বউ

 



"বউ, তুই কবে আবার বিয়ে করবি?"

 

আমার যিনি স্বামী, মানে বর্তমান স্বামী আর কি, তার বয়স চার বৎসর। যারা আমার হতভাগাকে চেনেন বলে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে চাইছেন, তাদের বলি, আপনারা আমার প্রেমিক এবং আমার স্বামীর সঙ্গে সম্বন্ধে গুলাচ্ছেন। দুজন আলাদা মানুষ, আলাদা বিষয়, আলাদা সম্পর্ক।

আমার স্বামী প্রথম যেদিন আমাকে 'বউ' বলে ডেকেছিলেন, যাস্ট অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বাবা-মা আমাকে না জানিয়ে, আমার অনুমতি না নিয়ে এমন একটা ঘটনা কবে ঘটিয়েছিলেন, তা আমার পতিদেবতার কাছে জানতে চাওয়ায়, তিনি আমার কোলে বসে বসে ললিপপ খেতে খেতে বলেছিলেন, তুই জানিস না, গতজন্মে তোর সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে তো!

হিন্দুশাস্ত্র সম্পর্কে আমার যতটুকু ব্যুৎপত্তি আছে তাতে আমি পড়েছি বটে স্বামীর সঙ্গে নাকি সাত জন্মের সম্পর্ক। এহেন হাতে-কলমে প্রমাণ পেয়ে আমি আশঙ্কিত এবং আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তা এ জন্মে এই স্ত্রীরত্নটির কর্তব্য কি হবে?

দেখা হলেই চিপস আর ললিপপ আর চুমু। আর তাকে কোলে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যেতে হবে। এই হল এজন্মের স্বামীসেবা।

এমন কর্তব্যে অবিচল ছিলাম এতদিন। মানে দুই বছর ধরে। এই দুই বছরে তিনি আমাকে মাসী’ বলে ডাকেন নি। বাজারে হোক, কিম্বা রাস্তায় --- চীল চিৎকারে 'এই বউ, আমায় কোলে নে।' বলে লোকজন, সমাজ হতচকিত করে অবলীলায় কোলে চড়ে বসেছে। আমার হতভাগা একবার এই অবস্থা দেখে আমাকে জনান্তিকে কানে কানে "বিয়ে পর আমিও কিন্তু তোর কোলে চড়ব", বলে আমার অবিশ্রান্ত চপেটাঘাত সহ্য করেছে।

এমন স্বামীকে নিয়ে খুব বেশি সমস্যা নেই। সপ্তাহান্তে এক প্যাকেট চিপস আর ললিপপে কাজ চালিয়ে এসেছি। প্রায় মাঝে মাঝে ভিডিও কলে আমরা দুজনে আধো আধো ভাষায় প্রেম করেছি। মাঝে মাঝে তার বাড়ী গিয়ে লাফালাফি ঝাপাঝাপি করে আমার শ্বশুর-শাশুড়ীকে ব্যতিব্যস্ত করেছি। তিনিও আমার বাড়ী এসে একই কাজ করেছেন।

 

কিন্তু গোল বাধল তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর।

স্কুলে যাওয়ার প্রথম কয়েকদিন কেবল স্কুলের গল্প। তার বন্ধু-বান্ধবীরা কেমন, তাদের সাথে কি কি খেলাধূলা হয়, মিসরা কত ভাল ব্যবহার করে, কি কি পড়ায় ইত্যাদি ইত্যাদি শুনে শুনে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুখী দুখী মুখ করে আমায় তিনি বলেছেন, বউ রে! তুই আমার পাথে থাতলে কততো বালো ওতো। আমায় তিফিন খাইয়ে দিতে পাততিছ। আমায় কোয়ে করে পটিতে নিয়ে যেতে পারতিছ। আমার কততো থুবিধা ওতো।

 

কিন্তু কয়েকদিন ধরে এসব অনুযোগ অভিযোগ একদম বন্ধ। দেখা হলে কোলে চড়েন বটে, কিন্তু কেমন যেন স্বামী-কর্তব্য সম্পাদন করছেন বলে মনে হয়। ললিপপ খাওয়ায় তেমন উৎসাহ নেই, যদিও চিপস এখন দুই প্যাকেট আদায় করেন।

তার বেশ কয়েকদিন পর আমার বুকে শেল বিঁধিয়ে এমন এক প্রশ্ন। আমার মতন হতভাগা অবলা নারী স্বামী পরিত্যক্তা হলে যে বঙ্গসমাজে মুখ দেখিয়ে বাস করবে কি করে সে কথা কি একবারও তার মনে হল না? এমনকি ডিভোর্সী মেয়েদেরকেও এখনও যেরকম চোখে দেখা হয়, যেরকম Easy Available বলে ধারণা করে নেওয়া হয়, সে নিয়ে কি কোন বিতর্ক আছে? হায়! আমার জন্মান্তরের স্বামীও কি না আমায় পরিত্যাগ করতে চায়, থুড়ি, অন্য স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে চায়!

শাশুড়ি থুড়ি দিদিকে জিজ্ঞাসা করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচিত হল। ক্লাসে যে বালিকার সাথে আমার স্বামীদেবতাটি বেঞ্চ শেয়ার করেন, তার প্রতি তার মন মজেছে। তারা এখন শেয়ারে টিফিন খায়। একসাথে রান্নাবাটি খেলে। স্লিপে চড়ে। একটাই দোলনা শেয়ার করে। আর একসঙ্গে অনেক অনেক সেলফি তোলে। মোদ্দা কথা হল তার মনে যে বালিকা বসন্তের ঢেউ তুলেছে, সেই একই ঢেউয়ের ধাক্কায় বর্তমান বধূ পতিদেবতার চরণস্থল থেকে টলায়মান হয়ে পড়েছে।

এই বয়সে প্রেম কি, তারা জানে। বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড কি, তারা জানে। প্রেমজ সম্পর্কে কি কি করতে হয়, তার বেশ কিছু নিজেদের বাবা-মা’কে অনুসরণ করে তার যথাকর্তব্যও সম্পাদন করে। আমি ভাবি, এত এডভান্স হচ্ছে কি করে! মাত্র চার বছরে মানব প্রকৃতির এত রহস্য তাদের নিখুঁত র‍্যাডারে ধরা পড়ছে, শুধু তাই নয়, যথাযথ বিশ্লেষণও হয়ে যাচ্ছে! এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে পরবর্তী দশক তাহলে কি ধরণের চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আসবে? কে জানে!

 

মোদ্দা কথা, সে এখন আমাকে ‘বউ’ ডাকে বটে, তবে অতটা চিল্লিয়ে না। এতএব, নিজেকে আমার হতভাগার হাতে সঁপে দিতে আমি নিজে যতটা ইচ্ছুক, তার কয়েকশোগুণ তিনি উৎসুক। মাঝখান থেকে আমার কোল আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে আসছে...

ছবিটা অনেকদিন আগের। সাগরকূলে আমাদের স্বপ্নের বালির বাড়ি বানাতে তিনি ব্যস্ত। হায়! আজ সে আশাও সাগরের জলেই তলিয়ে গেল...

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে