কি বিচিত্র দেশ!
বেশ কয়েক বছর আগে একটা ভিডিও
ক্লীপ ভাইরাল হয়েছিল। একটি স্কুলের সম্ভবত প্রবীণ বিদায় টাইপের একটা অনুষ্ঠান।
সেখানে বাজছে ‘রব নে বানাদে জোড়ি’ গানটি, নাচছে এক নবীন কিশোর, স্কুলেরই এক ছাত্র।
আর অদ্ভুত ব্যাপার, গানটির সাথে সাথে বেশ কয়েকজন শিক্ষিকা কিশোর ছাত্রটির সাথে
সাথে নেচে গেলেন, শেষের দিকে যোগ দিলেন শিক্ষক এবং আরোও কিছু ছাত্র-ছাত্রী।
এত সুন্দর
দৃশ্য আর কি হতে পারে? এমন সৌন্দর্যের মধ্যে কোন অশ্লীলতা থাকতে পারে? না। আপনি
যদি ভিডিওটা আজও দেখেন তাহলেও বলবেন এটা এক অপূর্ব সম্পর্কের মাধুর্যের
বহিঃপ্রকাশ। এখানে কিন্তু কেউ কারো ব্যক্তিগত পরিসরে ঢোকে নি। আক্রমণও করে নি। ছাত্র
শিক্ষক সম্পর্ক কি এমনই হওয়া উচিত নয়?
উচিৎ।
বেশ। এবার
একটু সরে এসে দেখা যাক। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সেই শিক্ষায়তনগত পরিসরের বাইরে একটা
সামাজিক পরিচয় আছে, তার বাইরেও আছে তার ব্যক্তিগত আশা-আকাঙ্ক্ষা, সেটা তার আরেকটা
পরিচয়। আমরা দৌড়তে চাইছি পশ্চিমের উন্নততর জীবনযাত্রাকে ধরার লক্ষ্যে, কিন্তু
পাশাপাশি তাকে রূপ দিতে চাইছি পুরাতন ষোড়ষ কিম্বা সপ্তদশ শতকের মানসিকতায়। ফলে নকল
হচ্ছে বটে কিন্তু উন্নতি হচ্ছে না; খাপ পঞ্চায়েত বসছে, অনার কিলিং হচ্ছে, কিন্তু
মানসিকতার কোন পরিবর্তন হচ্ছে না।
যে ঘটনাটাকে
কেন্দ্র করে এবারের প্রতিদিন পত্রিকার রবিবারের প্রচ্ছদ তার অভিঘাত বঙ্গসমাজে একটু
হলেও হুলুস্থুলু বেধেছে। আমার চোখে কিন্তু ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। এ নিয়ে একটু হই-হুল্লোড়
হবে, তারপর আবার যে কে সেই। মনে আছে? শিক্ষিকারা স্কুলে সালোয়ার পরে এলে কি ধরণের
ফতোয়ার মুখে পড়ে লজ্জায়, অপমানে মাথা নীচু করে আবার শাড়ী পরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন
একটা সময়?
আমরা অধ্যাপিকার
ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে নিয়ে খাপ পঞ্চায়েত বসাতে পারি, এতটাই উন্নত হয়ে গেছি।
কিন্তু আটকাতে পারি না অভিভাবকের দৃষ্টিদোষের পরিবর্তন ঘটাতে। করোনার পরে
ছেলেমেয়েদের হাতে হাতে স্মার্ট ফোন। তাই বলে কি কোনো স্কুল/কলেজ এমন ফতোয়া জারি করতে
পেরেছে যে, এই আমরা একটা আই টি সেল বসালাম, যে যে ছাত্র-ছাত্রীরা ব্লু-ফিল্ম দেখবে
তাদের শো-কজ করা হবে, কারণ এটি একটি অত্যন্ত কুরুচিকর অভ্যাস, এবং স্কুল/কলেজ
এটাকে কোনভাবেই সমর্থন করবে না। কিম্বা পড়াশোনার বিষয়বস্তু ছাড়া স্কুলপ্রাঙ্গনে
শুধু নয়, ঘরের প্রাঙ্গনেও অন্য কোনরকম বিষয় নিয়ে ব্রাউজিং করা যাবে না। সম্ভব সেটা?
সম্ভব নয়। নোংরা,
অশালীন ব্যবহার, শিক্ষিকার দিকে কুরুচিকর মন্তব্য ছুড়ে দেওয়া, বিদ্যালয় প্রাঙ্গনেই
বা তার আশেপাশে গাছের তলায় ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত তৈরী করা, কিম্বা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের
মধ্যে সোশাল মাধ্যমে অশ্লীল চটুল মিম বা মেসেজ চালাচালি করা --- কই এমন ঘটনা তো
থামছে না! যত সমস্যা কেবল একজন অধ্যাপিকা তার ব্যক্তিগত পরিসরে কীভাবে থাকছেন তার
সঠিক-ভুল মাত্রা নির্ধারিত করে নিজস্ব খাপ পঞ্চায়েত বসিয়ে একেবারে চাকরী খেয়ে নিয়ে
তাড়িয়ে দেওয়া! এ কেমন সমাজ।
তিলোত্তমা
মজুমদার, হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অতনু বিশ্বাস কিম্বা অরুন্ধতী দাসের লেখা পড়তে পড়তে
এই কথাগুলোই মনে পড়ছিল। যেখানে গোটা সমাজটাই দোষদৃষ্টিতে ভরে যাচ্ছে, যেখানে এখনো
অনার কিলিং হয়, যেখানে সালোয়ার কামিজ পড়া দৃষ্টিকটু, যেখানে ছাত্রীদের হাঁটুর ওপর
উঠে যাওয়া স্কার্ট পড়ার মধ্যে কোন কুরুচিশীলতা না দেখতে পাওয়া থাকতে পারে সেখানে
এইসব ঘটনা তো খুবই ছোট্ট ঘটনা। এ নিয়ে এত লেখার কি প্রয়োজন?
প্রয়োজন
একটাই, ৭৫ বছরের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আদিবাসী প্রেসিডেন্ট যে দেশে ভাষণ
দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, সে দেশে বিকিনি পড়ে ছবি পোস্ট করার দায়ে একজন অধ্যাপিকার
চাকরীও চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। সত্য সেলুকাস...
Comments
Post a Comment