শারদীয়া আনন্দলোক উপন্যাস সম্পর্কে

 


যাত্রাপালা

উল্লাস মল্লিক

 

ব্যাঙ্গাত্মক লেখার মধ্যে যদি বুদ্ধিমত্তার ছাপ থাকে তাহলে সেটা একটা পড়ার মতো একটা লেখা হয়। উল্লাস মল্লিকের উপন্যাস 'যাত্রাপালা' তেমনই একটা লেখা। এটা একটা সার্থক লেখা --- এমন কথা বলা যেমন আমার মতন নবীনা পাঠকের শোভা পায় না, তেমন বিশ্বজগতের লেখার পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে আহামরি কিছু না হলেও একথা মানতেই হবে, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে অনেকদিন পর শারদীয়া আনন্দলোক সংখ্যার কোন একটা লেখা মন ছুঁয়ে গেল।

লেখাটা পড়তে পারেন। খারাপ লাগবে না। অন্তত অনেকদিন পর মনে হল উল্লাস মল্লিকের এই উপন্যাসটি বুদ্ধিদীপ্ততার সাথে সাথে গল্পের বুনোটের মাঝে ব্যাঙ্গের এক অদ্ভুত সহাবস্থানে রাজনৈতিক টানাপোড়েনকে কীভাবে অনেকটা আনবায়াসড হয়ে লেখা যেতে পারে তার একটা সুন্দর উদাহরণ হয়ে রইল।

একটা লাইন খুব মনে ধরল, "সিদ্ধ আলু পাঁচ আঙ্গুলে চটকে দিলেই হয় না। পাঁচটা আঙ্গুল যখন হয়ে ওঠে প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা... তখনই ঠিকমতো আলুভাতে হয়।"

সঙ্গে দেবাশীষ দেব-এর অলঙ্করণের কোন তুলনা হয় না।

 



প্রত্যাঘাত

সিজার বাগচী

 

যারা কাফকা-কাম্যু পড়েন তারা দূরে হঠুন।

যারা হারুকি মুরাকামি কিম্বা পাওলো কোয়েলহোর সাথে তুলনা করতে চান তারা তফাত যান।

যারা গীতাঞ্জলী শ্রী কিম্বা অমিতাভ ঘোষের কথা তুলতে চান তারা একটু শান্ত হোন।

 

বাংলার ভূমিতে বসে বাংলায় লেখা বাংলার মানসিকতার ধারা বেয়েই আসছে, আসবে। কোয়ালিটি কেবল ঢেউয়ের মতোই উঠবে, নামবে। যেমন গত পাঁচবছর কেমন যেন নেমে গিয়েছিল। এইবার পরপর দুটো উপন্যাস পড়লাম, দুটোই বেশ ভাল লাগল। এটা কি ঢেউয়ের চড়াই? জানি না, পরবর্তী লেখাগুলো পড়লে বোঝা যাবে।

উপন্যাসটি বেশ সাজান গোছানো, বুদ্ধিদীপ্ততার ছাপ আছে। উপন্যাসটি শারদীয়া আনন্দলোকের আমার দ্বিতীয় পড়া উপন্যাস সীজার বাগচীর প্রত্যাঘাত। উপন্যাসটা যথেষ্ট ভাল মানের। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছিল প্রফুল্ল রায়ের কথা, কিম্ব সামান্য হলেও সমরেশ মজুমদারের কথা।

প্রসঙ্গত, লেখাটা সত্যিই কমপ্যাক্ট লেখা। কোন বাড়াবাড়ি রকমের ফিলোসফিক্যাল কচকচানি নেই। অহেতুক উপন্যাসটাকে বড় করার চেষ্টা নেই। আর নেই ইমোশনাল কথোপকথনের বিরক্তিকরতা। যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই। এই মিতব্যায়িতাতেই সীজার বাগচীর মুন্সিয়ানা। পড়তে ভালো লাগে। টানা পড়ে শেষ করলাম উপন্যাসটা। একবারও মনে হল না, পাশে সরিয়ে রাখি, কাল বাকিটা পড়ব।

আসলে গভীর উপন্যাসের পাশাপাশি সহজ সরল সাদামাটা একটা উপন্যাস, যার মধ্যে অত্যন্তবলে কিছু নেই, ‘গভীরবলে কিছু নেই, আবার এমন একটা চিরপরিচিত সমস্যার বিষয় নিয়ে সঠিকভাবে একটানা পড়ে যাওয়ার মতো একটা উপন্যাস রচনা সহজ নয় কিন্তু। সেটা অনেকদিন পর সীজার বাগচীর এই উপন্যাসটায় পেলাম...

 

 


মুষলপর্ব

অজিতেশ নাগ

 

একটা ব্যাপার আমার বেশ মজার লাগে। যেমন, কেউ একজন, সেটা আমিও হতে পারি, একটা পোস্ট করলাম, যে পোস্টের কয়েকটা লাইন যথেষ্ট রকমের প্রতিবাদ করার মতো। কেউ একজন বা কয়েকজন প্রতিবাদের প্রত্যুত্তর দিল বাক্যটাকে আক্রমণ করে। তারা ঠিকই আছেন, তাদের বিবাদ নিয়ে আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তাদের কয়েকজন আবার রাগের চোটে লজিক ব্যবহার না করে বাক্যগুলোর পেছনে আমার ফুটেজ খাওয়ার বা লাইক পাওয়ার লোভ নিয়ে কষ্টকল্পনা করে সরাসরি আঘাত করেন। কেউই আর বাক্যগুলোর পেছনের সত্যতা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে চান না, নিজেদের অনুমান আর আবেগ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আরোও মজার ব্যাপার, বড় জাহাজের পেছনে যেমন গাধাবোট লাগানো থাকত আগেকার দিনে, তেমনই এদের পেছন পেছন কয়েকজন আবার প্রতিবাদের আর কোন অবশেষ না পেয়ে, আঘাত করার আর কোন বিশেষ উপাদান না পেয়ে সরাসরি ভুল বানান নিয়ে পড়ে যান। তাদের ব্যঙ্গ করার একমাত্র হাতিয়ার কেবল ওই বানান ভুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অথচ সেইজন স্পষ্টভাবে যেটাকে উপলব্ধি করেছে, সেটাকেই বলেছে, বা বলার চেষ্টা করেছে।

‘মুষলপর্ব’ উপন্যাসের সম্বুদ্ধ সেনের চরিত্রটাও খানিকটা তেমনি। সম্বুদ্ধ সেন, মস্ত বড় থিয়েটার পার্সোনালিটি, কারো তোয়াক্কা করেন না। শ্রীজা নামের মেয়েটি তাকে সাবধান করার পরেও নয়। তিনি অবলীলায় স্টার অভিনেতাকে বাড়ি পাঠিয়ে জহুরীর চোখে মামুলী পথ অভিনেতাকে খুঁজে বের করেন, তাকে প্রতিষ্ঠা করার মতো ক্ষমতা দেখান। অথচ ঠিক এরপর দেখা যায় তার পেছনে লাগছে চন্দ্রশেখর রায়চৌধুরী, অনিরুদ্ধ ভট্টাচার্যের মতন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। পেছনে গাধাবোটের মতন আসছেন আকাশ কিম্বা রণজিৎ ঘোষালের মতন মানুষেরা। আর এদের প্রত্যেককেই সম্বুদ্ধ সেন যেন বলতে চাইছেন, ‘চল ফোট’। এবং সবশেষে নিজেই রাজার মতন মঞ্চ থেকে নেমে আসেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাকে শেষ করে, উদাসীনভাবে হারিয়ে যান চিরতরে...

আমার অবিশ্বাস্য লাগছে। সত্যিই অবিশ্বাস্য লাগছে। কিছু কিছু জায়গা বাদ দিলে শারদীয়া আনন্দলোকের এই উপন্যাসটাকেও চোখ বুজে লেটার মার্কস দিয়ে দেওয়া যায়। অজিতেশ নাগের লেখা আগে পড়িনি। আর তাছাড়া থিয়েটার জগতের ব্যক্তিত্বরা কেমন হয়, থিয়েটারপাড়ার মধ্যেকার কুশীলবেরা কেমন নিজেদের মধ্যে টানাপোড়েনে চলেন আমি তা জানি না। ফলে সেই চরিত্রগুলি ফোটাতে ঠিক কতটা মুন্সীয়ানার পরিচয় লেখক দিতে পেরেছেন সেটা বলার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু এই বিষয়ের ওপর পড়া এটা আমার প্রথম উপন্যাস। পাঠিকা হিসাবে সেইদিক থেকে আমার যথেষ্ট ভাল লেগেছে। গল্পের মূল কাঠামো চিরপরিচিত হলেও বলার ভঙ্গীটা বেশ ভাল লাগে।

উপন্যাসের পর্বান্তরে কোথাও কোথাও একটু ঢিলেভাব চোখে পড়লেও কিছুক্ষণের মধ্যেই গল্পের ছন্দে সেটা ভুলে গেছি। মাঝে মাঝে মানসিক টানপোড়েনের বুনোট অতটা ঠাস মনে না হলেও বেশ সুন্দরভাবে উতরে দিয়েছেন লেখক।

আর এর সাথে অলংকরণে সৌমেন দাস অসম্ভব সুন্দর। আমি চিত্রশিল্পবোদ্ধা নই। ‘পেইন্টিং’ আর ‘অলংকরণ’ নিয়ে মাঝে মাঝে বাদ-বিবাদের কথা আমার শিল্পী বান্ধবীর মুখে শুনেছি বটে, কিন্তু এই উপন্যাসে লেখার মাঝে মাঝে অলংকরণ যেন একদম সহজ সরলভাবে পাশে এসে বসেছে। লেখা ও রেখা এক হয়ে গেছে।

মোদ্দা কথা, অনেকদিন পর, এই প্রথম, কোন শারদীয়া সংখ্যা এত উপভোগ করছি।

     শেষ করি উপন্যাসের কয়েকটি লাইন দিয়ে, অজিতেশ নাগ উপন্যাসটি শেষ করছেন---

“... সত্যি কি কেউ হারিয়ে যায়? যে হারিয়ে যায়, সে তো কমপক্ষে জানে সে কোথায় যাচ্ছে। সে আছে, সে থাকে, এই বিশাল গোলাকার পৃথিবীর কোনও এক গোলার্ধে, কোনও এক স্থানে, হয়তো কোনও গ্রামে, হয়তো কোনও নির্জন অরণ্যের কাছাকাছি, হয়তো কোনও সমুদ্রের তীরের বেলাভূমি ঘেঁষে, হয়তো কোনও তুষারবৃত মনাস্টারিতে অথবা কোনও প্রচণ্ড কোলাহল-মিশ্রিত জনজীবনের মধ্যেই। আদতে মানুষ হারায় না। মরে গেলেও হারায় না। বড়জোর পঞ্চভূতে মিলিয়ে থাকে। তবু তো থাকে।”

 

============================

শারদীয়া আনন্দলোক

মূল্যঃ ২২০/-

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে