একটা প্রশ্ন

 



"মিসি, এবার থেকে কি তুই আমাকে একটু কম কম ভালোবাসবি?"

 

মাসী > মাসসি > মসসি >  মিসশি > মিসি

আমার নামের অপিনিহিতি, না কি অভিশ্রুতি? কে জানে। যাই হোক, আমি ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারোর মিসশি বা মিসি ওরফে মিস এলিজাবেথ স্বোয়ান। ক্যাপ্টেনের বয়স সাকুল্যে তিন বছর। সে একটা টুপীর মাথায় ‘কাটাকুটি’ চিহ্ন এঁকে সেটাকে পড়ে ঘুরে বেড়ায়। আমার ঘরে এলে আমার ওড়না নিয়ে তার একপ্রান্ত প্রথমে জানলার রেলিং-এ বাঁধে, তারপর আরেকপ্রান্ত ধরে ঝোলাঝুলি শুরু করে দেয়। ঝুলে ঝুলে একবার সোফায়, আর একবার বিছানায় --- এভাবে ঝুল খেয়ে খেয়ে সে নাকি জাহাজ থেকে জাহাজান্তরে যায়। আমাকে অনেকবার আহ্বান করেছিল মিস এলিজাবেথ স্বোয়ানের মতো তার সাথে ঘরময় এই অকূল দরিয়ায় ভেসে পড়ার জন্যে। ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও বয়সের ভারে সাহস পাই নি।

ক্যাপ্টেন খুবই বুদ্ধিমান। সে আমার হতভাগাকে একবার দেখেছিল রাস্তায়। একটা চকোলেট আদায় করে নিয়েছিল। সেটা খেতে খেতে ফেরার পথে আমায় জিজ্ঞাসা করেছিল, মিসশি, ও কি তোর উইল টার্নার?

আমাদের বাড়ীতে থাকলে ক্যাপ্টেন আমাকে নিয়ে সমুদ্র অভিযানে বেরোয় দুপুরবেলা। আমাদের ডাইনিং রুমের ফ্রীজ আর রান্নাঘরের মিটকেস হল ওর গুপ্তধনের চোরকুঠুরি। ক্যাপ্টেনের আগমন বার্তা এলেই আমাদের দুজনের জন্য গুপ্তধন জোগাড় করেন আমার বাবা আর মা। রেখে দেন যথাস্থানে। দুপুরে আমরা তার সদব্যবহার করি। ক্যপ্টেনের ক্ষেত্রে মায়ের কোন আপত্তি নেই। যত আপত্তি মিস এলিজাবেথের ক্ষেত্রে। আমি নাকি গুপ্তধনের পাল্লায় পড়ে ধুমসী হয়ে যাচ্ছি।

আমার বাবা-কাকারা সম্পর্ক-দুঃসম্পর্কে অনেক ভাই-বোন। সবাই মোটামুটি পাশাপাশি কাছাকাছি থাকি। এহেন এক জ্যাঠতুতো বোন, যে কি না আমাদের জেনারেশানে সব্বার বড়ো, তার বৈবাহিক রোমান্সের কারণে এই ক্যাপ্টেনের ধরাতলে আগমন। তার আরেকটি বোন দু-বছর আগে বিয়ে করেছিলেন। তার রোমান্সের কারণে সম্প্রতি এক রক্তিম বিকালে ঝড়ের আবহে আগমন ঘটে আরেক ক্যাপ্টেনের। সেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে আমরা ভাই-বোন সবাই মিলে ঠিক করলাম একসাথে খাওয়া-দাওয়া করে তারপর বাড়ী যাব।

ক্যাপ্টেন জ্যাক স্প্যারো একটু চুপচাপ ছিল প্রথম থেকেই। তার নবাগত ভাইকে দেখার পর থেকেই আমার সাথে সাথেই ঘুরছিল। যখন আইসক্রিম পার্লারে এলাম, তখন ওর মুখে তেমন জ্যোতি নেই। আমরা 'হা হা হি হি' করছি। কে কোনটা খাব তাই নিয়ে তুমুল শোরগোল তুলছি। পার্লারের নীরবতা ভেঙে সকালের মাছবাজার করে দিয়েছি। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো মহিলাকূলের এহেন অসামাজিক আচরণে দোকানের কর্মচারিদের তুমুল বিব্রত করেও উদাসীন থাকছি। বাকিরা যারা নিভৃতচারিণী হওয়ার উদ্দেশ্যে এসে বসেছে তাদের হতাশা তাদের চোখেমুখে ব্যাক্ত হলেও আমরা দেখেও যেন দেখছি না। সব মিলিয়ে সে এক একুশে আইনের মারপ্যাচে আইসক্রিম পার্লারকে ফেলে দিয়েছি।

ক্যাপ্টেনকে আমি জিজ্ঞাসা করি নি কি খাবে। আমি তো জানিই ও কোন আইসক্রিম সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে। 'মিক্সড ফ্রুট কোকো আইসক্রিম'কত দুপুরে আমরা চুপি চুপি ফ্রীজ খুলে এসব বানিয়ে খেয়েছি। খেতে খেতে কতবার বলেছে, নেক্সট বার সে জাহাজে শুধু এই আইসক্রীমটাই রাখবে, আর কোন খাবারই না কি ওর মুখে দেওয়ার যোগ্যটা অর্জন করতে পারে নি। অবশ্য আরেকটা শর্ত থাকতে হবে। যদি আমি তার সাথে যাই তো...

আমি ওর জন্যে নিয়ে এলাম ওর প্রাণপ্রিয় আইসক্রিমটা। ওর পাশে বসলাম। বড়দি ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই তাহলে রহস্য! তাই এত্ত ন' দিদু ন' দিদু আর মিসি মিসি করে পাগল করিস!

এক চামচ এলিজাবেথ খাবে আর এক চামচ ক্যাপ্টেন খাবে --- এই হল অলিখিত নিয়ম। যদিও পরের দিকে এই নিয়ম তালগোল পাকিয়ে যাবে।

প্রথমে চেরিটা আমাকে ও খাইয়ে দিল। আর তারপরেই আমার কানে ঠোঁট রেখে জিজ্ঞাসা করল সেই অনাদি অকৃত্রিম প্রশ্ন,

"মিসি, এবার থেকে কি তুই আমাকে একটু কম কম ভালোবাসবি?"

 

একটি শিশু সম্ভবত প্রথম অনুভব করছে ঈর্ষা আর সেই ঈর্ষা থেকে উদ্ভুত অভিমান। সে জানে না কীভাবে একে মিস্টি করে চেপে যেতে হয়। সে জানে না কীভাবে এই ঈর্ষাকে জয় করতে হয়। সে এই প্রথম এই অনুভবের সাথে পরিচিত হল। এই প্রথম তার মনে হল, সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নয়। যত সময় যাবে, দিন যাবে, এই অনুভূতির সাথে আরোও আরোও বেশি করে পরিচয় হবে। হয়তো মূক যন্ত্রণা বা অভিমান নিয়ে প্রিয় মানুষের কাছে আশ্রয় নেবে। কিম্বা হয়তো তীব্র আক্রোশে প্রত্যাঘাত করবে।

ভালোবাসার সহাবস্থান হয় না! তবুও ভালবাসা ভাগ করে নিতে হয়। মানুষ পলিগ্যামি বলেই কি? কে জানে!

 

সমাজই ধীরে ধীরে তাকে শিখিয়ে দেবে।


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে