বিশেষ দিন



“আজ আমার জীবনে একটা বিশেষ দিন”


এই বিশেষ দিনটা অনেক কিছুই হতে পারে। জন্মদিন, স্কুলে প্রথম ফার্স্ট হওয়ার দিন, প্রথম তথাকথিত সেলিব্রিটি হওয়ার দিন, প্রথম প্রেমে পড়ার দিন, বিয়ের দিন, সন্তান জন্মানোর দিন, নিজের শিল্পসত্ত্বাকে সবার সামনে প্রকাশিত করার দিন ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

স্পেশাল দিনটায় আমার সারা পৃথিবী যেন বদলে যায়। সবকিছুই যেন অন্যরকম। আকাশ, বাতাস, পরিবেশ, লোকজন এমনকি শত্রুদেরকেও অন্যরকম লাগে। সবকিছু অন্যায়কে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখতে ইচ্ছে করে। সমস্ত অপরাধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করে। অচেনাজনের দুর্ব্যবহারকে কিছুই মনে হয় না। পা মাড়িয়ে দিলেও না। প্রিয়জনের ব্যবহারও বেশ কোমল হয়। নিজের অপরাধবোধকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিই। নিজের ক্ষুদ্রতাকে চোখেই দেখতে পাই না। নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে যাই। ভিতরে ও বাইরে আমার সবকিছুই যেন দাড়িপাল্লায় সমান সমান হয়ে যায়। ফলে কোথাও যেন আমরা নিজেরাও এই স্পেশাল দিনগুলোর অপেক্ষা করি সারা বছর ধরে। তার মানে আমরা মনে মনে এমন অবস্থায় উপনীত হতে চাই। অনেকটা কেমন জানেন? রবীন্দ্রনাথের ভাষায়,

 

              “প্রতিদিন যদি কাঁদিবি কেবল    একদিন নয় হাসিবি তোরা

                                একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া    সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা।।”

 

দিনটাই কেমন যেন অন্যরকম। অথচ সত্যিই কি তাই? না কি সমুদ্রের ঢেউ তীরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে যেমন সরে যায় দূরে, তেমনিভাবেই আমার দুঃখ, আমার বেদনা, আমার যন্ত্রণা, আমার কষ্ট মনের অতলে হারিয়ে যায়, ওই একটি দিনের জন্য। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আমিই সরিয়ে রাখি আমার মনের কোন একটা কুঠুরিতে।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই কুঠুরির ঠিকানা যদি আমরা জানতে পারতাম, তাহলে কেমন হত? তাহলে তো গোটা দু:খের পর্বগুলোকেই এই কুঠুরির মধ্যে বন্দী করে রাখতাম। কাউকেই তখন আর শত্রু বলে মনে হত না। সবকিছুই সুন্দর আর সুন্দর হত। আমি অজাতশত্রু হতাম।

বুদ্ধ, কৃষ্ণ দুজনেই বলেন, মনই সব কিছুর আধার। মনেই বদ্ধ, মনেই মুক্ত। “পাশবদ্ধ জীব, পাশমুক্ত শিব” – রামকৃষ্ণ বললেন। এরকম হাজার একটা উদাহরণ আছে সারা বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু আমি যেন সেই বিশ্বের বাইরের লোক। আমার যেন সেখানে প্রবেশের অধিকার নেই।

তবুও, যারা মনে করেন দুঃখ যায় না, শত্রুতা যায় না, বেদনা যায় না --- তারা তাদের এই একটি বিশেষ দিনের কথা মনে করে দেখতে পারেনএই একটি বা দুটি বিশেষ দিন প্রমাণ করে দেয় যে, সত্যিই প্রতিদিনের দৈন্যতারও একটা পার আছে। তবে তা ভেতরের দিক দিয়ে। বাইরে কোথাও পথ নেই। বাইরে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। কোথাও কিছুরই কোন পরিবর্তন হওয়ার নয়হয়ও না। আমার থাকা না থাকাতেই যখন বাইরের কোন পরিবর্তন হয় না, তখন আমার দুঃখ-বেদনা তো খুবই ছোটখাট ব্যাপার।

আমি আছি। আমার অস্তিত্বেই জগতের অস্তিত্ব। এই অস্তিত্বের কাঠামো নির্মাণ আমার হাতে। আমিই একে নির্মাণ করি। আমিই একে ধ্বংশ করি। আমাতেই এর শুরু, আমাতেই এর শেষ...

 

স্রোতস্বিনী নদীর তীরে ঘাটের এক পাশে নিরালা গাছের ছায়ায় সিঁড়িশয্যায় আমার হতভাগা আমার কোলে মাথা রেখে কোমর দুহাতে বেড় দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল। আর মাঝে মাঝে কি সব প্রলাপ বকছিল আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। আর আমি তার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে এইসব আলাং তালাং ভাবছিলাম

Comments

  1. অসাধারণ লিখেছ দিদি <3

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে