মেয়েটা



বর্ষণসিক্ত অন্ধকারে জানালার সামনে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। কিছু যে ভাবছিলাম, তা নয়। বরং দেখছিলাম। বৃষ্টি ধরেনি। ঝড় থামেনি। তীব্রতা কম। সারা পাড়ায় আলো নেই। জেনারেটার নেই। মায়াবী সন্ধ্যা আলো ঢেকে দিয়েছে মেঘের চাদর। চারদিক যেন উৎসবিহীন হালকা আলোয় এবং ঘণ হয়ে আসতে চাওয়া অন্ধকারের খেলা।

     উল্টোদিকের বাড়ীতে ক্ষীণ লন্ঠনের আলো। তাতে তার ঘরের অন্ধকারকে দূর করেছে বটে, মনের ত্রাসকে সরাতে পেরেছে কি? বাড়িটাতে থাকে সদ্য বিয়ে করা এক দম্পতি। স্বামীর নাইট ডিউটি। সে চাকরী করে রেলে। মেয়েটা ওখানে এখন একা।

ওরা নতুন ভাড়া এসেছে। মেয়েটার চোখ গোলগোল, বড়, কৌতুহলী, ভীরু। অথচ দিঘীর জলের মতো টলটলে। কথা বলে মৃদুমন্দস্বরে। লাজুক। বিয়ের জল গায়ে লেগেছে। এ পাড়ায় আসার পর, যা দেখে তাতেই বিস্মিত হয়। দিনাজপুরের মেয়ে। মেয়েটা খুচরোকে হঠাৎ হঠাৎ বলে ফেলে --- ‘রেজকি’।

সে কি করছে এখন? মা বলেছিলেন একবার, মেয়েটা একা আছে, ডেকে নেবে কি না এই ঝড়ের সন্ধ্যায়। কিন্তু ফোনের নাম্বার জানা নেই। ঝড়ের আওয়াজে শব্দ সেখানে পৌছায় না। মেয়েটা একাই আছে।

মেয়েটা একটু ভয়ে ভয়ে থাকে। শহরের কেতা তার জানা নেই। আমাদের বাড়ীতে প্রথম যেদিন এসেছিল, চায়ের কাপ ছুঁতেও তার ভয়। আমাদের সোফাতে বসেছিল আলগোছে। সেখানে তার ডুবে যাওয়ার ভয়। চারদিক বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে দেখছিল অবাক বিস্ময়ে। ওর বিস্মিত চোখে আমাদের দৈনন্দিন আলগোছে থাকা জিনিসগুলোকেও মনে হচ্ছিল মহার্ঘ্য। অমন লাওপালার স্নিগ্ধ কাপকে সে ডরায়। হাটবারে কেনা চীনামাটির কাপে যেদিন তার বাড়ীতে গিয়ে চা খেলাম, বুঝলাম, মনের জড়তা একটা বড়ো বালাই। মেয়েটা একটা গন্ডগ্রামে থাকত।

জানলা অনেক রহস্য উজাড় করে দেয়। মেয়েটাকে একা একা দেখেছিলাম চুপ করে বসে থাকতে জানালার ধারে, প্রথম বেশ কয়েকটা রাত। সারা পাড়া ঘুমিয়েছে। সে জেগে আছে। 'অবনী, বাড়ি আছিস?' বলে তার কোন কাছের মানুষ আসে নি। আসে না। মেয়েটার নাম অবনী।

মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। জানালার ধারে গ্রীলে মাথা রেখে হাসি-কান্নায় অনেক প্রলাপ বকে সে। কি খায়। কোথায় যায়। কি দেখে। কি শোনে। তার ভাষার অনেক শব্দ বুঝি না। কেবল চোখের চাহনি ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। মেয়েটার গলা খুব সুরেলা।

একদিন মেয়েটার সাথে গল্প হচ্ছিল এ জানলা থেকে ও জানলায়। সে তার দেশের বাড়ীরই কথা বলছিল। সে খোঁজে তার পুকুরের ঘাট। সে খোঁজে মাঠের আল। সে খোঁজে গাছের ছায়া। এখানে, মফস্বলে, তা একটু দুর্লভ বই কি। যে ঝড়ে একছুট্টে সে কুড়াতে যেত আম, সেই ঝড়ই এখানে চার দেওয়ালের মাঝে তাকে ভয়ে কুঁকড়িয়ে দেয়। খোলা মাঠের উদ্দামতা ঢেকেছে ইটের দেওয়াল। নির্ভীককে করেছে ভীরু। মেয়েটা এখন প্রাণপণে টিকে থাকার লড়াই করছে।

সেখানে গাছের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল না। এখানে মানুষের জঙ্গলে পদে পদে হারানোর ভয় --- স্বামী, আত্মীয়, সম্ভ্রম।

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে