CODA -- বাঙময় নীরবতা


বই পড়ার সময় আমি ঝেড়ে-বেছে পড়ি না যা পাই তাই পড়ি সিনেমার ক্ষেত্রে একদম উলটো 'মাসে-'মাসে একবার দেখব, কিন্তু সলিড সিনেমা হতে হবে টাইপের আর কি

অনেকদিন পর আবার একটা সিনেমা দেখলাম গতকাল দুপুরে --- CODA সাপোর্টিং অ্যাক্টর অস্কার পেয়েছেন যাই হোক, পুরো সিনেমা দেখে, সামান্য কেঁদেকেটে একসা হয়ে বিকালে ফ্যাঁচফোঁচ করতে করতে বেরোলাম আমার হতভাগাটার সঙ্গে সে হতভাগা আমাকে দেখেই আঁচ করেছিল ভয়ঙ্কর আবেগপ্রবণ কিছু ঘটেছে মাঠে বসার সাথে সাথে আমি উগড়ে দিলাম, জানো আমি একটা সিনেমা দেখে এলাম... ইত্যাদি ইত্যাদি

হতভাগাটা জানে, একবার উচ্ছ্বাস বেরোচ্ছে মানে বেরোতে দেওয়াই ভাল আমি বকবক করেই যাচ্ছি, আর সে আমার দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপেক্ষা করছে মাঝে মাঝে আড়চোখে ঘড়ি দেখছে এপাশে ওপাশে যেকয়েকজন জোড়া এসে বসে আছে তাদের প্রধানত সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপছে আমি সব দেখছি, বুঝছি কিন্তু থামতে পারছি না মেয়েদের এটা সাংঘাতিক অক্ষমতা অনেকটা সতর্ক থাকলেও সময়মতো এটা সামলানো যায় না


          কী দেখেছিলাম এই সিনেমায়? অভিনয়। কী সাবলীল অভিনয় করে যাচ্ছেন বাবা (টরি কোৎসুর), মা (মার্লি মাতলিন), ভাই (ড্যানিয়েল ডুরান্ট), বোন (এমিলিয়া জোনস)এর মধ্যে প্রথম তিনজন বোবা-কালার চরিত্রে। বোনটি অর্থাৎ মেয়েটি একমাত্র কথা বলতে পারে, শুধু তাই নয়, সে গান গাইতে পারে। তার গলা অসম্ভব সুন্দর। তার গলা নিয়ে তার গানের শিক্ষকের প্রচুর স্বপ্ন। সে চায়, মেয়েটি শহরে গিয়ে গান শিখুক, গান নিয়ে পড়াশোনা করুক বার্কলে কলেজে মিউসিক নিয়েমেয়েটির পরিবারে মাছ ধরার ব্যবসা। ফলে থাকে সমুদ্রতীরের এক গ্রামে। বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভোরবেলা মেয়েটি মাছ ধরতে যায়। তাদের সহায়তা করে। বেলায় মাছ বিক্রী করে স্কুলে আসে পড়াশোনা করতে। তারপর গান শিখতে যায় স্যারের বাড়ী। ভাল কথা, এই পাগলাটে স্যারটির চরিত্রে ইগুয়েনিও দেরবেজ অসাধারণ। ওই ছোট চরিত্রে ওনার অভিনয় মনে দাগ কেটে যায়।

এই সিনেমার আরেকটি মারাত্মক অস্ত্র কমিক সেন্স। কিছু কিছু দৃশ্য আপনার পেটে খিল ধরিয়ে দেবে। আবার পরক্ষণেই পরিবারের মধ্যেকার পরস্পরের অনুভূতিপ্রবণ ব্যবহার হৃদয় মুচড়ে যাবে। সবচেয়ে অসামান্য লাগে যখন মেয়েটি বলে সে শহরে যেতে চায় গান নিয়ে স্টাডি করার জন্য। তার উত্তরে তার পরিবার, যারা কিনা কোনদিন সুর বোঝেনি, সুরের ধারায় স্নান করার সামান্যতম পরিচয় নেই, কোনদিন হবেও না, তাদের হতভম্ভ হয়ে বসে থাকা। তারা জানে, এই মেয়েটিই তাদের একমাত্র সম্বল, কারণ সে বাইরের শোনা এবং বলার জগতের সাথে যুক্ত, তাকে ছাড়তে চাইবেই বা কেন? আর ছাড়বে এমন একটা কারণে যার সাথে তাদের কোন পরিচয়ই নেই, আর পরিচয় যে হবে তার সম্ভবনাও নেই। সবশেষের দিকে এসে বাবা ও মেয়ে পাশাপাশি বসে। মেয়েটি বাবাকে গান শোনাচ্ছে। আর বাবা মেয়েটির গলা স্পর্শ করে বোঝার চেষ্টা করছে তার আদরের দুলালী কতটা ভাল গান গায়। ওই দৃশ্যকল্প এখোনো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

কিছু কিছু সিনেমা আছে, যাকে বর্ণনা করে বলা যায় না। বলতে নেই। বললে ঠাকুর পাপ দেবে। এই সিনেমা বলার নয় দেখার। বেশ কিছু কিছু যায়গায় একটু খটকা লাগে। সিনেমাটাকে হয়তো আরেকটু কমপ্যাক্ট করা যেত। কিন্তু সব কিছু ঢেকে যায় সিনেমার পরিবেশনায়।

“এত যে বকবক করলি, তুই জানিস ওখানে বোবা-কালার ভূমিকায় যারা অভিনয় করেছে, তারা সত্যিই বোবা-কালা?”

“ধ্যাৎ, তা আবার হয় না কি? ভাট বকিস না। না বুঝতে পারলে অভিনয় করবে কি করে?”

“সেটাই তো পরিচালকের ক্ষমতা। ওরা তিনজনেই বোবা-কালা। গুগল ঘেটে দ্যাখ।”


          আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। এ কেমনভাবে সম্ভব!


“চল চল। বকবক করে মাথা ধরিয়ে দিলি, বিকেলটা এত বাজে বকলি যে চুপ করে তোর সাথে বসে থাকব সেটাই হল না। মাঝখান থেকে বুঝলাম সিনেমাটার কিছুই দেখিস নি। বাড়ী চল। বাড়ী গিয়ে ঘুমা গে যা...”


         আমি বাকি রাস্তা একটাও কথা বলতে পারি নি। যদিও একটা এগরোল খাইয়েছিল। তখন দুজনের মুখ নড়েছিল।

Comments

  1. আপনার হতভাগা আছে ? বড়ই বিভ্রান্তিকর ঘটনা। অথচ Intro তে স্পষ্ট বাংলা ভাষায় লেখা যে আপনি নাকি প্রেম পরকীয়ায় উৎসাহী নন। আর তারই ঠিক তলায় লেখা যে আপনি এখন সম্পর্কের জাহাজে বিদ্যমান। কী অসামান্য চরম বৈপরীত্য !

    আপনার হতভাগার জন্য গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি ।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে