প্রধন্যা বনাম গোধন্যা
আমাদের বাড়ীর ঠিকানায় লিখতে
হয় গ্রামের নাম, তারপর পোস্ট অফিসের নাম। আমি কিন্তু গ্রাম মানি না। যে গ্রামে ‘সুগার এন্ড স্পাইস’ আর ‘মিও
আমোর’-এর দোকান আছে সেটা গ্রাম হতে পারে না। সেটা একটা
মফস্বল। এই মফস্বলে আমার বাড়ী। আমার বাড়ী থেকে দুটো বাড়ীর পরেই অলোক কাকুর বাড়ী।
সম্প্রতি
তার দ্বিতীয়বার করোনা হয়েছে। ফলে আমি অলোক কাকুর বাড়ী বেশ কয়েকদিন যাই নি। সুস্থ
হওয়ার পর কাল তাকে দেখতে গেলাম। দরজায় কাকীমা আমাকে দেখেই বললেন, তোর ওপর বেজায়
চটে আছেন কিন্তু?
“কেন?” কাকীমার
হাতে টিফিন ক্যারিয়ারটা দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলাম।
“জানি না,
একবার তোর কথা বলেছিলাম। এমন মুখ ঝামটা মনে হল ভীষণ ক্ষেপেছে।”
এই অলোক
কাকুর বাড়ি আমি বোধবুদ্ধি হওয়ার আগে থেকেই যাতায়াত করি। অনেকদিন ওনার কাধে করে
বাজার গেছি, কাধে চড়েই বাজার থেকে ফেরত এসেছি। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি রোগা
লম্বা অলোক কাকুর সব চুল সাদা। বাবার থেকে বয়সে অনেক বড়ো, তবুও তাকে ‘কাকু’ বলেই
ডাকি। একসময়ে নকশাল করতেন। তারপর বামপন্থা অবলম্বন করলেন। তারপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে
কাজে মন দিলেন। সংসারে মন দিলেন। তার এক ছেলে আছে, আমেরিকায় সেটলড্। বুড়ো-বুড়ি
দুইজনের বিষন্ন সংসার। এই সংসারে আমি মুর্তিমান উপদ্রব। একদম ছোট্টবেলায় ইজের পড়ে
গুড়গুড় করতে করতে অলোক কাকুর বাড়ি চলে যেতাম সকালে। দেখতাম মেঝেতে আসন বিছিয়ে খেতে
বসেছেন অলোক কাকু, কাজে যাবেন। আমি গিয়েই, লজ্জার মাথা খেয়েই বলছি, তার খাবার
থালায় হিসি করে দিয়েছি বেশ কয়েকদিন। খাওয়া পন্ড করার উদ্দেশ্য তাকে কাজে যেতে না
দেওয়া।
তবুও কাজে
যেতেন। না খেয়েই যেতেন। অলোক কাকুর ছেলে আমায় জোর করে কোলে নিত, আমি হাত-পা ছুড়ে
“ন্না ন্না ন্না” বলে চীৎকার করে কাঁদতাম। তবুও অলোক কাকু কাজে যেতেন।
শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কিম্বা ছোট্ট প্রধন্যার আর্তনাদ উপেক্ষা করেও যেতেন। একদিনও
কামাই করতেন না।
অলোক কাকু
ছিলেন আমাদের গ্রামের একমাত্র লাইব্রেরীর প্রধান লাইব্রেরিয়ান।
পড়াশোনায়
অগাধ পাণ্ডিত্য। পড়েছেন প্রচুর। একটু বড়ো হয়ে যখন কটকট করে কথা বলা শিখলাম,
বললেন, তোকে আমার ভারী পছন্দ হয়। তুই আমায় বিয়ে করবি?
আমার মা
বললেন, কোন আপত্তি নেই। কিন্তু এই ডাকিনীকে সামলাতে পারবেন?
আমি রিনরিনে
গলায় উত্তর দিয়েছিলাম, আমি সতীন নিয়ে ঘর করতে পারব না। কাকীমাকে বাড়ী পাঠিয়ে দাও। তারপর
আমি তোমায় বিয়ে করব।
সেই অলোক
কাকু গেছেন ক্ষেপে। কেন?
আমি ঘরে
ঢুকতেই চশমার ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোর নাম প্রধন্যা যিনি দিয়েছেন
ভাগ্যিস আর ইহজগতে নেই। থাকলে তোর নাম পালটে গোধন্যা রাখতেন। না হলে নিজের নামটাই
পাল্টে নিতেন।”
“গোধন্যা মানে কি?” আমি ফ্লাক্স টেবিলে রাখতে রাখতে
জিজ্ঞাসা করলাম।
উলটো প্যাঁচে
পড়ে থতমত খেয়ে অলোক কাকু বললেন, “মানে... মানে... গরু।”
“গোধন্যা মানে গরু? কবে থেকে? কোন ডিকশনারীতে আছে?”
আমি ফ্লাক্সে করে স্যুপ নিয়ে এসেছিলাম। একটা চীনামটির বাটিতে সাবধানে ঢালতে ঢালতে
জিজ্ঞাসা করলাম।
“আজ থেকে, আমি সাংসদ অভিধানে ঢুকিয়ে দেব।”
“আমার জন্যে ডিকশনারীতে নতুন শব্দ ঢুকবে! বাঃ দারুন তো!” আমি বাটিটা একটা প্লেটে বসিয়ে সাবধানে অলোক কাকুর হাতে দিলাম।
“তুই রামমোহন রায়কে নিয়ে ওসব কি ছাইপাশ লিখেছিস? ভুলভাল। আবাগীর বেটি। পেটে
এক পয়সার বিদ্যা নেই। দুটো ম্যাগাজিন পড়ে আলাং বালাং লিখেছিস, আর একটা গ্রুপে সেই
নিয়ে সাড়ে বত্রিশ তক্কো হচ্ছে। মাথাটা কি গেছে তোর? লোকটাকে না পড়েই ধুমধাম লিখে
দিলি??? কোনো রিসার্চ নেই, পড়াশোনা নেই, ফাঁকিবাজীটা কি যাবে না তোর এজন্মে???”
“তুমি পড়লে কোথায়?”
“কোথায় আবার। ফেসবুকেই।”
“পুরোটাই বাজে হয়েছে???”
“ছি ছি ছি--- এদিক ওদিক জোড়াতালি দিয়ে ভুতের কেত্তন করেছিস। তুই না... তুই
না এককথায় বাল লিখেছিস।”
এই রে! অলোক
কাকু চরম খেপেছে। এক্কেবারে মুখখিস্তিতে চলে এসেছে। আমি ভয়ে ভয়ে সামনের চেয়ারে বসে
বললাম, “ভুল কি লিখেছি?”
রাগলেও
খাবারের ওপর বুড়োর লোভ আছে জানি। বাটিটা কাঁপা হাতে কোলে টেনে নিয়ে বলল, “জোড়াতাপ্পি মেরে লিখেছ গুরু... একজনও বলেনি কিছু! আর সব্বাই প্রশংসা করছে।
ফেসবুকে কি সব ল্যাদখোরেরা বসে থাকে?”
“বলেছেন। অনির্বান দা নামে একজনের সাথে আলাপ হয়েছে। বলেছে একদম খাজা লেখা
হয়েছে। একটা বইয়ের নাম বলেছিল। বলেছিল পড়তে।”
“জয়গুরু, বলেছে তাহলে! কোন বইয়ের কথা বলেছে?”
“রণজিত গুহ’র ‘দয়া’।”
“ঠিকই তো
বলেছে। পড়াশোনা করা লোক বলতে হবে।” আনন্দে স্যুপে চামচ ডুবিয়ে সুড়ৎ করে গিলে নিলেন।
“তবে একটা
কথা তুই ঠিক লিখেছিস। ওনার লেখাগুলোর আধুনিকীকরণ হয় নি। সম্পূর্ণ রচনাবলী বাংলায়
হওয়া উচিৎ ছিল।” বলেই ‘সুড়ুৎ’ করে আর এক চামচ স্যুপ গলাধঃকরণ করে বিষম খেলেন। আমি
তোয়ালে এগিয়ে দিলাম।
“তুই নাকি
ঘোতনাকে পড়াচ্ছিস?”
“হুম্...”
“ওব্বাবাঃ!
টিচার ম্যাডাম! রামমোহনের গুষ্টির শ্রাদ্ধ করে এখন আবার বিদ্যাসাগরের নাম ডোবাবি?
তুই ভাই এবার বিয়ে কর। ওই **** কে বিয়ে করে নদভুসকো বউ হয়ে যা। দুটো বাচ্চা কোলে
নিয়ে দুবছর পর আসিস। বেঁচে থাকলে ওদের লজেন্স খেতে দেব।”
“বাজে না
বোকে স্যুপ খাও”
সুড়ৎ
“টিচার হলি
আর এখনকার সবচেয়ে বড়ো টিচারকেই ভুলে গেলি!”
সুড়ুৎ
“কার কথা
বলছ?”
সুড়ুৎ
“বলি আবদুল
কালামের কথা কি মনে আছে? *** পড়ে তো দেশ উদ্ধার করলে, না পিএইচডি, না রিসার্চ। মনে
আছে? নাম ভুলে গেলে এই স্যুপ বাড়ি নিয়ে যা... খাব না।”
সুড়ুৎ
“ভুলব কেন?”
সুড়ুৎ
“উনি যে
বইগুলো লিখেছিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি সেগুলো কি বিবির পড়া হয়েছে?”
সুড়ুৎ
“না...”
“হোপলেস...”
ঢক ঢক ঢক---
আমার হাতে
স্যুপের বাটিটা দিয়ে টাওয়েলে মুখ মুছে উঠলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা চিরকুটে কিছু
লিখলেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন, “বইগুলো পড়িস। কালাম সাহেবকে ভুলে যাচ্ছে সবাই। এই কয়েকদিনের
মধ্যেই। অথচ মানুষটা তো এই সেদিনও ছিল। ওর ‘ইগনাইটেড মাইন্ডস’ টিচারদের জন্যে
পাঠ্যপুস্তক করা উচিৎ ছিল। যাক গে, তুই পড়। পড়াচ্ছিস যখন, যত ছোটোদেরকেই পড়াস না
কেন, তাদের মনে স্বপ্ন গেঁথে না দিলে হবে? বাচ্চা থেকেই স্বপ্ন দেখাতে হয়।
স্বপ্নের পেছনে ধাওয়া করতে সাহস যোগাতে হয়। তবেই না তুই শিক্ষিকা।”
আমি
চিরকুটটা হাতে নিলাম। ছোট ছোট অক্ষরে দেখলাম চারটে বইয়ের নাম লেখা আছে। আমি ওড়নার
প্রান্তে বেঁধে নিলাম যত্ন করে।
সেদিকে
তাকাতে তাকাতে বললেন, “উঃ আবার যত্ন করার ঢং দেখো! বললাম আমায় বিয়ে কর। তা হলে তোর
এরকম গরুর মতন হাল হত না। আমি তোকে শিখিয়ে পড়িয়ে মানুষ করে দিতাম। রাণীর মতো
রাখতাম। কত্তো আদর করতাম।”
“বাজে বোকো
না তো। স্যুপ কেমন হয়েছে বললে না তো?”
অলোক কাকুর
খুব শখ ছিল একটা মেয়ের। ছেলেকে জন্ম দেওয়ার কিছুদিন পর কাকীমার ইউটেরাস বাদ যায়
সিস্ট হওয়ার কারণে। তার অনেক বছর পর আমি, এই সাক্ষাৎ শয়তান হাজির হই তাদের বাড়ি।
জেঁকে বসি। ফলে নরমে গরমে অনেক আদর-ভালোবাসা পেয়েছি দুজনের। সবচেয়ে
বেশি পেয়েছি বইয়ের ব্যাপারে বিপুল তথ্যের। অলোক কাকু, আমার দেখা একমাত্র
লাইব্রেরিয়ান, যে আমাকে তার সমস্ত জ্ঞান, যতটা পেরেছে, উজাড় করে দিয়েছে। আজও দেয়।
আমি মুর্খ। ধারণ করতে শিখলাম না।
অলোক কাকুর
বাড়ী থেকে কোনদিন খালি হাতে ফিরি নি। কোনদিন না...
Comments
Post a Comment