নিয়ে তুমি ভাবনা কোরো না। এমন
নির্বিকার বৈরাগী ফলাকাঙ্ক্ষাহীন যুদ্ধবীরের মধ্যেও যদি মহাভারতের অন্তঃশায়ী
শান্তরসের নায়ক খুঁজে না পাওয়া যায়, তা হলেও বলব --- অর্জুন! তুমি এখনও বঞ্চিত,
কেননা জায়া, জননী, ভাইদের মতো তুমি আমাদেরও তৃপ্ত করতে পারোনি। অথবা এই বঞ্চনা
তোমাকেই শুধু মানায়, অর্জুন! শুধু তোমাকেই।”
[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
Comments
Post a Comment