দিকশূন্যপুরের স্বপ্ন



মাঝে মাঝে আমি একটা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নটা এতবার দেখেছি, এতবার হয়তো দেখবও যে স্বপ্ন আর সত্যি মাঝে মাঝে এক হয়ে যাবে। আমি বিছানায় উঠে বসে চোখ মেলে বোঝার চেষ্টা করব --- আমি কে? আমি কোথায়?

 স্বপ্নটা বলি---

 

আমি একটা মেলার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। নিবিড় ঘন অন্ধকার বনের সামনে এক মেলা। কত হই-হুল্লোড়, কত ভীড়, কত আনন্দ। মেলার মধ্যে কত জানা-অজানা পসরা। মেলার মানুষেরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আমি দূর থেকে দেখছি। তাদের কথা শুনতে পারছি না। অথচ অনুভব করছি, সেই জনসমুদ্রের কলরোল।

মেলায় অনেক কিছু আছে। আমার ছোটবেলার রান্নাবাটি ওই মেলার কোন একটা দোকানে রয়েছে। আমায় কিনতেই হবে। কিম্বা আমার ভাইয়ের প্রিয় সেই কাঠের গাড়ীটা, যার চাকাগুলো ক্যারামের গুটি দিয়ে বানানো। আমায় কিনতে হবে। অথবা গামলার জলে ছেড়ে দেওয়া সেই ভটভটিটা, যে গামলার পাড় বেয়ে শব্দ করে করে ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে। তার থামার যো নেই। পাড়ে নিজেকে বেঁধে রেখে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জো নেই। সে কেবল সন্ধ্যেবেলা থেকে অন্তহীনভাবে পাড় ধরে ধরে ঘুরেই চলেছে। তাকে থামানোর জন্যে আমাকে ভটভটিটা কিনতে হবেই।

সেই গ্যাসলাইটের আলো মনে পড়ে। হ্যাজাক বাতি। বিশ্বাস করুন, সেই কোন ছোটবেলায় আমি হ্যাজাক বাতি দেখেছি। আমি দেখেছি হ্যাজাক বাতির মিঠে আলোর বৃত্তে ঈশ্বর আর শয়তানকে বসে দাবা খেলতে, আর গাঁজা টানতে, আর পরস্পরের দিকে আলো-আঁধারিতে আড়চোখে চোখে দেখতে। তাকে ঘিরে আছে একদল সাধু আর সন্ন্যাসী। যারা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রেখে খেলা দেখছে। তারা তাদের সমস্ত বিশ্বাস বাঁধা রেখেছে এই খেলাতে। জীবনের শুরুতে যে বিশ্বাসের বোঁচকা নিয়ে তারা মাথা উঁচু করে একদিন ঘর ছেড়েছিল, আজ এই সন্ধ্যেবেলায় সেই অবশিষ্টটুকুর সমস্তটা নিলামে তুলে দিয়ে রুদ্ধনিঃশ্বাসে দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে দেখছে একটা বোড়ে কেমন করে একটা ঘোড়াকে মাত করে রাজার দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে।

আমি দেখেছি গ্যাস লাইটের আলোয় একটি বাচ্চা মেয়েকে হারিয়ে যেতে। সে দিশেহারা হয়ে তার মাকে খুঁজছে, তার বাবাকে খুঁজছে। এমনিভাবেই মানুষ মানুষকে হাজার হাজার মানুষের কলরোলের মধ্যে খুঁজছে। সে কি খুঁজছে? তার আশ্রয়ের ঠিকানা? না কি যাযাবৃত্তির আবাহন?

মেলায় অনেক হাঁকডাক, মাকড়সা কন্যার হাঁকডাক। জোকারের হাঁকডাক। ইন্দ্রজালের হাঁকডাক। দোলনার হাঁকডাক। নাগরদোলার হাঁকডাক। আচারের হাঁকডাক। হাওয়াই মেঠাইয়ের হাঁকডাক। পাঁপড়ের হাঁকডাক। অন্ধকারের কানাগলিতে ছেলেধরার হাঁকডাক। আলোকময় প্যান্ডেলের আড়ালে মেয়েধরার হাঁকডাক। সে হাঁকডাকের মাঝে আমার স্থান নেই। আমার মেলায় ঢোকার অধিকার নেই। আমি বনের অন্ধকারে অন্ধকারে মেলার চারপাশে ঘুরছি, ঘুরছি, ঘুরেই চলেছি।

 

কেন আমি মেলায় যেতে পারব না? আমি আমার নাকছাবিটা হারিয়ে ফেলেছি যে! সোনার গিলটি করা হীরে বসানো নাকছাবিটা যে আমাকে পরিয়ে দিয়েছিল, সে বারবার করে বলেছিল, যেন না হারায়। আর আমিই কি না হারিয়ে ফেলেছি অন্ধবনের কোন গোপন গহীন ঝোপের আড়ালে! যে আমার নাকছাবির ঝিলিক দেখে আমায় চিনে নিয়ে কোলে তুলে নেবে, যার কাঁধে মাথা রেখে আমি ঘুমিয়ে পড়ব বনজ্যোৎস্নার মায়াবী আঁধারে ঘেরা পর্ণকুটিরে, সে যে আমারই অপেক্ষায় বনের অন্তরালে অপেক্ষা করছে।

আমি মেলায় যাব, না তার কাছে ফিরে যাব?

বুঝতে পারি না।

কেবল জানি, আমি এই অনন্ত সন্ধ্যের আলো-আঁধারীর মাঝে বনান্ধকারে একবার মেলা দেখছি, একবার আমার নাকছাবিটা খুঁজছি। বনের অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আমার চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। আমি হাতড়ে বেড়াচ্ছি।

আমি আমার একচোখ সন্ধ্যের রক্তিম আলো আর মেলার মায়ামাখা রামধনু আলোতে মিলেমিশে যে অপূর্ব স্বর্গ তৈরী করেছে, সেখানে রেখেছি; আর আরেক চোখে বনের প্রায়ান্ধকার কাঁটাঝোপগুলোকে দুই হাত দিয়ে সরাতে সরাতে, রক্তাক্ত হতে হতে খুঁজে চলেছি আমার নাকছাবিটাকে।

আমার যে কোনোদিকে যাওয়ার যো নেই...

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে