এক আগুনপাখীর উড়ান



এই বইয়ের রিভিউ লিখতে গিয়ে এই প্রথম মনে হচ্ছে, আমি এমন কেউকেটা নই যে এই বইটার ভালো-মন্দ বিচার করব। কারণ, যেখানে একজন মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী মানুষের স্মৃতিচারণের ছত্রে ছত্রে রয়েছে মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা, সেখানে তার ভালো-মন্দ বিচার করার আমি কে? প্রশ্ন হল, কার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা? উত্তর – দেশ।

দেশের প্রতি ভালোবাসা একজন সৈনিকও দেখাতে পারে। সে হাসিমুখে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে দেবে দেশের জন্যে। কিন্তু একজন বিজ্ঞানী শুধুমাত্র বর্তমান সেনাদের জন্যই ভাববে না। ভাববে ভবিষ্যতের সেনাদের জন্যেও। সে দেশের প্রতিটি ইঞ্চিকে প্রস্তুত করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। সেখানে শুধু সৈন্য নয়, সেখানে থাকবে সাধারণ আমজনতা, বিদ্রোহী এবং নবজাগরণের স্বপ্ন দেখা যুবশক্তি, এবং সদ্য নতুন আলো দেখতে পাওয়া শিশুরা। তাদের সকলের জন্যে একজন বিজ্ঞানী ভাববে। তার উদ্দেশ্য দেশের রক্ষণব্যবস্থাকে শুধুমাত্র শক্তিশালী করা নয়, পাশাপাশি দেশের পরিকাঠামোকেও একটা এমন স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এনে দাঁড় করানো, যেখান থেকে ভারত উঠে দাঁড়াবে আপন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে। এ পি জে আবদুল কালাম সেই মাপের বিজ্ঞানী। রকেট টেকনোলজিকে শুধুমাত্র ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণে ব্যবহার করলেন না, ভারতের আর্থসামাজিক ও পরিবেশ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী আমরা হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা এবং বিক্রম সারাভাইয়ের পরে এমন একজন বিজ্ঞানীকে পেলাম যিনি পূর্ববর্তী বিজ্ঞানীদ্বয়ের স্বপ্নকে শুধু পূরণই করলেন না, সাথে সাথে আরোও এগিয়ে নিয়ে গেলেন ভারতের জনজীবনকে।

একটা কথা আমরা প্রায়ই বন্ধুরা বলাবলি করতাম, যেখানে ভারতের অধিকাংশ মানুষই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে সেখানে চন্দ্রায়ন বা মঙ্গলায়ন কিভাবে ভারতের উন্নতির সহায়ক হতে পারে। এর উত্তর আমি এখানে এসে পেলাম। একটা ছোট্ট কথা, কিন্তু কি দামী কথা!

“ভারতকে যদি জগৎসভায় কোনও মূল্যবান ভূমিকা নিতে হয়, বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান প্রচেষ্টায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে তার কারও থেকে পিছিয়ে থাকলে চলবে না। শুধু আমাদের শক্তি দেখাবার উদ্দেশ্যে এই পথে চলার কোন উদ্দেশ্যই তাদের ছিল না।”

এই তারা হলেন জওহরলাল নেহেরু এবং বিক্রম সারাভাই। যারা এই বিষয়টা নিয়ে আরেকটু খতিয়ে পড়তে চান তারা দয়া করে পঞ্চম পর্বটা মন দিয়ে পড়ে দেখতে পারেন। আর যখন আপনি ষষ্ঠ পর্বের মধ্যে দিয়ে যাবেন, একটা ব্যাপার নিয়ে আপনি নিশ্চিত হতে পারেন যে, ভারতীয় মস্তিষ্ক এবং ভারতীয় কর্মদক্ষতা দুটোই প্রশ্নাতীতভাবে অনেক ক্ষমতাসম্পন্ন। তবে তাকে ঠিকভাবে পরিচালনা করার আশু প্রয়োজন। আব্দুল কালাম স্যার দেখিয়েছেন, কত কম সময়ে এবং কত দক্ষতার সাথে MADE IN INDIA প্রোডাক্ট দিয়ে আমরা উপগ্রহ নির্মাণ ও তার সফল উৎক্ষেপণ এবং ‘পৃথ্বী’সমেত মোট পাঁচটা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরী করে, সেই সাথে তার পরিমার্জন ও শক্তিশালী করে নিজেদের সুরক্ষিত এবং সেইসাথে ভারতের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে আরোও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি একটা ব্যাপারও লক্ষ্য করেছিলেন, “ভারতের যুবসমাজের সবচেয়ে বড়ো ঘাটতি, আমার মনে হল, পরিচ্ছন্ন দৃষ্টি ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব।”

এই মানুষটাকে আমরা ‘মিসাইল ম্যান’ বলি। কারণ পাঁচটি মিসাইল তার ও তার টিমের আবিষ্কার, যা ভারতকে শুধু শক্তিশালীই করে নি, পরবর্তীকালে অনেকটাই দুর্ভেদ্য এবং প্রতিবেশী দেশের কাছে সমীহও আদায় করে নিয়েছে। এই পাঁচটি মিসাইল হল --- পৃথ্বী, ত্রিশুল, অগ্নি, আকাশ এবং নাগ। এদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না, কারণ ‘স্বস্ত্যয়নপর্বে এ নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন তিনি। দশম অধ্যায়ে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে বুঝিয়েছেন এই ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর উদ্দেশ্য, উপায়, এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে দিয়ে লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা। এই সাফল্যের আগে অনেক ব্যর্থতার স্বাদ পেয়েছেন। পুরস্কার পেয়েছেন যেমন, তিরস্কার এবং ঈর্ষারও মুখোমুখি হয়েছেন অনেকবার। তিনি লিখছেন,

“জীবনে আনন্দ, ষন্তোষ, সাফল্য নির্ভর করে সঠিক নির্বাচনের ওপর, যে-নির্বাচন সাফল্য এনে দেবে তার ওপর। কোনোও কোনোও শক্তি আছে সেগুলো একজনের সপক্ষে কাজ করে, আবার কোনও কোনও শক্তি কাজ করে একজনের বিপক্ষে, কোন শক্তি অনুকূল আর কোন শক্তি প্রতিকূল তাকে চিনে নিতে হয় আর তাদের মধ্যে থেকে সঠিকটি নির্বাচন করতে হয়।”

তার জীবনের ব্যক্তিগত কাহিনীও এর মাঝে মাঝে এসেছে। প্রথম পর্যায়ে তার ছেলেবেলার কথা, তার বাবা, মা, বোন আর বন্ধুদের অকুণ্ঠ সাহায্য, ভালোবাসা, স্নেহ ইত্যাদির কথা। তার স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্য, তার অধ্যাপকদের অকুন্ঠ প্রেরণা সমস্ত মিলিয়ে তার কখোনো মনে হয়নি তিনি মুসলমান। তার সর্বদাই মনে হয়েছে তিনি ভারতীয়। আপাদমস্তক এক বৈজ্ঞানিক মানুষের অন্তরে ছিল বিশাল বড়ো হৃদয়। পিতা, পিতৃব্য, মাতা এদের বিয়োগ তাকে যন্ত্রণা দিয়েছিল বটে, কিন্তু কোন কিছুই তাকে তার আদর্শ, কর্তব্য আর মিশন থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। এর মধ্যেও কি তার দুর্বলতার অনুভূব হয় নি? কিন্তু তাতে কি আসে যায়? মানুষের মন কখনও ঈশ্বর প্রেরিত মানুষদের মতো শুদ্ধ, বুদ্ধ অপাপবিদ্ধ হয় না। কিন্তু সেই ক্ষুদ্রতাগুলো তাকে কখনও পেড়েও ফেলে না। এবং অবশেষে সাফল্য সে পায়ই। আর তখন দেখে সমগ্র জাতি তাকে দেখছে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে। সেই দৃষ্টিতে তিনি মুসলমান বলে কোন বাঁকা ভাব নেই, বরং তাকে দেখতে চাইছে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে।

কিন্তু সে গল্প অন্য পর্বে। টার্নিং পয়েন্টস নামক অরেকটা বই এই বইয়ের পরবর্তী পর্ব। তার কথায় আমি আসছি না। ১৯৯২ সালে এসে এই লেখা থেমেছে। এই সময় পর্যন্ত তিনি ভারতবন্দিতই নয়, বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী। তাকে আমরা মাথায় তুলে রেখেছি। এমনকি বিরোধী গোষ্ঠিরও সন্মান এবং শ্রদ্ধা তিনি আদায় করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত যে অতুল্য ভারত তাতে তার অবদান অনস্বীকার্য। আর ভারতবাসী হিসাবে অন্তত একবার হলেও এই বইটি পড়ার মধ্যে দিয়ে তাকে মনন করা কর্তব্য বলে মনে করি।

প্রসঙ্গত, আবদুল কালাম স্যার বিজ্ঞানের ছাত্র। ফলে এখানে হয়তো রকেট টেকনোলজি নিয়ে এমন অনেক কথা এসেছে, আলোচনা হয়েছে, যা অন্যক্ষেত্রের পাঠকের কাছে কঠিন ও দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে --- এই ভাবনা নিয়ে যারা বইটা সরিয়ে রেখেছেন তারা ভুল করছেন। যে সমস্ত বঙ্গপুঙ্গব ইংরাজী ভাল পড়তে পারেন না বলে বইটাকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন তাদের বলি এর বঙ্গানুবাদ আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বেরিয়েছে এবং সেটি একটি অসাধারণ অনুবাদ। পড়তে বা পড়ে বুঝতে কোথাও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আর যারা “আনন্দের বই, এতএব হেব্বি দাম, আমরা গরীব আদমী” ইত্যাদি বলে সরিয়ে রাখছেন, তাদেরকেও বলি এর PDF গুগল সার্চ করলেই পাওয়া যায় এবং একাধিক ওয়েব সাইট থেকে অনায়াসেই ডাউনলোড করার সুবিধা আছে। এখন পড়বেন কি পড়বেন না, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করবে। না পড়লে একটা অনুপম অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হবেন এটা বলা যেতেই পারে।


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে