রামমোহন রায় --- এক বিষাদগাথা



রামমোহন রায়, রাজা রামমোহন রায়ের ২৫০তম আবির্ভাব দিবস পালন হচ্ছে ফেসবুকে ফেসবুকে, অথচ আমি তার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। তাই তার জন্মদিনে নীরব ছিলাম। কেবল জানি, তিনি ‘নবজাগরণের পথিকৃৎ’, আর সতীদাহ প্রথা নিবারণের হোতা।

     আমার বাংলা স্যার আমাদের মেয়েদের বলতেন, কী রোজ ঠাকুর পূজো করিস? তোদের উচিৎ রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের একটা করে ছবি সিংহাসনে বসিয়ে পূজো করা। ওরা না থাকলে তোরা আজ এই জায়গায় এসে পৌছাতিস না। স্যার এসব বলতেন, আর আমরা টপ-জিন্স, প্যান্ট-শার্ট, সালোয়ার-কামিজ পরা বালিকারা হাতে পেন নিয়ে অপেক্ষা করতাম নোট্‌সের জন্য।

     অথচ কথাটা নির্জলা সত্যি। কিন্তু, তবুও, সত্যিই কি সত্যি? রামমোহন সতীদাহ বিল পাস করালেন আর পরদিন থেকেই তা বন্ধ হয়ে গেল? মেয়েরা তাদের যথাযোগ্য সন্মান পেতে শুরু করল? না তো। তবে একসময় বন্ধ হল। আর এরপরেই এমন এক সমস্যার উদ্ভব হল, যা জীবিতকালে রামমোহন ভাবতে পারেন নি, পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর প্রাণপণ সেই বিপদকে আটকানোর চেষ্টা করলেন, কিছুটা সাফল্য পেলেও আজও অনেক মেয়ে অন্ধকারে আছে। সে অন্য আলোচনা। পরে আসছি।


আমার প্রথম প্রশ্ন এই নবজাগরণ কি? নবজাগরণের বৈশিষ্ট্যগুলো একবার দেখে নেওয়া যাকঃ

১. স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবাদের বিকাশ

২. সাংস্কৃতিক পরিবর্তন

৩. বিজ্ঞানচর্চার প্রসার

৪. মানবতাবাদ

৫. ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃতি

৬. ধর্মনিরপেক্ষ শিল্প, সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিকাশ


     রামমোহন পরবর্তীকালে ‘বিদ্যাসাগর’ নামটা ছাড়া আর কাউকে বিশেষ পাই কি? ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে তেমন কাউকে পেতে গেলে আতশ কাঁচ হাতে নিয়ে দাড়াতে হবে। তাহলে মোটমাট কি দাঁড়াচ্ছে? ১৮১২ সালে রামমোহন সেই অর্থে সমাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা শুরু করেন রংপুরে ধর্মীয় সভা গড়ে তুলে এবং ১৮৩৩–তে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ সাল থেকে লেখা শুরু করেন, তবে সমাজে নজর কাড়েন আরোও পরে। তবে এর মাঝে আর কেউ কি তেমন ছিল? ছিল বটে, নজকাড়া নয়। মানে নবজাগরণের যে সব বৈশিষ্ট্য আমরা দেখছি তার অধিকাংশই কোন একজন মানুষের মধ্যে দেখিনি। সমাজে তো নয়ই। নবজাগরণ অর্থে সেরকম নাম পরের পর আসতে থাকে ১৯০০ সালের আশেপাশে। এবং রবীন্দ্রনাথে এসে শেষ হয়অর্থাৎ, ১৯৪১ সালে। বলা বাহুল্য, সাধারণ সমাজে এর প্রভাব নগণ্য। পুরোটাই মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক বা শহরকেন্দ্রিক বলা যেতে পারে, তাও কয়েকটি পরিবার এবং বিশেষ সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে সমগ্র বাংলা জুড়ে নবজাগরণ আদৌ হয়েছিল কি না সে নিয়ে বিতর্ক আছে, এ নিয়ে আমারও সন্দেহ আছে, সমগ্র ভারত তো অনেক দূরের কথা।

 

 

রামমোহন রায় সম্পর্কে জানতে গিয়ে তিনটে ক্ষেত্রে অবলম্বন করেছিলাম। প্রথম, বই। আমাকে লজ্জা এবং আনন্দ দিয়ে দুটি গ্রুপ একরাশ বইয়ের সন্ধান দিল। তার ডিজিটাল কপিও দিল। বেশ কয়েকজন বন্ধু স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আরোও অনেক বই পাঠাল। লজ্জা লাগল আমি কিছুই জানি না দেখে। আনন্দ হল, অনেকেই তাহলে ওনার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অবাক লাগল, বেশিরভাগ বই-ই ষাটের দশকের বা সমসাময়িক। কেউই নব্বই বা তার পরের আধুনিক লেখকের লেখা বইয়ের সন্ধান দিতে পারল না। অর্থাৎ, কম সে কম শেষ পঞ্চাশ বছরে রামমোহন রায়কে নিয়ে লেখা সুচিন্তিত পাঠ্য বই জনমানসে আসে নি। আসলেও পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নি। ভুল বললে ক্ষমা করবেন।

     এরপর ম্যাগাজিন। এ বছর আড়াইশোতে পা দিলেন তিনি। সারা ভারত যাকে নবজাগরণের মহান পথিকৃৎ বলে মান্য করেন, তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে কি? বাংলার দুটি ম্যাগাজিন ছাড়া আর তেমন কোন ম্যগাজিনে কিছু চোখে পড়ল না। একটি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন যেখানে লতা মঙ্গেশকরকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল, তারা এবারে প্রচ্ছদ করেছে, কীভাবে আরতি করা উচিৎ তা নিয়ে। ন্যাশনাল ম্যাগাজিনের অবস্থা তথৈবচ। অর্থাৎ, তারা রামমোহনকে নিয়ে ইন্টারেস্টেড নয়।

     তৃতীয়, দৈনিক সংবাদপত্র। অন্তত জন্মদিন রবিবার হওয়াতে দেশের সংবাদপত্রে যে অতিরিক্ত ট্যবলয়েড থাকে তাতে তো অন্তত কিছু লেখা থাকবে। আমাকে অভিভূত করে বেশিরভাগ সংবাদপত্র একটা করে লেখা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা মনে করেছে রামমোহনকে নিয়ে লেখার তেমন কিছু নেই। ফলে তাকে নিয়ে তেমন কোন বিদগ্ধ লেখা আমার চোখে পড়ল না। অর্থাৎ, তিনি আপাতত বিস্মৃতির অন্তরালে।

     এখান থেকেই শুরু হয় আমার মনে আরেকটা প্রশ্ন। তার প্রতি আমার শ্রদ্ধাবোধ অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তিনি কি আদৌ নবজাগরণের ‘প্রথম আলো’? না কি বাঙালী তথা ভারতবাসী আত্মবিস্মৃতির জাত --- একথাটা মেনে নেওয়াই শ্রেয়?

     মজার ব্যাপার, রামমোহন রায়ের রচনাবলীর আধুনিকীকরণ কিন্তু হয় নি। তার ইংরাজী লেখার তর্জমা নেই, তার চিঠিপত্রের তর্জমা নেই, তার ইংরাজী প্রবন্ধের সটিক অনুবাদ নেই। যতটুকু আছে, তা সেই সময়ে যা কাজ হয়ে গিয়েছিল সেখানেই স্তব্ধ। অর্থাৎ, রামমোহন রায়ের লেখা নিয়ে আমরা খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছি না। তার চরিত্রের বিশ্লেষন এবং তার চিন্তাধারার গভীর চেতনাবোধ নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। যে কারণে রাজা রামমোহনের জন্যে একজন ইন্দ্রমিত্র আবির্ভূত হয় নি এখনও পর্যন্ত

 


রামচন্দ্র গুহ’র Makers of modern India –তে তিনি শুরুই করেছেন রামমোহন রায়-কে নিয়ে। অর্থাৎ, তিনি মনে করছেন আধুনিক ভারতের রূপকার যে কয়জন আছেন তাতে প্রথমেই যে নামটা আসে তা হল --- রাজা রামমোহন রায়। সেখানে তিনি রাজার তিনটে কাজের ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক।

১। সমাজে নারীর অবস্থান

২। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা

৩। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচার ও প্রসার

     মজার ব্যাপার, সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ একজন মানুষ তখনই করেন যখন তিনি সমাজে মহিলাদের ন্যাক্কারজনক অবস্থানের ব্যপারে সম্যক ধারণা উপলব্ধি করতে পারেন। বৌদির সতী হওয়ার ঘটনা অনেকগুলো যন্ত্রণার মধ্যে মাত্র একটা উপাদান। অথচ সেই উপাদানকেই আমরা ভাবি টার্নিং পয়েন্ট। আর সেই প্রথা নিবারণের পর কি হল? কাশীতে বিধবাদের সংখ্যা বাড়ল। তাদের জীবনযাত্রার মান পড়ে গেল। সেখানে তাদের অসহায়তার সুযোগে অবাধ যৌনাচার শুরু হল। বৃদ্ধাদের অবস্থা আরোও সঙ্গীন হলবর্তমানেও সে অবস্থার খুব একটা উন্নতিসাধন হয় নি।

     সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্যে লড়েছেন অনেকটাই। মানে ওনার পক্ষে যতটা সম্ভব ততটাই। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলনের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলা ভাষার প্রথম রূপকার বিদ্যাসাগর হলেও শুরুটা উনিই করেছিলেন। সংস্কৃত টোল থেকে সরে এসে মাতৃভাষাকে একটা লেখ্য ভাষায় সঠিক রূপদান যে করতে হবে তা প্রথম অনুভব করেন উনি। তার লেখা বইগুলো একটা বড়ো প্রমাণ। যদিও বেশিরভাগ বই ধর্ম ও সমাজের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়ে একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছেযেখান থেকে সাধারণ মানুষের হাতে লেখ্য ভাষাকে তুলে দেওয়ার সফল পথিকৃৎ অবশ্যই বিদ্যাসাগর। কিন্তু, মনে রাখতে হবে, দিশা দেখানোর কাজটা রামমোহন রায়-ই করেছিলেন।

     রামমোহন রায় কোন মহৎ চরিত্রের ছিলেন না। মানে মহৎ চরিত্র বলতে যেভাবে আগাপাশতলা শুদ্ধ ও অপাপবিদ্ধ বলে ভারতে মনে করা হয় তেমনটা তো নয়ই। তার বাগানবাড়ীর আবিলতাকে অনুসরণ করে দ্বারকানাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারকে অনেকটাই লজ্জার মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। নীলচাষের সমর্থনে সে সময়ে প্রভূত অর্থ উপর্জন করেছিলেন বটে, আবার লোকের অভিশাপও কুড়িয়েছিলেন সামাজিক প্রতিপত্তির দিকেও তার ছিল বেশ ঝোঁক। যে কারণে চিরস্থায়ী বন্দোবস্থকে রীতিমতো সমর্থন করেছিলেন। আবার, দক্ষিণ আমেরিকার দেশেগুলোর ঔপনিবেশিক স্বেচ্ছাচার থেকে মুক্তিতে, কিম্বা ফ্রান্সের স্বাধীনতাতে আনন্দ পেয়েছিলেন, সমর্থন জানিয়েছিলেন (স্পেনের সংবিধান তাকে উৎসর্গ করা হয়েছে) বটে, কিন্তু পাশাপাশি মনে করতেন ভারতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাষন থাকাটাও জরুরী। অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে যেখানে তিনি স্বাধীনতাকে সমর্থন করছেন, সেখানে, মুঘল জমানা শেষে নিজের দেশে ইংরেজ রাজকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। সব মিলিয়ে আলোয়-অন্ধকারে মিশে যে মানুষটি আমাদের সামনে আসছেন, তিনি আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ তো বটেই, তা বলে সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।

 

 

এবারের দুটি পত্রিকা নিয়ে আলোচনায় আসি, যারা রামমোহন রায়কে নিয়ে ভেবেছেন, কাজ করেছেন।

     দেশ এবং কৃত্তিবাস --- দুই পত্রিকাতেই বারিদবরণ ঘোষের দুটি রচনা অমূল্য। এই ধরণের মানুষ বেঁচে আছেন এবং এখনও সক্রিয় আছেন বলে পশ্চিমবঙ্গের গর্ববোধ করা উচিৎ। এই মানুষটার প্রবন্ধ সমগ্র আছে কি? মনে তো হয় না। অন্তত আমাদের সুবর্ণ দিনের যে সময়গুলোকে নিয়ে কিম্বা যে মানুষদের নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি তার সঠিক মূল্যায়ণ এখনও ইনি করে চলেছেন।

     ‘দেশ’ পাল্টায় নি। সেই এক ধারা, এক প্যাটার্ণ। পরিবর্তে ‘কৃত্তিবাস’ চমকে দিয়েছে। রাজার আলো-অন্ধকার নিয়ে রীতিমতো কাঁটাছেড়া হয়েছে। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, শাশ্বতী ঘোষ, অনুরাধা রায় বা তপজা মিত্র কি সব অসাধারণ প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন আমাদের! যা রীতিমতো ভাবতে বাধ্য করায়। কৃত্তিবাস রাজা রামমোহনকে পূজার আসন থেকে টেনে এনে দাড় করিয়েছেন জন-অরণ্যের প্রশ্নচিহ্নের মাঝখানে। এমন একটা ম্যাগাজিন সম্পদ হয়ে থাকবে আমাদের মতো মুর্খদের কাছে। আর সন্দীপন সেনের লেখাটা মন্দ নয়। যতটা উৎসাহ নিয়ে শুরু করেছিলাম, ততটা উৎসাহে পরিসমাপ্তি হল না।

 

     সবশেষে একটাই কথা, রাজাকে নিয়ে গত রবিবার যে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের হিড়িক বিদগ্ধ বাঙালী জনমানসে পড়ে গিয়েছিল, এই রবিবারে সেটার আর কোন চিহ্নও নেই। অতীতের রাজা আবার অতীতের অন্ধকারে ডুবে গেছেন। পঞ্চাশ বছর পরে, আশা করি, বাঙালী জাতির অস্তিত্ব থাকলে, আবার এমনটাই শ্রদ্ধার হিড়িক পড়বে। সুখের বিষয়, ততদিন আমার বেঁচে থাকার কথা নয়। একেশ্বরের কাছে তেমন বাড়াবাড়ি দাবীও করি না।

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে