মৃত্যুহীন কালের গহীন সমুদ্রে



প্রথম পর্ব
========

বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কি শুধুমাত্র বিজ্ঞানীর অবদান থাকে? মোটেই না। বিজ্ঞানের যারা পৃষ্ঠপোষকতা করেন তারাও নিঃশব্দ বিপ্লবে সহায়তা করেন। জেমস ওয়েব তাদেরই একজন। কেনেডির সময়ের এই রাজনীতিবিদ কেনেডিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র চাঁদে মানুষ পাঠালে হয়তো তাৎক্ষনিকভাবে জনমনের সমর্থন আদায় করতে পারবেন, কিন্তু ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের জন্য আরোও কিছু করা দরকার। আরোও বড় কিছু। এতএব ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত তিনি নাসার স্পেস এজেন্সিকে সামলান এবং নাসা তার প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হাব্‌লের উত্তরসূরীরূপে যে নতুন ও শক্তিশালী স্পেস টেলিস্কোপ নির্মান করা হয়, তার নাম এই জেমস ওয়েবের নামেই রাখা হয়।


       এই টেলিস্কোপ আদতেই প্রচন্ড শক্তিশালী। প্রথম ছবিটা লক্ষ্য করলেই এর গঠনগত দিক লক্ষ্য করা যাবে। পথিক গুহ’র ভাষায়, “১৯৯০-এর দশকে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল এই টেলিস্কোপের। তখনই খরচ ধরা হয়েছিল ১০০ কোটি ডলার। ২০২১ সালে যখন এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাড়ি দেয়, তখন খরচ দাঁড়ায় ১০০০ কোটি ডলার। ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইএসএ) এবং কানাডার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (সিএসএ) নাসা-র দিকে আর্থিক সাহায্যের হাত না-বাড়ালে এই টেলিস্কোপ মহাকাশে পাঠানো যেত না।
      ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরেও পৃথিবী এবং সূর্যের তাপ থেকে বাঁচাতে ৫টি পর্দা লাগানো হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে। এক-একটি পর্দার মাপ টেনিস কোর্টের সমান। এই টেলিস্কোপে রয়েছে ১৮টি ষড়ভুজ আয়না। যার সম্মিলিত ব্যাস ৬.৫ মিটার। ঠিক যেমন ভাবে রাতের আঁধারে কোনও কোনও ফুল পাপড়ি মেলে সে ভাবেই ১৮টি আয়না মহাকাশে উন্মীলিত হয়েছে। তা দিয়েই চলেছে ব্রহ্মাণ্ডের অতীতের খোঁজ।

       এই টেলিস্কোপ থেকে মূলত যেক’টা ছবি পাওয়া গেছে, তার থেকে পাঁচটি ছবি নাসার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষত প্রথম ছবিটা প্রকাশ হওয়ামাত্র তা ভাইরাল হয়ে গেছে, অনেক আলোচনাও চলছে। এ থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে কৌতুহল আছে। সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে আমরা এই পাঁচটা ছবিকেই বোঝার চেষ্টা করব --- পর্বে পর্বে।



চিত্র ১:
SMACS 0723


১২ জুলাই, ২০২২, সকাল ১০টা ৩৯মি। প্রথম যে ছবিটা এসে পৌছল নাসার ঘরে তা হল এই ছবিটা। ছবিটা প্রকাশ হওয়ার পরে সবচেয়ে আলোচিত এবং সবচেয়ে উৎসাহ সৃষ্টি করার মতো ছবি। আমাদের ব্রহ্মান্ডের সবচাইতে দূরের ছবি, এযাবৎ সব চাইতে স্পষ্ট ছবি, এবং সব চাইতে গভীরতম ছবি। এ ছবি ইনফ্রারেডে তোলা। এখন সব চাইতে দূরের অর্থ কি? গোদা বাংলায় বললে, যত দূরের আকাশ আমরা দেখতে চেষ্টা করব তা তত সময়ের পিছনে চলে যাব, অর্থাৎ অতীতে যাব। সময়ের সাথে আলোর সংযোগ আছে। আলো যত দূরের সময় তত অতীতের। যত পিছনের আলো আমরা দেখতে পাব, তত পিছনের অর্থাৎ অতীতের মহাকাশকে দেখতে পাব। যে কারণে, ছোটবেলায় আমরা পড়েছি, এমন নক্ষত্রের আলো আমরা এখনও দেখতে পাই, যা হয়তো বর্তমানে ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু অতীতে সেই নক্ষত্র থেকে নির্গত হওয়া আলো আজও আমাদের কাছে এসে পৌছচ্ছে, অর্থাৎ বর্তমানে, আমরা দেখতে পাচ্ছি তাকে, যদিও বর্তমানে তার কোন অস্তিত্ব নেই।

      তবে এ থেকে এমন সিদ্ধান্তে আসাটা ভুল যে, আরোও অতীতে টেলিস্কোপের দৃষ্টি যেতে যেতে একদিন আমরা বিগ ব্যাং বা পৃথিবী সৃষ্টিকে প্রত্যক্ষ করতে পারব। তা কোনদিনই সম্ভব নয়। কারণ বিগ ব্যাং হয়েছিল বিন্দুবৎ অবস্থা থেকে। সেই সময় আলো ছিল না, আর যা ছিল তা ওই বিন্দুবৎ অবস্থার ভেতরে। বাড়ির গেটের সামনে দাড়িয়ে বাড়িটাকে প্রাণভরে দেখা যায়, কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঘরে ঘরে কি চলছে তা দেখা যেমন সম্ভব নয় এও তেমন। অর্থাৎ, ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আদিতম সময়ের কাছাকাছি যেতে পারি, কিন্তু সৃষ্টিমুহূর্ত অবলোকন করা সম্ভব নয়।

এতএব, ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ অতীতের এই আলোকে ধরতে গিয়ে সূদূর অতীতের ব্রহ্মান্ডকে ধরে ফেলেছে। কতটা সূদূর? বিশ্বসৃষ্টির মাত্র ৮০ লক্ষ বছর পরের অবস্থাকে। এখানে যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের কেউই নক্ষত্র নয়, সব এক-একটা গ্যালাক্সি। আমাদের মিল্কি ওয়ে বা আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের যেমন একটা ছোট্ট সদস্য সৌরমণ্ডল তেমন লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সির সমাবেশকেই এখানে দেখা যাচ্ছে।

এ ছবি তুলতে হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপের লাগত বেশ কয়েক সপ্তাহ, ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের লেগেছে মাত্র সাড়ে বারো ঘন্টা। ছবিটার রেঞ্জ মূল ব্রহ্মান্ডের তুলনায় একটা ছোট্ট বালুকণার সমান, যে বালুকণা এক মিলিমিটারের অর্ধেক সাইজের। অর্থাৎ, জুম করতে করতে এতটা দূরত্বের নিখুঁত ছবি তোলার ক্ষমতা রাখে এই টেলিস্কোপ। হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপের, বলা বাহুল্য, এ ছবি তোলার ক্ষমতা নেই।

এই গ্যালাক্সির সমাবেশকে ‘ক্লাস্টার’ বলা হয়। অর্থাৎ, অনেকগুলো গ্যালাক্সির একত্রিত পাশাপাশি অবস্থান। ছবির মাঝখানে এমনই একটা গ্যালাক্সির ক্লাস্টার আছে। ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগের এই গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের অবস্থাকে আমরা দেখতে পারছি। একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বেশ কিছু গ্যালাক্সি কেমন যেন বেঁকে গেছে অর্থাৎ Bend করেছে এবং একটা গোলাকৃতির মতো দৃশ্যায়ন তৈরী করেছে। অর্থাৎ, এই বাঁকগুলোকে একত্রিত করলে একটা গোলাকার লেন্সের মতন আকার নিচ্ছে। এটাই ছবিটার আসল সৌন্দর্য।

এই লেন্সের আকার ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের লেন্সের কারণে হয় নি। যেমনটা মাঝে মাঝে আমাদের ক্যামেরায় হওয়ার সম্ভবনা থাকে আর কি। আসলে গ্যালাক্সিগুলোর এই বক্রগতি গ্যালাক্সির ক্লাস্টারের মাধ্যাকর্ষণজনিত বলের কারণে হয়েছে, যাকে আমরা বলছি ‘গ্র্যাভিটেশনাল লেন্স’। এই লেন্স আসলেই আরোও গভীরের ব্রহ্মান্ডকে দেখিয়ে দিচ্ছে। ফোকাস আরোও তীক্ষ্ণ করছে। লেন্সের মাঝখানে যে সমস্ত ছোট ছোট বিন্দুবৎ জিনিস দেখা যাচ্ছে সেগুলো কিন্তু শুধুমাত্র এই টেলিস্কোপে দেখতে পাওয়া যেত না। এই গ্রাভিটেশনাল লেন্সের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে।

কি দেখছি ওই লেন্সের ভিতর দিয়ে তাকালে? রিসার্চ তো সবে শুরু হল। হয়তো বা গ্যালাক্সির ভর, বয়স, ইতিহাস এমনকি গঠনগত উপাদান সম্পর্কে এতদিন আমাদের যা ধারণা ছিল তা এবার বদলে যেতে শুরু করবে। নতুন দিশা আসবে আইনস্টাইন আর হকিন্সের পর।



চিত্র ২ – এক্সোপ্ল্যানেট WASP – 96B


এই ছবিটার গ্রাফ দেখে মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা যায় না। কিন্তু গ্রাফ যখন আছে, তখন বলতে হবে গ্রাফের পিছনে এমন একটা কিছু বস্তু আছে যার গ্রাফিকাল পিকচার হল এইটা। ছবিতে আর কিছু বুঝি না বুঝি কতকগুলো যায়গায় যে জল কথাটা ইংরাজীতে লেখা আছে এ বেশ বোঝা যায়। অর্থাৎ, গ্রাফ বলতে চাইছে, এগুলো জলের চিহ্ন। অর্থাৎ, মহাবিশ্বে কোন একটা জায়গায় জলের অস্তিত্ব আছে।

ভালো কথা, কিন্তু জিনিসটা কি?

জিনিসটা একটা এক্সোপ্ল্যানেট।

এক্সোপ্ল্যানেট কি?

উইকির মতে, বহির্গ্রহ বা Exoplanet বা Extrasolar planet বলতে সৌরজগতের বাইরের যে কোন গ্রহকে বোঝায়। বাংলায় এদেরকে বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহ বা বহির্জাগতিক গ্রহ  নামেও ডাকা হয়। ১ নভেম্বর, ২০২১ পর্যন্ত মোট ৪,৮৬৪ টি বহির্গ্রহ পাওয়া গেছে। ২০১২ সালের একটি গবেষণায় জানা গেছে যে, আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথের প্রায় ১০০ বিলিয়ন তারার প্রতিটিতে গড়ে অন্ততপক্ষে ১.৬টি করে গ্রহ আছে। সে হিসেবে কেবল আকাশগঙ্গাতেই প্রায় ১৬০ বিলিয়ন তারকাবদ্ধ (তারার মহাকর্ষীয় শক্তিতে আবদ্ধ) গ্রহ থাকার কথা। অন্যদিকে কোন তারার সাথে মহাকর্ষীয়ভাবে আবদ্ধ নয় তথা মহাশূন্যে মুক্তভাবে ভাসমান নিঃসঙ্গ গ্রহের সংখ্যা আমাদের ছায়াপথেই হতে পারে প্রায় কয়েক ট্রিলিয়ন

অনেক শতাব্দী ধরেই বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা বহির্গ্রহের সম্ভাব্যতার কথা বিবেচনা করে আসছেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা কতো বা সৌরজগতের গ্রহগুলোর সাথে তাদের মিল কতটুকু তা জানার কোন উপায় ছিল না। কিছু বহির্গ্রহের ছবি সরাসরি দুরবীন দিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে যদিও অধিকাংশ বহির্গ্রহই আবিষ্কৃত হয়েছে অরীয় বেগ বা অন্যান্য পরোক্ষ পদ্ধতিতে।

শুধু জল নয়, জলীয় বাস্প ও জলীয় ধূলিকণার অস্তিত্বও বিদ্যমান। কোথায় আবার? ওই এক্সোপ্ল্যানেটে, থুড়ি গ্রহে। যে গ্রহটা সূর্যের মতন একটি বড় নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরছে।

কয়েকশো আলোকবর্ষ দূরে থাকে একটি গ্রহ থেকে আগত আলোকরশ্মিকে বিশ্লেষণ করে জলের অস্তিত্ব বলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখছে যে টেলিস্কোপ তার ক্ষমতা সম্পর্কে এবার বলা যাক। হাব্‌ল স্পেস টেলিস্কোপ গত কুড়ি বছর ধরে এমন অনেক এক্সোপ্ল্যানেটের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের তথ্য দিয়েছে। কিন্তু জলের সন্ধান? সেটার স্পষ্ট করে প্রমান দিয়েছে এই ২০১৩ সালে। আর ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ? চালু হওয়ার পরেই দ্বিতীয় ছবিই ছিল তার এইটা!

সেই প্ল্যানেটে জীবন আছে কি না বা ‘প্যাসেঞ্জার’ সিনেমার মতো বসতি স্থাপন করা যাবে কি না, তা ভবিষ্যৎ-ই বলতে পারবে। আপাতত এ ব্যাপারে আরোও এক কদম এগোনো গেল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।

 



চিত্র ৩ --- নেব্যুলা NGC 3132


ছবিটা দেখেই ‘আহা আহা’ করে উঠেছিলাম। কী অপূর্ব নেব্যুলা! নেব্যুলা বা নীহারিকা কি? সেটা আগে বলি। উইকিপিডিয়া এবং মহাকশবিজ্ঞান নামক দুটি সাইটের সূত্র ধরে বলা যেতে পারে যে, নীহারিকা ধূলিকণা, হাইড্রোজেন গ্যাস এবং প্লাসমা দ্বারা গঠিত একধরনের আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘএকসময় নীহারিকা ছিল ছায়াপথ সহ যে কোন ধরনের বিস্তৃত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুর সাধারণ নাম যা আকাশগঙ্গার বাইরে অবস্থিত। যেমন: বর্তমানে উল্লেখিত এনড্রোমিডা ছায়াপথের পূর্ব নাম ছিল এনড্রোমিডা নীহারিকা।

নীহারিকা সৃষ্টি হয় মৃত নক্ষত্রের অতিনবতারা বা সুপারনোভা বিস্ফোরনের মাধ্যমে নিক্ষিপ্ত হওয়া গ্যাস এবং ধূলিকনা থেকে। আবার নতুন নতুন নক্ষত্র সৃষ্টির অঞ্চলকেও নীহারিকা বলা হয়। নীহারিকার নির্দিষ্ট কোন আকৃতি নেই। শূন্য মাধ্যমের তুলনায় এ অঞ্চলের ঘনত্ব অনেক বেশি। নীহারিকার তাপমাত্রা থাকে অনেক বেশি। কারন, এদের ভেতরে ও আশেপাশে থাকা নক্ষত্র থেকে বিকিরিত তাপেই এরা উত্তপ্ত হয়। যদি নীহারিকার আশেপাশে নক্ষত্র না থাকতো তবে এরা ঠান্ডা থাকতো। নীহারিকার রং হয় অনক ধরনের তবে লক্ষনীয় রং হলো, লাল, নীল, কমলা, সবুজ। বলা যেতে পারে মহাকাশের সবচেয়ে সুন্দর জ্যোতিষ্ক এরা।

ছবিতে নেব্যুলার রিঙয়ের মাঝখানে যে নক্ষত্রটি দেখা যাচ্ছে ওটাই আসলে হাজার বছর ধরে ধুলো আর গ্যাস উদ্‌গীরণ করছে গোলকের আকারে তার নিজের চারদিকে। আসলে এই প্রথম কোন টেলিস্কোপ এত স্পষ্ট করে এটা প্রমাণ করল। তারাটি আসলেই গ্যাস আর ধূলোর মাঝখানে নিজেকে ঢেকে রেখেছে।

টেলিস্কোপের দুটো ক্যামেরা এই প্ল্যানেটারি নেব্যুলার এত সুষ্পষ্ট ছবি তুলেছে। এর যা খটোমটো সংখ্যাগত নাম তা মনে রাখা দুষ্কর, আমরা এটাকে বলি ‘সাউদার্ন রিং নেব্যুলা’। আমাদের থেকে প্রায় ২৫০০ আলোকবর্ষ দূরে আছে এই নেব্যুলাটা।।

আসলে এই মেঘ, গ্যাস, ধূলো সবই মৃতপ্রায় নক্ষত্র থেকে উদগীরিত হওয়ার দরুন এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। টেলিস্কোপ যত নিখুঁতভাবে ছবি তুলতে সক্ষম তত সুন্দরভাবে আমরা এর বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হব। বুঝতে পারব কি কি কণা বা কীসের কীসের অনু এর মধ্যে রয়েছে, কতটা পরিমাণে রয়েছে, এবং এই গ্যাসের গোলার মধ্যে কোন কোন জায়গাতেই বা তারা অবস্থান করছে। ফলে এই নেব্যুলা এবং এর মতোই আরোও লক্ষকোটি নেব্যুলা সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও পরিস্কার করবে।


চিত্র ৪ – স্টিফেন’স কুইন্টেট


পাঁচটা গ্যালাক্সির সমাহার। পাঁচ-পাঁচটা, টেলিস্কোপের রেঞ্জ হিসাবে প্রায় কাছাকাছি। ছবিতে যেমন দেখছি আমরা আর কি, একেই বলে স্টিফেন’স কুইন্টেট।

আমাদের চাঁদের ব্যাসের এক পঞ্চমাংশ হল ছবিটার রেঞ্জ। এই রেঞ্জের মধ্যে এত সুন্দর, এত স্পষ্ট, এত উজ্জ্বল আর কোন ছবি আজ পর্যন্ত ওঠেনি। ১৫০ মিলিয়ন পিক্সেলের এই ছবিটা সম্পূর্ণ করতে ১০০০টা ছবির সমন্বয় ঘটাতে হয়েছে। ছবিটা আদিম ব্রহ্মান্ডের গ্যলাক্সিসমূহ নিজেদের মধ্যে কিভাবে টক্কর লাগায় বা কীভাবে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়, বা বিচ্ছিন্ন হয় তার বিবর্তনকে বুঝতে সাহায্য করবে। এবং হয়তো বা কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে আরোও বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবো।

ইনফ্রারেডের সাহায্যে উচ্চ রেসোলিউশানে তোলা হয়েছে এই ছবি। গ্যালাক্সি গ্রুপের এমন বিস্তারিত ছবি আর আগে পর্যন্ত দেখা যায় নি। ক্লাস্টারগুলোর মধ্যে লক্ষ লক্ষ নতুন নক্ষত্রের সমাবেশ দেখা যাচ্ছে। যারা সদ্যোজাতও বটে। প্রায় প্রত্যেকটা গ্যালাক্সি থেকে লেজ বেরিয়েছে, যেগুলো ধুলো আর গ্যাসের মহাসমাহার। মহাকর্ষীয় বলের কারণেই মূলত এই টানাটানি।

মজার ব্যাপার, ছবিটার প্রায় মাঝখানেই রয়েছে, যাকে বলে সুবিশাল ঘাত তরঙ্গ বা  Shock Wave. জিনিসটা কি একটু জানা যাক। উইকি বলছে, পদার্থবিজ্ঞানে ঘাত তরঙ্গ বা শক ওয়েভ বলতে চারপাশে ছড়িয়ে পড়া এক বিশেষ ধরনের তরঙ্গ বোঝায় যার বেগ উক্ত মাধ্যমের শব্দের বেগের চেয়েও অধিক। সাধারণ তরঙ্গের মতো ঘাত তরঙ্গও এক স্থান হতে অন্য স্থানে শক্তি সঞ্চালন করে কিন্তু পার্থক্যটা হলো ঘাত তরঙ্গ সংঘটিত হয় আকস্মিকভাবে ও এই তরঙ্গটি অবিচ্ছিন্ন এবং মাধ্যমের ধর্ম যেমন চাপ, তাপমাত্রাঘনত্বের উপর নির্ভরশীল। কোনো তরঙ্গের সুপারসনিক প্রবাহের সময় অতিরিক্ত তরঙ্গ এক্সপ্যানশন পাখার মাধ্যমে সৃষ্টি করা যায় যা পরবর্তীতে ঘাত তরঙ্গের অভিমুখী হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় অথবা একীভূত হয়। এর ফলে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার সৃষ্টি হয়। ঘাত তরঙ্গের ফলে উচ্চ শব্দশক্তি উৎপন্ন হয় যা সনিক বুম বা শব্দাঘাত নামে পরিচিত। সনিক বুম তখনই উৎপন্ন হয় যখন বায়ু মাধ্যমে কোনো বস্তু শব্দের চেয়ে বেশি বেগে গতিশীল হয় এবং এটি সংঘটিত হওয়ার অন্য একটি কারন গঠনমূলক ব্যতিচার।

মোদ্দা কথা, এই পঞ্চপান্ডবের দাপটের খবর আমাদের দ্রৌপদী টেলিস্কোপটি আরোও কি খবর দেন তা জানার অপেক্ষায় রইলাম আমরা।

 


চিত্র ৫ – ক্যারিনা নেব্যুলা – নক্ষত্রের আঁতুড়ঘর


আমার দেখা এ পর্যায়ের সর্বাধিক সুন্দর ছবি। একটা মেঘ। একটা ধুলোর মেঘ। ছবির অধিকাংশ অঞ্চলটাকে জুড়ে রয়েছে। সে মেঘের ভিতরে লক্ষ কোটি তারার ঝলকানি। এ নক্ষত্র নতুন নক্ষত্র। জন্মলগ্নের সময়কার নক্ষত্র। ধূলোর সমষ্টি হয়তো আরোও অনেক নক্ষত্রের সৃষ্টি করবে। তারই একটা প্রমাণ, এবং সুন্দর সুষ্পষ্ট প্রমাণ এই নক্ষত্র।

পাহাড়ের ধাপের মতন এবং উপত্যকার মতন ছড়িয়ে পড়া অঞ্চলটিতে তৈরী হচ্ছে নক্ষত্র। যার নাম NGC 3324ক্যারিনা নেব্যুলার অন্তর্গত এই অঞ্চলটাতে তৈরী হচ্ছে এক সুন্দর নক্ষত্র। এই ধুলো, গ্যাস মহাকর্ষীয় আকর্ষণে কাছাকাছি এসে উচ্চচাপে এবং উচ্চতাপে তৈরী হবে শিশু নক্ষত্র। সে বড়ো হবে। যুবক বা যুবতী হলে তার তেজ বাড়বে। তারপর মধ্যবয়সে আরোও আরোও তাপ ও আলো বাড়বে। আশেপাশের সমস্ত বস্তুকে পুড়িয়ে বা গিলে খাবে। আর সবশেষে বার্ধক্যে এসে আবার নেব্যুলায় পরিণত হবে, কিম্বা কৃষ্ণগহ্বরে। নেব্যুলার পরিণতি সেই গ্যাস এবং ধুলিকণা, যা থেকে আবার তৈরী হবে নতুন নক্ষত্রের। এই জন্ম-মৃত্যুর ধারা চলতে থাকবে, চলতেই থাকবে...

এই ছবিটা আসলে একটা কসমিক ক্লিফস। ত্রি-ডাইমেনশনাল ছবি এত সুন্দরভাবে এর আগে পাওয়া যায় নি। ছবিটা আসলেই দৈত্যাকার নেব্যুলার একটা ছোট্ট অংশ। পর্বতের মতো দেখতে এই ছবিটার যে সর্বোচ্চ চূড়াটা দেখা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্যই ৭ আলোকবর্ষের সমান। চূড়াটার পরেই যে খাদ দেখা যাচ্ছে, যেন একটা ঢেউ খেলে যাওয়া বক্ররেখা, সেটার কারণ সুতীব্র আল্ট্রাভায়োলেট রেডিয়েশান এবং নাক্ষত্রিক ঝড় বা stellar winds. ওখানে চলছে টানাপোড়েনের দামালপনা, এক অতীব মরণান্তিক মারন-উচাটন। সেই বীভৎসতায় তৈরী হচ্ছে এমন ব্রহ্মাণ্ডীয় সৌন্দর্য, যার রূপে আমরা হচ্ছি মুগ্ধ।

উপত্যকার মতন অংশটিতে রয়েছে বুদ্বুদ, যার প্রত্যেকটার মাঝে রয়েছে একটা করে নক্ষত্র। অত্যন্ত উচ্চতাপে গঠিত নবীন নক্ষত্রের সমাহারে গঠিত হয়েছে ছবিটার এই অংশটা। এককথায় এ হল নক্ষত্রের আঁতুড়ঘর। এরকমই এক আঁতুড়ঘরে জন্ম আমাদের সূর্যের।

 

মোট কথা এই হল, পাঁচটি ছবির মূলভাব। কতটুকু কি বোঝাতে পারলাম জানি না, তবে এটুকু বলতে পারি, এ যদি শুরু হয়, না জানি এরপরে আরোও কি কি আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। 

সবে তো শুরু হল। পিকচার অভি ভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত...

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে