এ কোন সন্ধিক্ষণ?!?



‘টার্নিং পয়েন্টস্‌’ বা ‘সন্ধিক্ষণ’ এ পি জে আব্দুল কালামের আত্মজীবনীর দ্বিতীয় আলেখ্য। প্রথম খন্ড ‘অগ্নিপক্ষ, বা ‘উইংস অফ ফায়ার’-এ তিনি ছিলেন বিজ্ঞানী, মিসাইল ম্যান। এখানে তিনি মূলত রাষ্ট্রপতি। এখন এই দ্বিতীয় বইটা সম্পূর্ণ শেষ করার পর আমার কোথাও মনে হল না, একজন বিজ্ঞানী কথা বলছেন, মনে হল না একজন রাষ্ট্রপতি কথা বলছেন, মনে হল না একজন সমাজ সংস্কারক কথা বলছেন। মনে হল, একজন সাধারণ মানুষ, যে দেশের কথা ভাবে, যে দেশের তথা জগতের উন্নতির কথা ভাবে, যার একটা মিশন আছে, সেই মানূষটি কথা বলছেন, আমাদের কাছে প্রাণপণে তার চিন্তাগুলোকে সমষ্টিবদ্ধ করে রেখে যেতে চাইছেন। আমরা, অর্থাৎ পরবর্তী ভারতের সন্তানেরা।

মিশন ২০২০

এ পি জে মারা গেছেন ২০১৫ সালে। রাজকীয় সে মৃত্যু। শিলং-এ IIMS–এ Creating A Livable Planet Earth – বিষয়ক বক্তৃতা দিতে দিতে ছাত্রদের সামনেই ঢলে পড়েন। ম্যাসিভ হার্ট এটাক। এবং মৃত্যু। এমন মৃত্যুর জন্যে একশো বছরও অপেক্ষা করা যায়।

কিন্তু এ পি জে আজ, ২০২২–এ, জীবিত থাকলে, তার মিশন নিয়ে কি বলতেন? মিশনের কি ‘দফা গয়া’ হয়ে গেছে বলতেন, না কি হতাশায় মাথা নেড়ে আবার শুরু করতেন তার সফর নতুন করে? অবশ্যই দ্বিতীয়টা করতেন। এমন মানুষ হার মানার মানুষ নন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন যে পরিমাণ সংস্কার তিনি ঘটিয়েছিলেন, তা খুব কম রাষ্ট্রপতিই পেরেছেন, বলা ভাল করেছেন। সব মিলিয়ে তার পুরো আত্মজীবনী পড়ার পর যদি তার মূল কাজগুলোতে মনোনিবেশ করা যায়, তাহলে যে যে কাজ চোখে পড়ে তা হল---

১। ভারতের প্রথম ISLV স্থাপন

২। ব্যালেস্টিক মিসাইল টেকনোলজি এবং SLV স্থাপন

৩। IGMDP প্রোজেক্টের সফল পরিণয়ন এবং এর সাহায্যে ‘অগ্নি’ আর ‘পৃথ্বী’র সফল উৎক্ষেপন।

৪। পোখরান পারমাণবিক টেস্ট

৫। ‘কালাম-রাজু স্টেন্ট’ নামক কৃত্রিম অথচ সুলভ করোনারি স্টেন্ট আবিস্কার

৬। LCA প্রোজেক্টের সফলায়ন

৭। যে সব মানুষদের মোটর নিউরোন সংক্রান্ত সমস্যা আছে, তাদের জন্যে হাল্কা ক্যালিপার্স বানানো এবং মূলত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে তা সুলভ করে দেওয়া।

এ তো গেল বৈজ্ঞানিক এ পি জে, আত্মজীবনীর প্রথম অর্ধে আমরা তা বিস্তারিত পড়ে এসেছি। এবার রাষ্ট্রপতি এ পি জে কি করেছেন দেখা যাক, তার দ্বিতীয় বই থেকে পাই ---

১। ই-গভর্নেন্স চালু করা

২। সর্বসাধারণের পরিদর্শনের জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনের একাংশ খুলে দেওয়া

৩। ভেষজ উদ্ভিদ, বাগানে বিভিন্নরকম গাছের সমাহার বাড়িয়ে তোলা

৪। রাষ্ট্রপতি হিসাবে সারা ভারত ও সারা বিশ্বে পরিভ্রমন করা এবং আন্তর্দেশীয় ও অন্তর্দেশীয় বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করা

৫। VISION 2020

 

এই শেষ প্রকল্পটা হল ভারতকে ২০২০ সালের মধ্যে স্বনির্ভর করে তোলা। এবং তা এতটাই সুবৃহৎ পরিকল্পনা ছিল যে উনি চেয়েছিলেন, উক্ত বছরের মধ্যে ভারত উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হোক। এবং তার জন্যে কি কি করতে হবে, রাজনৈতিক নেতা-নেতৃবৃন্দ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ এবং বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রী তথা যুবক সম্প্রদায়কে কি করতে হবে তার একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা তৈরী করে এগিয়ে চলা সুসংহতভাবে।

এই বইয়ের একদম শেষের পর্যায়ে সেই রূপরেখাকে স্পষ্টভাবে লিখে রেখেও গেছেন আমাদের জন্য। যা তার প্রথম লেখা বই ‘ইগনাইটেড মাইন্ডস’-এও কিছুটা পাওয়া যায়।

 

দুর্ভাগ্য, আমরা সফল হই নি। আমাদের প্রতি তার যে বিশ্বাস বা আশা ভরসা ছিল তার অনেকটাই পূরণ হয় নি। উনি থাকলে হয়তো আবার নতুন করে সেই রূপরেখাকে সম্পাদনা করে আবার এগিয়ে চলার জন্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু এখন আর ‘সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই’।

 

কেউ আছে?

উত্তর মেলে না।

 

মূল বইটার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। শুনেছি আনন্দ থেকে বেরিয়েছে এর একটি অনুবাদ। আজ পর্যন্ত আনন্দের যতগুলো অনুবাদ পড়েছি, একটা ক্ষেত্রেও আমার কোন অভিযোগ নেই। আশা করি, এটাও সেই পর্যায়ের হবে। আমি পড়েছি মনোজিৎ কুমার দাসের অনুবাদ। বেরিয়েছে বাংলাদেশের অন্যধারা প্রকাশন থেকে। বেশ ঝরঝরে এবং সুখপাঠ্য।

 =================

[ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা]

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে