রবীন্দ্রনাথের গীতা
কিছু কিছু
লিজেন্ড লেখকের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন তার কোন একটি লেখা নিয়ে তার জীবদ্দশাতেই
শোরগোল পড়ে যায়। সে প্রায় পাগলপারা অবস্থা হয় বলতে গেলে। শিল্পী নিজেও এমন হতভম্ব বা
অভিভূত হয়ে যান যে তাকেও সময়বিশেষে সকলের সামনে তার সেই সৃষ্টি নিয়ে মুখ খুলতে হয়।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে এমন একটি কবিতা হল, সোনার তরী।
বর্ষার পটভূমিকায় লেখা এই কবিতাটি কবি লিখলেন
ফাল্গুনের মোহময়ী প্রাকৃতিক রূপসুধাকে উপেক্ষা করে, 1892 সালে। সে কবিতা ছাপা হল এরও
বছরখানেক পরে সাধনা পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায়, 1893 সালে। সে কবিতাকে কেন্দ্র করে বঙ্গসমাজে
শোরগোল পরে গেল আরোও চোদ্দ বছর পরে 1907 সালের আশেপাশে। এবং অবশেষে রবীন্দ্রনাথ
1908 সালে বঙ্গসমাজের উন্মত্ত মিশ্র প্রতিক্রিয়ার মাঝেই 'শান্তিনিকেতন' নামক প্রবন্ধগুচ্ছে
‘তরী বোঝাই’ নামে একটি প্রবন্ধে উক্ত কবিতাটিকে ঘিরে সকল ভালো-মন্দ সমালোচনার জবাব
দেন।
‘তরী বোঝাই’ প্রবন্ধটি পড়লেই বোঝা যায়, কবিতাটি,
রবীন্দ্রনাথের ভাষ্য অনুসারে, শ্রীমদ্ভাগবতগীতা’র কর্মযোগ পর্যায়ের মূলভাব, যাকে বলে
এসেন্স, সেই এসেন্সটিকেই এই কবিতাটিতে ধরতে চেয়েছেন। কোন রাখঢাক না করেই গীতোক্ত একটি
শ্লোককেও সরাসরি তুলে ধরলেন লেখায়,
অব্যক্তাদীনি
ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব
তত্র কা পরিবেদনা ।।২/২৮।।
অর্থাৎ, আমরা এটুকু বুঝতে পারছি, রবীন্দ্রনাথ
কমপক্ষে ৩১ বছর বয়সের মধ্যেই গীতা পড়ে ফেলেছেন শুধু নয়, গীতার প্রতি আগ্রহ জেগেছে,
এবং গীতার শ্লোকগুলোকে আত্মস্থ করার পর সেই অন্তর্ভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তার কবিতায়,
প্রবন্ধে, গানে। যদিও আরেকটু ঘাটলে আমি নিশ্চিত, উপনিষদের পাশাপাশি গীতা-মহাভারত তার
বহু আগেই পড়া হয়ে গেছে। সেটা বালক বা কিশোর বয়স হলেও আমি অবাক হব না।
অনেকে মনে করেন, গীতা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ
ছিল না। আমার তা মনে হয় না। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ধর্মের প্রতি উন্মাদনা ছিল না।
ফলে গীতাকে তিনি গীতার আঙ্গিকেই দেখেছিলেন। স্পষ্টভাবে ভারতীয় সমাজে, ধর্মীয় সমাজে
এবং সেইসাথে নিজের অন্তর্জগতে তার স্পষ্ট রূপটা দেখতে পেয়েছিলেন, গীতাকে স্বীকার করেছিলেন।
স্বীকার করেছিলেন বলেই গীতার শব্দার্থ ও মর্মার্থ বারংবার তার লেখাতে উদাহরণ হিসাবে
এসেছে। ‘ঐতিহাসিক চিত্র’ নামক প্রবন্ধটির তৃতীয় প্যারাই তার একটা বড় প্রমাণ। আর স্বীকারোক্তি?
সবচেয়ে মহার্ঘ্য কথাটি তিনি বলে গিয়েছেন তার ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের ধারা’ নামক প্রবন্ধে।
কি বলেছেন তার চুম্বক চুম্বক একটু পড়া যাক---
“এই মহাভারতে কেবল যে নির্বিচারে জনশ্রুতি
সংকলন করা হইয়াছে তাহাও নহে। আতস-কাচের একপিঠে যেমন ব্যাপ্ত সূর্যালোক এবং আর একপিঠে
যেমন তাহারই সংহত দীপ্তিরশ্মি, মহাভারতেও তেমনি একদিকে ব্যাপক জনশ্রুতিরাশি আর একদিকে
তাহারই সমস্তটির একটি সংহত জ্যোতি -- সেই জ্যোতিটিই ভগবদ্গীতা। ... মানুষের ইতিহাসের
জ্ঞান ভক্তি ও কর্ম অনেক সময়ে স্বতন্ত্রভাবে, এমন কি পরস্পর বিরুদ্ধভাবে আপনার পথে
চলে; সেই বিরোধের বিপ্লব ভারতবর্ষে খুব করিয়াই ঘটিয়াছে বলিয়াই এক জায়গায় তাহার সমন্বয়টিকে
স্পষ্ট করিয়া সে দেখিতে পাইয়াছে। মানুষের সকল চেষ্টাই কোনখানে আসিয়া অবিরোধে মিলিতে
পারে মহাভারত সকল পথের চৌমাথার সেই চরম লক্ষ্যের আলোকটি জ্বালাইয়া ধরিয়াছে। তাহাই গীতা।
... অতএব যে গ্রন্থে তত্ত্বের সহিত জীবনকে মিলাইয়া মানুষের কর্তব্যপথ নির্দেশ করা হইয়াছে
সে গ্রন্থে বেদান্ততত্ত্বকে তাঁহারা বাদ দিতে পারেন নাই। সাংখ্যই হউক যোগই হউক বেদান্তই
হউক সকল তত্ত্বেরই কেন্দ্রস্থলে একই বস্তু আছেন, তিনি কেবলমাত্র জ্ঞান বা ভক্তি বা
কর্মের আশ্রয় নহেন, তিনি পরিপূর্ণ মানবজীবনের পরমাগতি, তাঁহাতে আসিয়া না মিলিলে কোনো
কথাই সত্যে আসিয়া পৌঁছিতে পারে না; অতএব ভারতচিত্তের সমস্ত প্রয়াসকেই সেই এক মূল সত্যের
মধ্যে এক করিয়া দেখাই মহাভারতের দেখা। তাই মহাভারতের এই গীতার মধ্যে লজিকের ঐক্যতত্ত্ব
সম্পূর্ণ না থাকিতেও পারে কিন্তু তাহার মধ্যে বৃহৎ একটি জাতীয় জীবনের অনির্বচনীয় ঐক্যতত্ত্ব
আছে। ... এমন কি, গীতায় যজ্ঞকেও সাধনাক্ষেত্রে স্থান দিয়াছে। কিন্তু গীতায় যজ্ঞ ব্যাপার
এমন একটি বড়ো ভাব পাইয়াছে যাহাতে তাহার সংকীর্ণতা ঘুচিয়া সে একটি বিশ্বের সামগ্রী হইয়া
উঠিয়াছে। যে সকল ক্রিয়াকলাপে মানুষ আত্মশক্তির দ্বারা বিশ্বশক্তিকে উদ্বোধিত করিয়া
তোলে তাহাই মানুষের যজ্ঞ। গীতাকার যদি এখনকার কালের লোক হইতেন তবে সমস্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিক
অধ্যবসায়ের মধ্যে তিনি মানুষের সেই যজ্ঞকে দেখিতে পাইতেন। যেমন জ্ঞানের দ্বারা অনন্ত
জ্ঞানের সঙ্গে যোগ, কর্মের দ্বারা অনন্ত মঙ্গলের সঙ্গে যোগ, ভক্তির দ্বারা অনন্ত ইচ্ছার
সঙ্গে যোগ, তেমনি যজ্ঞের দ্বারা অনন্ত শক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ--এইরূপে গীতায় ভুমার
সঙ্গে মানুষের সকল প্রকারের যোগকেই সম্পূর্ণ করিয়া দেখাইয়াছেন--একদা যজ্ঞকাণ্ডের দ্বারা
মানুষের যে চেষ্টা বিশ্বশক্তির সিংহদ্বারে আঘাত করিতেছিল গীতা তাহাকেও সত্য বলিয়া দেখিয়াছেন।”
১৯১২ সালে, ৫১ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথের এই লেখার
মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়, গীতাকে তিনি কি চোখে দেখতেন। এই অংশটির মধ্যে কি কোথাও মনে হচ্ছে
তিনি গীতার বিরোধিতা করছেন? গীতোক্ত অনুভূতিকে অসম্পূর্ণ এবং অপ্রাসঙ্গিক বলছেন? না।
বরং ভারতবাসীকেই সতর্ক করে দিচ্ছেন। বারবার তিনি সাবধান করে দিচ্ছেন যে গীতার যথার্থতা
নিয়ে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। বরং এই প্রবন্ধেই, পাশ্চাত্যের কিছু কিছু পণ্ডিতেরা
গীতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছেন বলে রবীন্দ্রনাথ তার বিরোধিতা করছেন, এবং গীতার বিশ্বজনীনতাকে
তাদের এবং পাশ্চাত্যপ্রেমী অন্ধ ভারতীয়দের কাছে সঠিক মর্মার্থের আঙ্গিকে পেশ করছেন---
“ভারতবর্ষের ইতিহাসে আমরা প্রাচীনকাল হইতেই
দেখিয়াছি, জড়ত্বের বিরুদ্ধে তাহার চিত্ত বরাবরই যুদ্ধ করিয়া আসিয়াছে;--ভারতের সমস্ত
শ্রেষ্ঠ সম্পদ, তাহার উপনিষদ, তাহার গীতা, তাহার বিশ্বপ্রেমমূলক বৌদ্ধধর্ম সমস্তই এই
মহাযুদ্ধে জয়লব্ধ সামগ্রী”
রবীন্দ্রনাথ ভারতবর্ষের মাটির পুত্র। ভারতবর্ষের
প্রাচীন মূল্যবোধটিকে তিনি পেয়েছিলেন উপনিষদ, বিশেষ করে শ্বেতাশ্বর উপনিষদ থেকে। উপনিষদেরই
ভাবার্থ রূপ হল গীতা। ফলে গীতার সাথে তার প্রাণের যোগ আছে বলা হলেও ভুল বলা হবে না।
একটা ছোট উদাহরণ দিই।
যে কতিপয় মানুষ ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ রূপ, জনচেতনা,
আবেগ আর সমাজের প্রবাহকে অত্যন্ত গভীরভাবে দেখেছিলেন, পর্যালোচনা করেছিলেন, এবং তাকে
পরবর্তীকালে বোধে উন্নীত করেছিলেন তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ অন্যতম। তাই আধুনিক ভারতবর্ষের
অন্যতম সার্থক রূপকার তিনি। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরেক ধাপ এগিয়ে গেল।
তিনি ভারতীয় থেকে বিশ্বনাগরিকে যখন উন্নীত হলেন, তখন তিনি বিশ্বের আঙ্গিনায় ভারতের
মূল সাধনাকে আরোও ভাল করে বুঝতে পারলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝলেন, ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিবেকানন্দের
মূল মর্মবাণী কি ছিল। তাকেই স্বীকার করার সাথে সাথে গীতাকে আরেকবার স্পষ্ট করে সবার
কাছে ভারতবর্ষের সাধনার সোপানরূপে তুলে ধরলেন ‘তপোবন’ প্রবন্ধে ---
“ভারতবর্ষ যে সাধনাকে গ্রহণ করেছে সে হচ্ছে বিশ্বব্রহ্মান্ডের সঙ্গে চিত্তের যোগ, আত্মার যোগ, অর্থাৎ সম্পূর্ণ যোগ। কেবল জ্ঞানের যোগ নয়, বোধের যোগ।
গীতা বলেছেন-
ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ
পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ।
ইন্দ্রিয়গণকে
শ্রেষ্ঠ পদার্থ বলা হয়ে থাকে, কিন্তু ইন্দ্রিয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, আবার মনের চেয়ে বুদ্ধি
শ্রেষ্ঠ, আর বুদ্ধির চেয়ে যা শ্রেষ্ঠ তা হচ্ছেন তিনি।
এই সকলের-চেয়ে-শ্রেষ্ঠকে
সকলের মধ্যেই বোধের দ্বারা অনুভব করা ভারতবর্ষের সাধনা।”
এরপরে আর কি-ই বা বলার থাকে? যেভাবে ভারতবর্ষের
মূলভাবকে বোঝাতে গিয়ে গীতাকে সামনে নিয়ে আসছেন, এরপরেও কি আমরা বলব তিনি গীতা পছন্দ
করতেন না?
যেসমস্ত মহামানবদেরকে আমরা আধুনিক ভারতের রূপকার
আখ্যা দিয়ে থাকি, তাদের অধিকাংশই গীতাকে পরম বন্ধু বলেছেন, সে মহাত্মা গান্ধী হোক,
কিম্বা বাল গঙ্গাধর তিলক। রবীন্দ্রনাথও তার বাইরে নন, আর নন বলেই প্রবন্ধের পর প্রবন্ধে
কথাপ্রসঙ্গে গীতা এসেছে উদাহরণরূপে, কখনও বা সরাসরি। ‘মহাত্মা গান্ধী’, ‘পশ্চিম যাত্রীর
ডায়রী’, ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ এরকম আরোও আরোও অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তার রচনাবলীতে।
তার পত্রাবলী আমার পড়া হয় নি, কিন্তু আমি নিশ্চিত, কোন উৎসাহী যদি মন দিয়ে তার পত্রাবলী
পড়েন, নিশ্চই এমন আরোও অনেক উদাহরণ মিলবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কোনখানেই রবীন্দ্রনাথ
আবেগসর্বস্বভাবে গীতার কথা বলেন নি। রবীন্দ্রনাথ কোনদিনই আবেগপ্রবণ ছিলেন না। স্বামী
বিবেকানন্দ বা মহাত্মা গান্ধীর মতোই তিনিও ভাবালুতা পছন্দ করতেন না। ফলে তার বক্তব্যে
গীতা আসে সহজ, সরল, অনাড়ম্বরভাবে। ঠিক যেমনভাবে আমরা আমাদের প্রিয়জনকে শেষ বিদায় জানাই
তার বুকের মাঝে ‘গীতা’ রেখে...
[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
এককথায় অনবদ্য 👏 সমৃদ্ধ হলাম
ReplyDelete