কমল হাসান এবং আমরা চার কন্যা




মাঝে মাঝে এমন হয় যাকে বলে, উলোট চণ্ডাল। ভাই তক্কে তক্কে ছিল আমাকে ঠেসে ধরে আবার কবে সিনেমা দেখাবে। কিন্তু কপাল জোরে আমি নই, সঙ্গে যখন আমার তিন বন্ধুও যখন জুড়ে গেল তখন দেখল ‘সোনায় সোহাগা’। কিন্তু সত্যিই কি তাই? গল্পটা গুছিয়েই বলি।

       রাখীর দিন ভাইকে আমরা চারজনেই রাখী পরাই। চার বান্ধবী --- আমি, সমর্পিতা, অরিত্রী আর পল্লবী। পল্লবীর কিছুদিন আগে বিয়ে হয়ে গেছে, এতএব রইল বাকি তিন। কিন্তু আমাদেরকে চমকে দিয়ে পল্লবী স্বামীসমভিব্যহারে পিতৃলয়ে এসেছে। আমার মা পল্লবীর মায়ের সাথে কথা বলে নেমন্তন্ন করে এসেছে। ঠিক হয়েছে দুপুরবেলা আমাদের বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া হবে। পল্লবীর বর ছুটি পায়নি, সে থাকবে না। এতএব ভাই আর আমরা চারজনে মিলে পার্টি করব। সমর্পিতা নিজে থেকেই বলল, দুপুরটা সিনেমা দেখা হোক। আমার ভাই সুযোগটা লুফে নিল। রাখীর দিন, ভাইয়ের অনুরোধ আর কে ফেলবে? আমি প্রমাদ গণলাম। আমি কি সহ্য করি আমিই জানি, এরা আজকের পর থেকে আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে তো? না কি বন্ধুত্বের এখানেই ইতি! হে রগুবীর, রোক্কে কোরো... 

       বলি, কিন্তু শোনে কোন রঘুবীর? এতএব, আমরা দেখতে বসলাম বিখ্যাত সিনেমা, সম্প্রতি রিলিজ করেছে ডিজনি হটস্টারে --- ‘বিক্রম’, বা ‘ভিক্রম’ যাই বলুন না কেন...


       “আজ তোদের কমলা হাসানের লেটেস্ট সিনেমা দেখাব।” সিনেমার শুরুতেই ভাই গর্ব করে বলল।

       “কমল হাসান কে?”, পল্লবী জিজ্ঞাসা করল। আমরা ঢোক গিললাম। ভাই হকচকিয়ে গেল। পল্লবী আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ঠাকুমা টাইপ মহিলা। ‘হইচই’-এর বাংলা সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ ছাড়া আর কোন ধরনের সিনেমার সাথে ওর প্রায় সম্পর্কই নেই। সিরিয়াল দেখে নিয়মিত। সে কমল হাসানকে চেনে না।

       “আরে চাচী ৪২০ দেখিস নি, ওইটাই তো কমল হাসান”, সমর্পিতা চটপট প্রক্সি দিল।

       “ও আচ্ছা আচ্ছা। তাহলে তো দারুন হবে।” পল্লবী বলল। আমার খটকা লাগল। পারিবারিক সিনেমা সে বেশি পছন্দ করে। আমি দেখলাম, আগ্রহ নিয়ে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে আছে পল্লবী। হাতে আইস্ক্রীম।

       “ও মা! কমল হাসান নাচছে কেন? না কি পিটি শেখাচ্ছে? অবশ্য গান তো চলছে পেছনে!”, পল্লবী প্রচুর প্রশ্ন করে। আনতাবাড়ি প্রশ্ন। ভাই ভুরু কুঁচকে পল্লবীর দিকে তাকাল। বুঝতে চেষ্টা করছে এটা কি ধরনের মাজাকি।

       “আরে নাম দেখাচ্ছে তো! তো এই সময়ে ও আর কি করবে বল? সেই কারণেই নাচছে, ওটা পিটি না”, অরিত্রী উত্তর দিল। ভাই অরিত্রীর দিকে এবার তাকাল। সেও কি ফাজলামি করছে?

       দশ মিনিট পরেই পল্লবীর আর্তনাদ, “যাঃ! মরে গেল যে!” আমরা চমকে উঠেছিলাম আর্তনাদে। পল্লবী ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, “কমল হাসানের সিনেমা বললি যে! সে মরে গেলে সিনেমা আর হবে?” সিনেমায় তখন আতঙ্কবাদীর ছোড়া বোমায় কমল হাসানের কাটা-পা মেঝেতে গড়াচ্ছে। 

       “হবে! ওর বাপ হবে”, ভাই দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “না হলে আমি হওয়াবো। খুশি? অ্যাই দিদি, পিলুদিকে চুপ করতে বল কিন্তু---”, আমি পল্লবীকে চিমটি কাটলাম। পল্লবী চুপ করে গেল। ওদিকে সিনেমার টাইটেল দেখাচ্ছে এতক্ষণে --- বিক্রম। ব্যাকগ্রাউন্ডে নামটা ধরে একটা লোক গলা সাধছে উচ্চৈস্বরে --- হা হা হা হা হা... ভিক্রম! ভিক্রম--- ইয়ে... ভিক্রম!

       সিনেমায় ফাহাধ ফাজিল(!) [Fahadh Faasil] এজেন্ট। লুকিয়ে একটা মেয়ের সাথে টুকুটুকু প্রেম করছে, মেয়ে কিছুই জানে না। তো ফাজিলকে পুলিশ প্রধান বলল, যারা কমল হাসান বা এরকম আরোও লোককে মারছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। জানা গেল, কমল হাসান ছিল মাতাল, মেয়েবাজ, গাঁজাখোর, অকম্মার ঢেকি, বাড়ীর খায় আর জিমে গিয়ে নেশা করে। তার ছেলে মারা গেছে সম্প্রতি। ঘরে নাতি আর বৌমা। তারপর ঠিক কি হল ঠাহর হল না, বোঝার আগেই আরেকটা লোক সিনেমায় ঢুকে পড়েছে অটো উলটে দিয়ে, ‘সাধনাম’ (আমি প্রথমে নাম শুনছিলাম, চন্দন) ওরফে বিজয় সেতুপতি।

       “দ্যাখ দ্যাখ, কি মারাত্মক মেক আপ রে! মোটা ভুশকুন্ডি বানিয়ে দিয়েছে রে! পূজা হেগড়ের সাথে যখন দেখেছিলাম কি সুন্দর আর রোগা লাগছিল। এখানে আবার তিনটে বউ!” সমর্পিতা বলল।

       “ওটা বিজয় থালাপতি, এটা বিজয় সেতুপতি-ই-ই...”, ভাইয়ের চেঁচানিতে সমর্পিতা চুপসে গেল। মৃদুস্বরে বলতে লাগল, “সেতুপতি, থালাপাতি --- দুটোই বিজয়, একটা মোটা, একটা...,” আমি চিমটি কাটলাম। সমর্পিতা ঠোঁটে আঙ্গুল দিল।

       তারপর ওরা কে কাকে ধরছে, আর কে কাকে মারছে বুঝতে পারলাম না। মোট কথা তিনটে গ্যাঙের মাঝে আমরা ভাইয়ের সাথে আটকে আছি, মাঝে খালি মারধোর আর ধোরমার। ওদিকে আতঙ্কবাদীরা এক এক করে লোক মারে, এদিকে সেতুপতি কাকে যেন জ্বালিয়ে দেয়; এদিকে আতঙ্কবাদীদের একজন টার্গেট রুদ্রপ্রতাপকে বাঁচাতে লোক লাগিয়ে দেয়, আর ওদিকে ফাজিল একবার বেশ্যালয়ের ছাদের কার্নিশে চড়ে, পরক্ষণেই গলফ ক্লাবে জিপিএস ট্র্যাকার নিয়ে ঘোরে, বিয়ে ভেস্তে যায় বলে অফিসেই বিয়ে করে। রুদ্রপ্রতাপকে বাঁচাতে ঝাপিয়ে পড়ে।

       কিন্তু, তবুও, বাঁচানো যায় না। বিজয় সেতুপতি, ফাজিল আর পুলিশের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখা যায় সবকটাকে ধরাশায়ী করে দিয়েছে আতঙ্কবাদীদের প্রধান, যে কি না কমল হাসান, নিজের মুখোশ খুলে বলছে, ‘আরম্ভ হ্যায় অন্ত কা’। অর্থাৎ, শেষের শুরু হল দেড় ঘন্টা পরে! এতক্ষণ কি চলছিল তাহলে? অতগুলো লোককে মারল যে!

       “ওরে তোরা যে বললি ভালো সিনেমা। কমল হাসান তো মারামারি করছে। এখানে রোমান্টিক কিছু নেই?” পল্লবীর হতাশ। ওর হতাশায় জল ঢালতে ঢালতে অরিত্রী বলল, “আরোও দেড়ঘন্টা আছে যখন নিশ্চই রোমান্স করবে।” 

       সমর্পিতা লজিক্যাল মানবী। সে বললে, “দেখছিস না সেতুপতির তিনটে বউ, তারা আবার সেতুপতিকে খাইয়ে দাইয়ে রোমান্স করছে। ফাহাদের একটা বউ, সে আবার অফিসে বরের সাথে ঘুমায়। কমল হাসান নিশ্চই এর থেকেও ভালো কিছু করবে।”

       হায়! কোথায় প্রেম! পুলিশ কমল হাসানকে ধরতে চাইছে, ফাজিল সেতুপতিকে মারতে চাইছে, কমল হাসান রোলেক্সকে কাটতে চাইছে, সেতুপতি ড্রাগসের কাঁচামাল হাতাতে চাইছে, রোলেক্সের আবার ওই কাঁচামাল চাই-ই চাই। কমল হাসানের নাতি আবার হার্টের পেশেন্ট। তার জোরে আওয়াজ সহ্য হয় না। এতএব তার কানে হেডফোন লাগিয়ে দিয়ে মারামারি চলছে। একহাতে নাতি, আরেক হাতে ঘুষি --- এর নাম কমল হাসান।

       তারপর যেন কি একটা ক্যাঁও-ক্যাঁচাল হল, ফাজিলের বউয়ের গলা কেটে দিল বিজয় সেতুপতি; কমল হাসানের বৌমাকে ঘরের সিন্দুকে নিরাপদে আটকে দিয়ে তাকে বাঁচাতে গিয়ে বাড়ীর কাজের লোক, যে কি না আন্ডার কভার এজেন্ট, সে প্রাণ দিল দুষ্টু লোকেদের কাটা চামচ দিয়ে চম্পা পেটানি দিতে দিতে; বস্তুত, এ সিনেমায় এমন আন্ডার কভার এজেন্ট কাড়িকাড়ি আছে, যাকেই দেখো, পরে দেখা যায় সেই এজেন্ট; শেষের দিকে সব আন্ডার কভারের কভার ওভার হয়ে গেল, এবং এক এক করে মরে গেল। আর শেষের দিকে কমল হাসানের মৃত নাতিকে বাঁচানোর জন্যে রাস্তার মাঝেই ফাজিল তার বুকে মাসাজ দিতে লাগল।

       আর কমল হাসান? উরেত্তেরি! শেষের দিকে রিভলভার, রাইফেল, মেশিনগান, মায় কামান পর্যন্ত চালিয়েছেন। গাড়ীর পর গাড়ী উড়িয়েছেন। একাই সেতুপতির প্রায় সব লোককে মেরে সাফ করেছেন। তারপর ধুমধাড়াক্কা সেতুপতিকে কিলিয়ে কাঠাল পাকা করে দিয়েছেন। ড্রাগ বিজনেসের ল্যাব আর কাঁচামাল ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে আবার ভ্যানিশ হয়ে গেছেন। একশো চুয়াত্তর মিনিট শেষ, সিনেমা শেষ, পল্লবী বুঝতেই পারেনি যে সিনেমা কখন শেষ হল।

       সমর্পিতা হাই তুলতে তুলতে ভাইকে জিজ্ঞাসা করল, “রোলেক্সটা কে? সারা সিনেমায় তো ছিল না! একদম শেষে এসে ওসব কি বলল?”, এবার ভাইয়ের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে দেখলাম। কিছু বলতে চেয়েও কিছুই বলতে পারল না। সিনেমাটা তাহলে আবার প্রথম থেকে বোঝাতে হবে তাকে। লজিক্যাল সমর্পিতার লজিকের গুষ্ঠির ষষ্ঠীপূজো হয়ে গেছে, তবুও বোঝার শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে অভ্যাসবশত। অরিত্রী বুদ্ধি করে বলল, আরে বুঝলি না, ওই তো গ্যাং-এর নেতা। 

       সমর্পিতা বলল, ভিলেন মরল না! তাহলে ওগুলো কে মরল? 

       আমি বললাম, আরে এটা বড়ো ভিলেন, পরের পার্টে মরবে। ওটা নেক্সট সিনেমা।

       “মানে!”, সমর্পিতা আঁতকে উঠল, ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “সিনেমাটা শেষ হয়নি! আরোও তিনঘন্টা আছে নাকি! এই একবার তাহলে বাড়ী থেকে ঘুরে আসি। তারপর দেখব রে! না হলে কাল না হয় দেখি বাকিটা?”

       ভাই আমাদের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, “তোরা সবকটা মাথামোটা, পাগল, উল্লু কা পাঠ্‌ঠা!” তারপর ধুপ ধাপ আওয়াজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।


       “আমার কথাটি ফুরোলো---”


==========================================

Vikram

Cast: Kamal Haasan, Vijay Sethupathi, Fahadh Faasil

Director: Lokesh Kanagaraj

Duration:  2hrs. 50 Mins

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে