আমার রবীন্দ্রনাথ

 



আমার কি কোনোদিন রবীন্দ্রনাথকে প্রয়োজন ছিল? সহজ পাঠে আর কিশলয়ের পরে তাকে ভুলেই গিয়েছিলাম। ক্লাস টুয়েলভ অবধি তিনি ছিলেন বটে বাংলা বইয়ের পাতায়, কিন্তু ওইটুকুই। মাঝে মাঝে নাচের মুদ্রায় কিম্বা গানের তালে তাকে ধরেছি, সে কেবল ছোট্টবেলার প্রশংশা আদায়ের জন্যে। এর বেশি তাকে প্রয়োজন ছিল না।

মা বলেন, মেয়েদের বয়স ছেলেদের বয়সের থেকে পাঁচ-সাত বছর এগিয়ে থাকে। কথাটার ঠিক-বেঠিক জানি না। আমার মাসী বলেন, জন্ম থেকেই মেয়েরা একটা অতিরিক্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে জন্মায়। ঠিকই বলেন। আর সেই অতিরিক্ত ইন্দ্রিয়ের পথ ধরেই রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন আমার জীবনে।

       আমি তখন সদ্য হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়েছি। লম্বা ছুটি। অনেকে অনেক কিছু বলছে। এই কর সেই কর। আমি সব শুনছি। বিকালে একদিন অন্তর পাড়ার কম্পিউটার ক্লাসে যাচ্ছি। অল্টারনেটিভ দিনে লাইব্রেরীতে ঘুরঘুর করছি। এমনই এক দিনে সকালবেলায় আমার পাশের বাড়ী থেকে গান ভেসে এল,

 

          “আজ যেমন ক'রে গাইছে আকাশ তেমনি ক'রে গাও গো।।
           আজ যেমন ক'রে চাইছে আকাশ তেমনি ক'রে চাও গো।।
           আজ হাওয়া যেমন পাতায় পাতায় মর্মরিয়া বনকে কাঁদায়,
           তেমনি আমার বুকের মাঝে কাঁদিয়া কাঁদাও গো।।”

 

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনি না। কিন্তু তার গলা আকাশে-বাতাসে ভেসে ভেসে আমার কাছে এসেছিল সেদিন। আকাশ কেমন করে গায় সেদিন বুঝেছিলাম। পাতার মর্মরধ্বনির সাথে সেদিন যেন প্রথম পরিচয় হল। সব মিলিয়ে আমার রোমে রোমে কে যেন গান গেয়ে উঠল।

       এমন অনুভূতি তো আমার আগে কোনোদিন হয় নি! এ কার গান? লীনা কাকীমার বাড়ি গানটা বাজছিল। বিকালে গেলাম। লীনা কাকিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সকালে কার গান বাজছিল। লীনা কাকিমা বললেন, সকালে FM চলছিল, তুই কোন গানটার কথা বলছিস? আমি বেবাক ভুলে গিয়েছিলাম। আমতা আমতা করে আকাশ-বাতাস বলার চেষ্টা করলাম। তিনিও বুঝতে পারলেন না। আমিও হাল ছেড়ে দিলাম।

       তার বেশ কিছুদিন পরের কথা। গানটার অনুভূতি আমায় তাড়া করে বেড়াতে লাগল। ওটা যে রবীন্দ্রসঙ্গীত তাই জানি না। কিশোর-আশা-লতার রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাথে মেলে না যে! তবে সেই অনুভূতিটা মনের কোন এক গভীরে জেগে রইল।

       কপাল যদি সঙ্গে ফেরে তাহলে? বেশ কয়েক মাস পরে আবার গানটা শুনলাম। এবার রাস্তায় যেতে যেতে। একটা পাগলামী আমার রক্তে আছে আমি জানি। পাগলামীটা পেয়ে বসল আমায়। আমি দেরী করলাম না। জানতাম এমন সুযোগ আর এ জন্মে হবে না। সাইকেল ঘুরিয়ে সটান সেই বাড়ীর দরজায়। বেল বাজালাম। খুললেন একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক। বিস্মিত দৃষ্টি। কেউই কাউকে চিনি না। সটান জিজ্ঞাসা করলাম, “এই গানটা কি গান? কে গাইছে?”

       তিনি হকচকিয়ে গেছেন। সে অবস্থাতেই বললেন, “এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলা।”

       “আচ্ছা। আমি এটা জানার জন্যেই আপনাকে বিরক্ত করলাম। কিছু মনে করবেন না।”

       তিনি মৃদু হাসলেন, “তোমার কি গানটা ভালো লেগেছে? তাহলে ভেতরে আসতে পারো। গানটা পুরোটা শুনে যাও।”

       “আমি আমার বন্ধুদের সাথে আছি। শোনা যাবে না। সময় নেই। আরেকটা প্রশ্ন। এই গানটা কি কোন বইয়ে লেখা আছে?”

       “গীতবিতান”

 

আমার এইটুকুই জানার ছিল। পরের দিন লাইব্রেরী থেকে গীতবিতান নিয়ে এলাম। বইটা দেওয়ার সময় লাইব্রেরীয়ান কাকু বলেছিল, “গান কেউ পড়ে বাপের জন্মে শুনিনি। তুই সত্যি সত্যিই পড়বি না কি গান শেখার জন্যে নিচ্ছিস?”

“পড়ব”

গীতবিতানের পাতায় পাতায় কেটেছে কিছুদিন। গান শুনেছি তারও বেশ কিছু পরে। পড়েছি আগে। প্রথমবার পড়ে মুগ্ধ খুব একটা হই নি। রবীন্দ্রনাথ বিংশ শতাব্দীর এক কিশোরীর মনে তার গানের লাইন দিয়ে তেমনভাবে দাগ কাটতে ব্যার্থ হয়েছিলেন। বুকের ভেতর বিদ্যুৎ-এর চাবুক হানলেন যেদিন আমার ম্যাডামের বাড়ীতে আনমনে সঞ্চয়িতার পাতা উল্টাতে উল্টাতে পড়ে ফেলেছিলাম,

ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই-- ছোটো সে তরী

     আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।

            শ্রাবণগগন ঘিরে

            ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,

            শূন্য নদীর তীরে

                    রহিনু পড়ি--

     যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।

 

আমার মনে হয়েছিল, এ কি! এই মানুষটা আমারই মনের কথা বলছেন। এমনটাই তো হয়। এমনটাই তো দেখছি চারপাশে! শ্রীময়ীদির কাছে গেলাম সঞ্চয়িতা ধার চাইতে। সে দিল না। বদলে দিল গল্পগুচ্ছ। বলল, আমি তোকে যতটা চিনি তাতে করে এটা আগে পড়। শ্রীময়ীদির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। গল্পগুচ্ছ আমাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে সেতু রচনার সুযোগ করে দিল। তারপর বাবার কাছে ঘ্যানঘ্যান। কিনলাম রবীন্দ্র রচনাবলীর সুলভ সংষ্করণ। তারপর থেকে বছরের পর বছর ধরে রবীন্দ্রনাথের সাথে সহবাস আমার।

আজও বিষন্ন দিনে, কিম্বা একলা ঘরে আমার সাথে থাকেন তিনি। জীবন শুকালে করুণাধারা আসে না, আমি রবীন্দ্রনাথের কাছে যাই। তিনিই আমার করুণাধারা। তিনিই আমার ফকির, ঠাকুর্দা, ফাগুলাল, তিনিই আমার অন্ধকারের রাজা...


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে