আমার আকাশ
আমাদের বাড়ীর পেছনে একটা বিশাল মাঠ ছিল, এখন আর নেই। মাঠের চারপাশে বড় বড় গাছ যেন পাহারা দিয়ে আছে। অনেক দূরে এক প্রান্তে ছায়াঘেরা সদ্য গজিয়ে ওঠা উদ্বাস্তু কলোনী। আরেক প্রান্তে আমাদের পাড়া এবং মাঝে সেই বিশাল মাঠ।
আমি
যখন ছোট, এই বিশাল মাঠ ছিল আমার বিস্ময়। আমি কোনদিন মাঠ পেরিয়ে কলোনীতে যাই নি।
আমার বার বার মনে হত, কলোনীটা যেন বহুদূরের এক দেশ। যে দেশের কথা শোনা যায়, কিন্তু
যাওয়া যায় না। আমার কল্পনার পালে বাতাস দিত এডভেঞ্চারের বিভিন্ন গল্প-উপন্যাস।
এই
মাঠে বিকেল হলেই ফ্রক পরে, চুলে দুটো বিনুনী করে খেলতে যেতাম। সহেলী ছিল অনেক। ছিল
গোল-গোলাপ্পা, গাদী, কবাডি, কিত কিত, বুড়িচ্চু, সাতগুটি। দূরে মাঠের মাঝে বড়ো
দাদারা ফুটবল বা ক্রিকেট খেলত সকাল-বিকাল। আরোও দূরে কলোনীর ছেলেরা ঘুড়ি ওড়াত,
হাতে হাওয়া কল নিয়ে দৌড়াত, কিম্বা কাগজের রকেট ওড়াত। কখনো বা ঢিলে প্লাস্টিক আটকে
উড়িয়ে দিত অনেকটা ওপরে। সেই প্লাস্টিক মাঝে মাঝে আমাদের এদিকে হাওয়ায় উড়ে এসে পথের
ধূলায় লুটাত। ওদের আনন্দ কোনদিন দাদাদের খেলার আনন্দ উত্তেজনা ছাপিয়ে আমাদের কানে
এসে পৌছাতে পারত না।
এই মাঠ
আমার ছেলেবেলার আনন্দ নিকেতন। কারণটা একটু অন্য। আমার অনন্তের প্রথম আভাস, আমার
অন্তরের অন্য ভূবন ধরা দিয়েছিল এই মাঠে। একটা খেলা আমার বড়ো প্রিয় ছিল। খেলতে
খেলতে বা অন্য কোন সময় আনমনে আমি মাঠে শুয়ে পড়তাম দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে। ঘাসের বন
যেন আমার শরীরটাকে তাদের আলতো হাতে আমায় তুলে ধরত ওপরে। আর আমি তাকিয়ে থাকতাম নীল
আকাশের দিকে। আমার দৃষ্টিপথে কোন গাছপালা থাকত না, বান্ধবীরা থাকত না। কেবল থাকত
পাখীর আওয়াজ, হাওয়ার মৃদু স্পর্শ, আর অসীম অনন্ত সুনীল আকাশ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে
একটা সময় শব্দ, গন্ধ, স্পর্শ --- সব থেমে যেত। পড়ে থাকত দৃষ্টিবোধ। আমার মনে হত
আস্তে আস্তে ঘাসবন আমাকে তুলে দিচ্ছে আকাশের দিকে। আমি আস্তে আস্তে আকাশের দিকে
উঠে যাচ্ছি, মিলিয়ে যাচ্ছি, শেষ হয়ে যাচ্ছি। আমি ভয় পেয়ে উঠে পড়তাম। তারপর
গা-হাত-পা চুলকাতে চুলকাতে বাড়ী ফিরতাম। মশা আর ঘাসের স্পর্শের অমোঘ ফল।
আকাশের
রূপ বদলাতে দেখেছি --- দিনে, রাতে। বছরের সময়ে সময়ে। বর্ষাকাল আর শরৎকালে মাঠে
যাওয়া যেত না। তখন আমার বাড়ীর ছাদে এমনিভাবে শুয়ে থেকেছি। আকাশ আমাকে কোনদিন ফেরায়
নি খালি হাতে। বর্ষার বৃষ্টি আমার শরীরে আছড়ে পড়েছে। ঘোলাটে আকাশ তার মহারুদ্ররূপ
নিয়ে আমার কাছে এসেছে। ভয় পেয়েছি, কিন্তু অনুভবও করেছি। শরৎকালে মেঘের খেলা আর
ঘুড়ির বাহার দেখতে দেখতে পূজোর গান শুনেছি। রবীন্দ্রনাথ শুনেছি। আবার শীতকালে
অদ্ভুত মায়াময় তীব্র নীলের মধ্যে ডুবে গেছি। কিন্তু আকাশ আকাশই রয়ে গেছে।
রাতের
আকাশ আমায় সবচেয়ে বেশি কাছে টেনে নিয়েছে। বিশেষত অমাবস্যার আকাশ। ছোটবেলায় আমার
মাথার ওপর দিয়ে চলে যাওয়া আবছা আকাশগঙ্গা দেখতে দেখতে মনে হয়েছে আরেকটু পরেই আমি
আছড়ে পড়ব ওর মধ্যে। গ্রহ আর নক্ষত্রের মোহময় হাতছানিতে আমার সুখ দুঃখগুলোকে একটু
একটু করে বিলিয়ে দিয়েছি। একাকীত্বের তীব্র যন্ত্রণাবোধকে অন্ধকারের মধ্যে ডুবিয়ে
ফিরে এসেছি। আবার প্রেমের বেদনাকে বসন্ত-পূর্ণিমায় সমর্পণ করেছি।
আমার
আকাশ আমার সব কিছু জানে। সে জানে আমার দুর্বলতা, ভীরুতা, কাপুরুষতা। সে জানে আমার আনন্দ,
বিদ্বেষ, লোভ। সে জানে আমার সৌন্দর্য, মলিনতা, বেহায়াপনা। সে দেখেছে আমার পূর্ণ
নগ্ন রূপ। রাতের কানে কানে আমি তাকে বলেছি, আমি তোমার। তুমি আমাকে নাও। সে আমায়
নেয় নি, আমায় ফেরায়ও নি। সে আমাকে তার অশ্লেষ নীলিমায়, নিথর কালো অন্ধকারে বারে
বারে ডুবিয়ে আবার ফিরিয়ে দিয়ে গেছে এই মায়াময় পৃথিবীতে। পূর্ণিমা রাত্রে দুধসাদা
জ্যোৎস্না আকাশ থেকে মাঠে ঘাসের বুকে নেমে আসে। মাঠটাকে মনে হত অনন্তের সমুদ্র।
তার মধ্যে দিয়ে এক মায়াঘেরা এক মরিচীকাময় পথ। আর সেই পথের ধারে কেউ যেন আমার
অপেক্ষায় আমাকে ডেকেই চলেছে, কোমল ক্লান্তস্বরে... মনে হয়, And
miles to go before I sleep, / And miles to go before I sleep…
বাক্যটার অনুরণন চলেই যায় আমার মনে মনে। আমি চোখ খুলে দেখি আকাশ তাকিয়ে আমার দিকে
--- নিঃশেষে, নির্নিমেষে। আমি আকাশের প্রেমিকা, আকাশের
শয্যাসঙ্গিনী। তবুও আকাশ আমায় অধিকার করে নি। জানি কোনদিন করবেও না।
আর সেই
কারণেই আমি বারবার আকাশ হতে চাই। আকাশের নীল আমার শরীরে মাখতে চাই। আকাশের
অন্ধকারের মতো রহস্যময়ী হয়ে উঠতে চাই।
----------------
বিঃ দ্রঃ – “এই ভাই। তোর
একটা ছবি তুলব। একটু দাঁড়াবি এখানটায়?”
“ও মা! তুই শুচ্ছিস কেন?
আমি কি বাবাকালী হয়ে তোর বুকের ওপর দাড়াব?”
“লাত্থি খাবি। চুপ করে
দাড়া।”
অতঃপর... ছবিটা উঠল।
Comments
Post a Comment