আয়নার এপার ওপার
“আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম, স্বপ্নে দেখা নিজসত্তার অভাগা, অসহায় আবছায়াকে আমি ভালোবেসেছিলাম। আবছায়ার লজ্জা, ক্রোধ, পাপবোধ ও বিষণ্ণতা অনুভব করে দমবন্ধ হয়ে আসার মতো, কোন বন্য পশুকে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাতে দেখে লজ্জায় ডুবে যাওয়ার মতো বা নিজের বখে যাওয়া পুত্রের স্বার্থপরতায় ক্রোধান্ধ হয়ে ওঠার মতো তীব্র ছিল সেই ভালোবাসার অনুভূতি। তার প্রতি আমার ভালোবাসায় সবচেয়ে বেশি ছিল সম্ভবত আমার নিজেকে জানার নির্বোধ বিতৃষ্ণা ও আনন্দ।”
মজার ব্যাপার এই বইটা শেষ হয়ে
যাওয়ার পরেও আমি বুঝতে পারছি না কি লিখব, কী-বোর্ডে হাত চলতে চাইছে, শব্দ হাতড়ে
হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আর খুঁজে চলেছি সঠিক শব্দবিন্যাসের।
তার মানে কি এই ‘The White Castle’ তথা
‘সফেদ দুর্গ’ বইটা একটা অসাধারণ বই?
এই প্রথম বলছি, সজ্ঞানে বলছি, আমি
জানি না।
নিজের কাছে নিজেই যখন একটু একটু
অপরিচিত, এবং সেই অপরিচয়ের বোঝা বইতে বইতে যখন নিজের সাথেই একদিন দেখা হয়ে যায়,
এবং সেই অন্য ‘আমি’ আর এই ‘আমি’তে মিলে একটা বন্দোবস্ত হয়, আস্তে আস্তে সহাবস্থান
হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং অবশেষে অনেক মিলে-অমিলে স্বীকার করে নিতেই হয় যে সেই
চিনেও অচেনা, জেনেও অজানা, এবং দেখেও অদেখা হয়ে থাকা মানুষটাকে আমি ভালবেসে
ফেলেছি, এবং আস্তে আস্তে সমাজ, রাজনীতি আর ধর্মনীতির রঙ মেখে মেখে এমন এক অচিনে
রঙের আবিলতায় আর মর্মস্পর্শী সংঘর্ষের পরেও আমি অবশেষে তাকেই ভালোবেসে ফেলেছি, তখন
না চাইতেও তার সাথে সহাবস্থান করাটাই আপাত মঙ্গল, অস্তিত্বের জন্যে মঙ্গল, তখন তা
না করে আর উপায় কি?
বুঝলেন না তো?
কি করে বোঝাই?
এক ইতালীয় যুবক ভ্রমণকালে তুর্কী
নৌবহরের হাতে ধরা পড়ে। সময়টা সপ্তদশ শতক। তাকে নিয়ে আসা হয় ইস্তাম্বুলে। বন্দী
বিজাতীয় খ্রীষ্টান মানুষটি এর-ওর হাত ঘুরে অবশেষে ভৃত্য হয় যার, মানে ক্রীতদাস হয়
যার, তাকে দেখতেও একেবারে তারই মতো। তার নাম ‘হোজা’। মানে বুঝুন, এই ‘হোজা’ আর তার
ক্রীতদাস আসলে একই রকম দেখতে। তবে দুজনে দুই প্রান্তের, দুই ধারার। প্রভু মুসলমান,
ভৃত্য খ্রীষ্টান। পরম সংকটে আস্তে আস্তে ধর্মকে জলাঞ্জলি না দিয়েও তারা পরস্পর
পরস্পরের কাছে আসে। এবং ওরহান পামুক যে কারণে বিখ্যাত, সেই একই পূর্ব-পশ্চিম
দ্বন্দ্ব, এবং সেইসাথে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বের ঘোরে ফেলে দেয় পাঠক-পাঠিকাকে।
এই দ্বন্দ্বে উঠে আসে নিজের সাথে
নিজের দ্বন্দ্ব। এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের চিন্তাভাবনার দ্বন্দ্ব, ধর্মের সাথে
বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব, মানবধর্মের সঙ্গে অমানবিকতার দ্বন্দ্ব, রাজনীতির সাথে সমাজনীতির দ্বন্দ্ব, প্রাচ্যের
সাথে পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব। যদিও এই প্রাচ্য সে অর্থে এশিয়াটিক প্রাচ্য নয়, এবং
অতি অবশ্যই নিজের সাথে নিজের দ্বন্দ্ব, নিজের মনের সাথে আরেকটা মনের সংঘর্ষ। যেখানে এই সংঘর্ষে জন্ম
নেয় কল্পনা, আর কল্পনা সময়বিশেষে জন্ম দেয় বিভিন্ন গল্পগাথা, বিকার, বীভৎসতা এবং
প্রেম। এবং নিঃসঙ্গতা। এবং নিরাপদহীনতা।
“আমি অনুভব করলাম যে নিঃসঙ্গতা
তার উপর যতই ভারী হয়ে চেপে বসেছে ততই সে আরও বেশি করে আমার ক্ষতি করতে চাইছে। আমার
ও তার নিজের মুখের উপর আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে আমাদের অপার্থিব সাদৃশ্য থেকে উদ্ভূত
আতঙ্কের সাহায্যে সে আমাকে সন্মোহিত করতে চাইছিল। এই কাজ করতে গিয়ে সে নিজেই আমার
থেকে অধিকতর উত্তেজিত ও অস্থির হয়ে উঠছিল আর আমার ততই মনে হচ্ছিল যে সে অশুভ কিছু
একটা করতে চাইছে।”
The white Castle এর
বাংলা অনুবাদ ‘সফেদ দুর্গ’। তপোব্রত দাস এর অনুবাক। বেশ সুন্দর অনুবাদ করেছেন।
খুঁজছিলাম, ইনিও এপার বাংলার কি না। দেখলাম তিনি কলকাতানিবাসী। ভাবছি, আসলেই
হচ্ছেটা কি? কলকাত্তাই প্রকাশকবর্গের বেনেরা কি বেশ কিছু নির্দিষ্ট মানুষের দয়ায় জীবন
কাটাতে চাইছেন? না কি অর্থ দিয়ে ছাপানো বইয়ের ওপর ভিত্তি করে লাভজনক ব্যবসা ফেঁদে
বসার নিরাপদ আকাঙ্ক্ষায় এইসব মানষদেরকে গঙ্গাপাড়ে বিসর্জন দিচ্ছেন? আর এনারা
পদ্মাপাড়ে ভেসে উঠে ওখানে মণিমুক্তা ছড়িয়ে আসছেন। আর আমরা, পাঠকবর্গীয় সমাজ, এইসব
কলকাত্তাইয়া প্রকাশকবর্গের বা বইবিক্রেতাবর্গের পায়ে সেধে কিঞ্চিৎ অধিক মূল্যেই পুনরায়
গঙ্গাপাড়ে আকাশপথে বইগুলো আনার ব্যবস্থা করে পড়তে বাধ্য থাকছি। একেই কি বলে ঘোর কলিকাল?
জানি না তপোব্রতবাবু ফেসবুকে আছেন কি না। সত্যিটা তিনিই জানেন আর সন্দেশ
পাবলিকেশানই জানে। তবে এমন অনুবাদ হলে অনুবাদ সাহিত্যও সুখপাঠ্য এবং অবশ্যপাঠ্য
হয়ে ওঠে। এজন্যে তার অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রাপ্য।
=============================
ছবি: সমর্পিতা
=============================
সফেদ দুর্গ
ওরহান পামুক
অনুবাদকঃ তপোব্রত দাস
সন্দেশ পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ২৪০ টাকা
Comments
Post a Comment