একটি রক্তিম আলেখ্য
উপন্যাসটা একটি মার্ডার
মিসট্রি। সূচনায় একটি খুন, মধ্যপর্বে আরেকটি খুন। উপন্যাসের বিষয়ঃ চিত্রশিল্পে
পাশ্চাত্য এবং প্রাচ্যের দ্বন্দ্ব। স্থানঃ ইস্তাম্বুল। গল্প শুরুই হচ্ছে, যিনি মৃত
তিনি কুয়োর মধ্যে পড়ে থাকা অবস্থা থেকে কথা বলা শুরু করা থেকে।
এই উপন্যাস ৫৯ পর্বের। প্রত্যেক পর্বে আলাদা আলাদা করে চরিত্রেরা এসে কথা বলছে, মৃত কথা বলছে, চিত্র কথা বলছে, শয়তান কথা বলছে, মৃত্যুচেতনা থেকে মূমুর্ষু কথা বলছে, প্রেমিকা কথা বলছে, এমনকি খুনী নিজেও কথা বলছে, এবং এইভাবেই ঘটনার জাল বোনা হচ্ছে। এক-এক সময় রুদ্ধশ্বাসে ঘটনার গতিপ্রকৃতি মোড় নিচ্ছে অভিনব দিকে। চরিত্রগুলোর একে অপরের সাথে চিন্তাধারার সংঘর্ষে যে টানটান উত্তেজনা তৈরী হচ্ছে, তা বইয়ের শেষ পর্যন্ত বজায় থাকছে। লেখাটার সৌন্দর্য এটাই যে, যখন খুনী নিজে কথা বলছে, এমনকি দ্বিতীয় খুনটা করার বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছে নিজের জবানবন্দীতে তখনও আপনি জানতে পারবেন না আসল খুনী কে? আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে ৫৮ পর্ব পর্যন্ত।
কিন্তু এটাই
কি সেই বই, যার জন্যে ওরহান পামুককে নোবেল দেওয়া হয়েছিল?
হ্যাঁ, এবং না।
ওরহান পামুক
গল্পের জাল বুনছেন ১৫৯১ সালের অটোমান সাম্রাজ্যের ইস্তাম্বুলের চিত্রধারাকে
কেন্দ্র করে। মাত্র নয়টি দিনের গল্প। ওরহান পামুক জাল বুনছেন তথাকথিত সময়ের
রাজনৈতিক ধর্মান্ধতায় ঘটে যাওয়া রহস্যময় খুনের প্রেক্ষাপটে। আসলে, ওরহান পামুক
প্রশ্ন তুলছেন প্রাচ্য বনাম পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার সংঘর্ষকে নিয়ে। ওরহান পামুক
উত্তর খুঁজছেন ধর্মের নৈতিকতার আশ্রয়ে থাকা শিল্পের সর্বার্থকতার প্রশ্নে।
এমনটাই তো হয়।
এমনটাই তো চলেছিল একটা সময়। ইতিহাস সাক্ষী। আমাদের এখানেও কি তার ঢেউ আসে নি?
বুর্জোয়াবাদ নিপাত যাক, সাম্রাজ্যবাদ নির্মূল হোক --- এইসব রব কি একদিন ওঠেনি? পাশ্চাত্যের
উদ্দামতাকে সাম্যবাদের প্রশ্নে মুখোমুখি করে বাধা দেওয়ার চেষ্টা কি করা হয় নি? প্রাচীন
সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে ‘সনাতন’ আখ্যা দিয়ে, তাকেই একমাত্র সমাজজীবনের মানদণ্ড করে অতীতকে
‘গ্লোরিফাই’ করে বর্তমানের অগ্রগতিকে ঠেকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা কি করা হয় নি?
কিম্বা পাশ্চাত্যের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে প্রাচ্যের জনজীবনে নিয়ে এসে কোথাও সমাজ ও
পরিবারের ভারসাম্যকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করছি না?
করছি তো।
কোনটা ঠিক
আর কোনটা ভুল? ওরহান পামুক এরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন তার ‘মাই নেম ইস রেড’
বইতে, চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রকে প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে, ষোড়শ শতকের অটোমান সাম্রাজ্যকে
সামনে রেখে।
আমি ছবি বা
চিত্রকলা খুব একটা ভাল বুঝি না। তবুও আমি যখন বইটা পড়ছি, কোথাও মনে হচ্ছে না যে
আমি এই বইটা পড়ব কেন? চিত্রকলার আমি কি-ই বা বুঝি? তবুও অনায়াসেই পড়েছি। ছবি নিয়ে
কি কোন কচকচানি এই উপন্যাসে নেই? আছে। পাতার পর পাতা জুড়ে আছে। কিন্তু সেই
কচকচানির মূল উপজীব্য বিষয়ই হল প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব। যখন আপনি
চিত্রশিল্পকে সরিয়ে দিয়ে শিল্প বা আর্টকে সামনে রেখে বইটা পড়বেন, আপনি নিজেই এই
প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবেন।
ওরহান
পামুকের এই লেখার মধ্যে দস্তয়েভস্কির ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’-এর ছাপ আছে। কাফকার
‘ট্রায়াল’-এর ছাপ আছে। কিন্তু তাকে ছাড়িয়ে আছে তার অনবদ্য লেখনশৈলী। না জানি কতদিন
ধরে ধীরে ধীরে তিনি বুনেছেন প্রত্যেকটা পর্বকে। না জানি কত কাটাছেঁড়া করেছেন এই
বইটার প্রতিটা লাইনকে। না জানি কত সময় নিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন প্রেম, ঈর্ষা,
ধর্ম আর শিল্পের এই চিরকালীন টানাপোড়েনকে। এক-একটা দৃশ্যপট আমাকে মুগ্ধ করে।
দ্বিতীয়বার করে পড়তে বাধ্য করে। আবার এক-একটা কাহিনীর মোড়ে বা শ্বাসরুদ্ধকর
গতিময়তাতে থমকে যেতে হয়। বই বন্ধ করে ভাবতে হয় খুনী কে? কেনই বা এই খুন? আবার কথোপকথনের
তীব্র বাদানুবাদে চুপ করে বারংবার দুটো লাইনের মাঝখানের ইঙ্গিতগুলোতে বিদ্ধ হয়ে বই
বন্ধ করে দিতে হয়।
বইয়ের
অনুবাদ করেছেন অমর মুদি। কেউ যদি ওরহান পামুক নামটা সরিয়ে অমর মুদির ‘আমার নাম
লাল’ দিয়ে বইটা ছাপাতো, বোঝার উপায় থাকত না যে এটা অনুবাদ। প্রত্যেকটা বাক্য এত
যত্ন নিয়ে অনুবাদ করেছেন তিনি। এমন মর্মার্থে যদি অনুবাদ হয় তাহলে আমাদের মূল বইটা
না পড়তে পারার দুঃখ চলে যায়। মূল বইটা লেখা হয়েছে তুর্কী ভাষায়।
কিন্তু, ঝটকা লাগল ‘প্রাক্ কথন’-এ। অমর মুদি কি দিল্লী থাকেন? তাই তো লেখা আছে। রাগ হল, কষ্ট হল, বেদনা হল। দিল্লীর একজন মানুষ, তার এমন সার্থক অনুবাদ প্রকাশ করার জন্য তাকিয়ে থাকতে হল বাংলাদেশের ‘সন্দেশ’ পাবলিকেশানের দিকে। ইন্টারনেটের দৌলতে এটা এখন খুব সহজসাধ্য। কিন্তু একজন বাঙালী ভারতীয়কে তার বই বের করতে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে এখন! আর আমরা, পাঠকেরা পশ্চিমবঙ্গীয় পাবলিশার্সদের নাকিকান্না শুনে শুনে এবং নতুন প্রতিভা আবিস্কার করতে না পারার অক্ষমতা দেখে দেখে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে বাংলাদেশের বই একটু চড়ামূল্যেই অর্ডার দিয়ে আনাতে খুব একটা অপরাধবোধে ভুগছি না। সবশেষে তো আমরা পাঠক। আমরা পাঠকেরা এখনকার যুগে নিজেদের গ্লোবাল সিটিজেন ভাবতেই ভালবাসি। ভালবাসবও...
[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]
Comments
Post a Comment