সম্পর্কেরা
এক-একটা সময় সম্পর্কেরা বড়ো জ্বালিয়ে মারে। যাকে
আমি চিনি, তাকে আর চিনতে পারি না। সুখের অনুভূতির ছদ্মবেশে যারা আসে হঠাৎ যেন
মুখোশ খুলে তাদের বিকৃত জটিলতা দিয়ে আমায় আঘাত করতে চায়। আমি আহত হই। আমি আহত করি।
কেন এমন টানাপোড়েন? মা বলেন,
হাড়ি-কলসী পাশাপাশি থাকলে ঠোকাঠুকি লাগবেই। তা বলে কি রান্নাঘর থেকে একটাকে বিদায়
করে দিতে হবে?
মায়ের কথা যদি মানি, তাহলে বলতে
হবে সম্পর্কের এই টানাপোড়েন নিয়তির অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু যদি এখনকার সময়ে বিচার
করা যায়, তাহলে বলতে হাড়ি আর কলসীকে আলাদা আলাদা তাকে রাখাই ভবিষ্যত নিয়তি।
অনেক সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে।
চারপাশে আমি যেন ভাঙনের শব্দ শুনতে পাই, ভাঙন দেখতে পাই। যারা নিজের পায়ে
দাড়িয়েছে, তারা আর সম্পর্কের দোটানায় থাকতে রাজী নয়। অর্থনৈতিক দৃঢ়তা মানুষকে
বেঁচে থাকার স্বাধীনতা দেয়, গলা তুলে কথা বলার স্বাধীনতা দেয়, প্রতিবাদের ভাষা
যোগায়। বিশেষত মেয়েদের।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়ে, যে কোন সম্পর্কেই
একজন হবে Dominant, আর একজন হবে Submissive। যে ডমিন্যান্ট, তার যেন
অধিকার আছে যা খুশি করার, যতটা আঘাত দিয়ে কথা বলা যায় কথা বলার এবং সবশেষে এমনভাবে
ঘুমাতে যাওয়ার যেন কখনও কোন কিছুই হয় নি। এরা নিজেদের দোষ নিজেরা যদি স্বীকার করে
তাহলেও তাকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে হবে, আহা! তুমি পরিস্থিতির শিকার। সমাজ যেন
তাদের লাইসেন্স দিয়েছে পাশের মানুষটার সাথে যথেচ্ছাচার করার। পুরুষ এমনটা হলে
মেয়েরা পিষে যায়, আর মেয়েরা এমনটা হলে পুরুষ পিষে মরে।
অন্যপক্ষে, যে সাবমিসিভ, সে যেন
ধরেই নেয়, আমি লাঞ্ছিত, আমি বঞ্চিত। কেন? তার যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই! সে যদি
মানসিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে বা সামাজিকভাবে সুদৃঢ় জায়গায় না থাকে তাহলে আশ্রয়
হারাবার ভয়ে মুখ বুজে থাকে। যে দোষ তারা করে না, সে দোষও তাদের ঘাড়ে অনায়াসে
চাপিয়ে দেওয়া যায়। তারা মুখ বুজে সহ্যও করে নেয়। তারা ভাবে, এতেই বুঝি সুখ। একসময়
এ ভুল ভাঙে। তারা ঈশ্বরকে দোষারোপ করে। আর অপেক্ষা করে, কবে তার সাথী শারীরিক ও
মানসিকভাবে দুর্বল হবে। তখন কেবল অপেক্ষা... অপেক্ষা... নেকড়ের অপেক্ষা। তারপর
অবশিষ্ট জীবনে সেই সাথীটিকে অত্যন্ত কষ্ট দিয়ে তাকে মরণোন্মুখাপেক্ষী করে দেওয়া,
একা করে রেখে দিয়ে সে তার প্রতিশোধ নেয়।
মাঝে মাঝে মনে হয় ‘ভালোবাসা’
শব্দটা একটা হাতিয়ার। যে ডোমিন্যান্ট, সে এটাকে হাতিয়ার করে। সাবমিসিভকে বলে, তুমি
গলা তুলে কথা বলবে না। তুমি প্রতিবাদ করবে না। তুমি উচিৎ কথা বলবে না। যদি বলো,
তাহলে তুমি আমাকে ভালোবাসো না। আর যে সাবমিসিভ, তার মুখ বন্ধ করে দেওয়ার প্লাস্টার
এই শব্দটা। সে মাথা তুলে দাড়াতে গেলেই যেন শব্দটা তার সামনে এসে ধোঁয়াশার সৃষ্টি
করে বলে, তাহলে তুমি নিশ্চই তাকে ভালোবাসো না। ভালোবাসলে সব সহ্য হয়। মনের আনন্দে
সেই সব সহ্য করা যায়। সে তখন অপরাধবোধে নিজেকে জর্জরিত করে নিজের সুস্থ
অনুভূতিগুলোকে মারতে থাকে। আর তারপরে অপেক্ষা করে... নেকড়ের অপেক্ষা।
প্রতিশোধস্পৃহা বড়ো আজব জিনিস।
মনের সব সুস্থ অনুভূতিগুলোকে আস্তে আস্তে মেরে ফেলে। যখন সে শক্তিশালী হয়, তখন সেই
মানুষটা যে কখন একটা ভয়ানক জানোয়ারে রূপান্তরিত হয়েছে সে নিজেও বুঝতে পারে না।
অবশেষে, প্রতিশোধ পূর্ণ হলে সে দেখে, সে একা। তার মৃত্যু হয় একাকী। তার সাথীরই মতো
সে তখন মরণোন্মুখ। কেবল পার্থক্য এই, এই সময়ে তার পাশে, অন্তত তার ওপর প্রতিশোধ
নেওয়ার মতোও কোন মানুষ থাকে না।
সম্পর্কগুলো যেন এই প্রতিশোধ
নেওয়ার খেলা হয়ে উঠছে।
Comments
Post a Comment