শ্রীমতী হে
রবীন্দ্রযুগের
একদম প্রথমদিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করা হল
শ্রীমতী হে-কে। ‘হে’ অর্থে ‘হেকেটি’। কাদম্বরী দেবীকে ‘হেকেটি’ নামে ডাকতেন তার
অন্তরঙ্গেরা। এখন এই কাদম্বরী-রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে।
আমি ঘোলা জলে আর মাছ ধরতে চাই না। কেবল সম্পর্কটা বুঝতে চাই। সেখান থেকেই একটা
সূত্র আমার কাছে এল। তাকেই নাড়াঘাটা করে যা বোধে এল সেটাই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।
রবীন্দ্রনাথ
বিরাট বিস্ময়। তার চিন্তার ক্ষেত্র এতটাই বিস্তৃত যে আমাদের সাধারণ গড়পড়তা
বাঙালীরা তাকে 'মহামানব' আখ্যা দিয়ে আজকাল একরকম পূজোই করি। এহেন বালক রবি যখন বিলেত
ঘুরে অনেক রমণী-মন জয় করে এলেন, তৎকালীন সময়ে বাংলার অগ্রগন্য পত্র-পত্রিকায়
নিয়মিত লিখছেন, অনুবাদ করছেন, গান রচনা করছেন, এমনকি ব্রাহ্মসমাজের অনেক
কাজে ব্রতী হচ্ছেন, সেই মানুষটি যার অভাব বোধ করছেন এবং যার মৃত্যুর পর আজীবন অভাব
বোধ করে যাবেন, তিনি হলেন কাদম্বরী দেবী।
এই অপূর্ণতা
তিনি লুকান নি। ফলে এটা আর শুধুমাত্র দেবর-বৌদির রোমান্স ব্যাপারটার মধ্যে বাধা
থাকল না। রবীন্দ্রনাথের মানসিক গঠন, তার শিল্পের বিভিন্ন দিকের পরিপূর্ণতা লাভের
জন্যে যে সঙ্গের প্রয়োজন ছিল, তা একমাত্র মিলেছিলে এই কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকে।
বিস্তারিত আসছি সে কথায়।
যে কোন
মানুষ, বিশেষ করে সে যখন ‘সেলেব্রিটি’তে পরিণত হয়, তখন তার পেছনে এক বা একাধিক
মানুষের নীরব উৎসাহ, প্রেরণা, আর তার থেকেও বড়ো কথা --- সাধনায় সঙ্গদান থাকেই থাকে।
রবি ঠাকুরের রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার জন্যে যে সরব প্রাথমিক প্রেরণা এবং উৎসাহ তা মূলত
মিলেছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাদম্বরী দেবীর কাছ থেকে।
রবীন্দ্রনাথের
মনোজগতের বিভিন্ন স্তরের সাথে সংযোগ করতে হলে, তাকে আবেগ এবং যুক্তির ক্রমপরিণয়ে
সাজিয়ে প্রকাশ করতে হলে আরেকটি মনোজগতের প্রয়োজন। মেঘের ঘর্ষণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
তেমন মনের ঘর্ষণে হয় সৃষ্টি। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সৃষ্টির কাজ করেছিলেন কাদম্বরী
দেবী।
প্রভাতকুমার
মুখোপাধ্যায়ের মতে “এই অসামান্য নারী ছিলেন যেমন অভিমানিনী, তেমনি সেন্টিমেন্টাল
এবং আরো বলিব ইন্ট্রোভার্ট, স্কিজোফ্রেনিক।” [রবীন্দ্রজীবনী ১/১১৯] শেষ দুটো বিশেষণই
আমাকে ভাবিয়েছে বেশি। এই ধরণের মানুষের মনের গহীনে যে কি পরিমাণ উথাল পাথাল চলে,
কত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর অণুসন্ধিৎসুপ্রবণ মন হয়, তা গবেষণার বিষয়। রবীন্দ্রনাথের
মনের সঙ্গে ঠিক এই জায়গাতেই তার সংযোগ হয়েছিল। এবং বাকি জীবন অন্যান্য
মানুষের মধ্যে এমন গভীর ভাবপ্রবণ মন এবং স্বতঃপ্রণোদিত হৃদয়কে তিনি আর পাননি। ফলে
বাকি জীবনে রবীন্দ্রনাথের লোকেন পালিত ছাড়া সে অর্থে বন্ধু মেলে না। এই পর্যায়ে
ইন্দিরা দেবী, লেডী রাণু মুখোপাধ্যায়, রাণী মহলানবীশ এবং মৈত্রেয়ী দেবীকে বাদ
দিচ্ছি। তার কেউই সেই পর্যায়ের সাধন সঙ্গীনি হতে পারেন নি। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে
দেখতে গেলে হওয়ার কথাও নয়। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরী প্রায় সমবয়সীই ছিলেন।
ফলে সেটাও একটা বড়ো সুবিধা। লোকেন পালিতও এমন কিছু কেউকেটা হৃদয়ের লোক ছিলেন না, ফলে সেরকম
সঙ্গ দিতে পারেন নি।
মনের এই
বিভিন্নতার চিন্তাধারা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আলোচনা করেছিলেন ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ রচনায়।
বিবিধ প্রসঙ্গ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে নিয়মিত, এবং এর কোন বাধাধরা বিষয়
ছিল না। অনেক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছোট ছোট নিবন্ধ। আজকের ফেসবুকের যুগে একদম 'সোনার লেখা' বলার যেতে পারে। পরে এটি পরিমার্জিত এবং পরিবর্ধিত
হয়ে ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ নামেই আত্মপ্রকাশ করে ১৮৮১ সালে। রবীন্দ্র রচনাবলীর ‘অচলিত
সংগ্রহে’ পরবর্তীকালে স্থান পায়।
এই
প্রবন্ধগুচ্ছে, আমার মনে হয়, কুড়ি বছরের তরুণ এক লেখকের মনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে
বিচরণের তাগিদ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখা যায়, এবং তা খানিকটা লাগামছাড়া। এই রচনাগুলির
একটা বড়ো অংশ যে সময়ে লেখা সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথ চন্দনগরের বাগানবাড়ীতে আছেন। সঙ্গে
আছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাদম্বরী দেবী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের থেকেও যে
মানুষটির সঙ্গের জন্যে তিনি বেশি লালায়িত ছিলেন --- নতুন বৌঠান। বিবিধ প্রসঙ্গের
অন্তিম চরণে ‘সমাপন’ প্রবন্ধে লিখছেন, “সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই দুই
জনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুই জনে
স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস, সেই সন্ধ্যার ছায়া! এক দিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতি গান? তাহারা
সব চলিয়া গিয়াছে! কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এই লেখাগুলির
মধ্যে কিছু দিনের গোটাকতক সুখ দুঃখ লুকাইয়া রাখিলাম, এক-একদিন খুলিয়া তুমি তাহাদের
স্নেহের চক্ষে দেখিও, তুমি ছাড়া আর কেহ তাহাদিগকে দেখিতে পাইবে না! আমার এই লেখার মধ্যে
লেখা রহিল -- এক লেখা তুমি আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।”
এবং শুধু
তাই নয়, প্রবন্ধগুচ্ছের মধ্যে বার তিনেক বন্ধু বা সহচরের উল্লেখ আছে, বোঝা যায় কে
তিনি, যার সঙ্গে আলোচনা চলতে চলতেই এই লেখাগুলির জন্ম। রবীন্দ্রনাথকে এমনভাবে সৃষ্টির
তাগিদ প্রেরণ করছেন কোন সহচর? পরবর্তীকালেও তো তেমন করে তো আর কাউকে মেলে না।
এর পাশাপাশি
আরেকটি কাব্যগ্রন্থের কথা বলব, ‘সন্ধ্যাসংগীত’। রবীন্দ্রনাথের মতে ‘সন্ধ্যাসংগীত’
প্রথম জাতে ওঠা কাব্যগ্রন্থ। তার আগের সবকটি লেখাকে তিনি নির্মমভাবে পরিহার করেছেন,
এমনকি ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’কেও। এবং রচনাবলীতে স্থান দেওয়ার আগেও যথেচ্ছভাবে সন্ধ্যাসংগীতের
এই কবিতাগুলির পরিমার্জন করেছেন বটে, কিন্ত মূলভাব অক্ষুণ্ণই রয়ে গেছে। 'সন্ধ্যাসংগীত' এবং 'বিবিধ প্রসঙ্গ' প্রায় একই সময়ের রচনা।
এই
কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি মূলত দুঃখের, বেদনার, বিচ্ছেদের, অপূর্ণতার, মনোবিকলনের। ‘তোমাকেই
করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ গানটিতে ধ্রুবতারা আর কেউই ছিলেন না, কাদম্বরী দেবী
ছাড়া। পূজা পর্যায়ের এই গানে অনেক সাধক ভক্তিতে ডুবে গেলেও কবির মনের ধ্রুবতারা
যে, সে কিন্তু এইসময় একবার আত্মহত্যা করতে চেষ্টা করলেন, তার ফলস্বরূপ
রবীন্দ্রনাথকে মাঝপথে দ্বিতীয়বার বিলেতযাত্রা স্থগিত রেখে ফিরে আসতে হল। এবং আসার
পর দেখলেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তার স্ত্রী-কে আরোও সময় দেওয়া এবং কলকাতার বিষণ্ণ
পরিবেশ থেকে সরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছায় অন্যত্র গমন করেছেন। একাকী রবীন্দ্রনাথের লেখনী
থেকে সৃষ্টি হল এই কবিতাগুচ্ছ। এই কবিতাগুচ্ছের মধ্যে আমি একটি কবিতার কথাই বলব,
তারকার আত্মহত্যা।
ভারতী
পত্রিকায় প্রকাশিত এই কবিতাটির পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিত সংস্করণ সন্ধ্যাসংগীতে
পাই। দুটি কবিতাতেই ‘জ্যোতি’ শব্দটি চারবার ব্যবহৃত হয়েছে, কবিতার লাইন পরিবর্তন হয়েছে।
পড়লেই বোঝা যায়, এই তারকা কে, এবং এই তারকা কার। তার আত্মহত্যার ফলে আসলে শুন্যতাই
বা সৃষ্টি হল কার? এক মনোবেদনা, অভিমানভরে এক কবি আর কোথায় তার নীরব প্রতিবাদ,
প্রতিরোধ বা বেদনার কথা জানাবেন? এই লাইনগুলোতেই তিনি তার যাবতীয় উচ্ছ্বাস আর
বেদনা ঢেলে দিয়েছেন। মূলত এখান থেকেই বোঝা যায় কাদম্বরী দেবী তার জীবনে প্রেয়সী
ছিলেন না, ছিলেন প্রেরণাদাত্রী। এই প্রেরণার নৈকট্যকে ভুল বোঝা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই বিশুদ্ধ প্রেরণা না
পেলে রবীন্দ্রনাথ অসম্পূর্ণ থেকে যেতেন। তার মনের পরিপূর্ণতা বিকাশে এই প্রেরণা
অবশ্যপ্রয়োজনীয় ছিল। এবং তা একজন নারীর কাছ থেকেই এসেছিল।
দুর্ভাগ্য,
কাদম্বরীর কোন প্রেরণাদাতা বা দাত্রী ছিল না। কাদম্বরী দেবী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর
মতন বিদুষী ও সাহসী ছিলেন না। ফলে সমাজের মূলস্রোতে প্রত্যক্ষভাবে স্বামীর সাথে
যোগদান করা হয়তো তার দুর্বল মানসিক গঠনের কারণে সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি। ফলে সারাজীবনই
তিনি রয়ে গিয়েছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে, হয়ে উঠেছিলেন অভিমানিনী। রবীন্দ্রনাথের
সাথে যে সখ্যতা তার গড়ে উঠেছিল, সামাজিক কারণেই হোক, কিম্বা সম্পর্কের জটিলতায়, তা
জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলে অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুদিনের মধ্যেই। এই কারণেই হয়তো
রবীন্দ্রনাথের বিলাতযাত্রার কারণে একাকিনী নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। হয়তো
এই কারণেই রবীন্দ্রনাথের বিবাহের কয়েকমাস পরে চিরকালের উন্মাদিনী নিজেকে শেষ করে
দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খুঁজে হয়তো পান নি।
প্রকৃত সত্য কি আমরা জানি না। কোনদিন জানতেও পারব না। যুক্তিবদ্ধ অনুমান আমাদের সত্যের কাছে পৌছে দিতে পারে। সেটাই আমি করার চেষ্টা করেছি মাত্র, যখন আমার কাছে নতুন করে উদ্ভাসিত হল 'বিবিধ প্রসঙ্গ' এবং 'সন্ধ্যাসংগীত'। এর মধ্যে অন্য কোন রহস্যের ইঙ্গিত আমি দিই নি। দেওয়ার কোন ইচ্ছাও নেই। কেবল অনুভূতি ব্যক্ত করেছি।
Comments
Post a Comment