প্রমদা এবং এক কিশোর

আমার রবীন্দ্রনাথ - পর্ব ৩



আয় লো প্রমোদা!      নিঠুর ললনে

      বার বার বলি কি আর বলি!

মরমের তলে লেগেছে আঘাত

      হৃদয় পরাণ উঠেছে জ্বলি!

 

একটি তেরো-চোদ্দ বছর বয়সের ছেলে লাইনগুলো লিখছে। মানে আজকের যুগে ধরুন ক্লাস এইট কি নাইনে পড়া কিশোর। তা সে লিখতেই পারে। যে কিশোর ক্লাস ওয়ান থেকে কো-এড স্কুলে পড়ে এসেছে, তার পক্ষে প্রেমজ আবিলতা আজকের যুগে খুব একটা বিস্ময়কর নয়। কিন্তু ১৮৭৫ সালে সেটা বিস্ময়করই শুধু নয়, চরম বেমানান।

কিশোর রবীন্দ্রনাথের জগৎ তখন কেমন ছিল? সদ্য হিমালয় থেকে ফিরে আসা রবীন্দ্রনাথের স্কুল ভাগ্য বড়ই করুণকান্নার জোরে ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে ভর্তি হয়েছিলেন ছোটবেলায়তার কিছুদিন পরে সেখান থেকে নর্মাল স্কুলশিক্ষক এবং সহপাঠীদের কুরুচিকর ব্যবহারে পালালেন সেখান থেকে। তার ভৌগলিক পরিধি জোঁড়াসাঁকোর বাইরে তখনও যায় নি। হিমালয়ে যাবেন, আরোও কিছুদিন পরে। ফিরে এসে সেন্ট জেভিয়ার্সে যাবেন বটে, তবে কামাই করার ধুম পড়ে যাবে এমন যে, সোমেন্দ্রনাথ পাশ করলেও তিনি এক্কেবারে ফেল করবেন

এরপর বাড়িতেই চলল শিক্ষা সাধনা। আস্তে আস্তে টুকটাক অনুবাদ। কবিতা লেখা। বুঝি বা দু-একটা গান --- জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুন। হাতে আসছে ‘বিবিধার্ত্থ সঙ্গ্রহ’ ‘অবোধবন্ধু’, ‘বঙ্গদর্শন’হিমালয় থেকে ফিরে টুকটাক যা লিখছেন, সেগুলির স্বনামে পরিচয় লুপ্ত। তিনিই করেছেন। কিছু কিছু বর্তমানে ‘অচলিত সংগ্রহ’-এর দুখন্ডে স্থান পেয়েছে। তবে সেগুলিও লোপ পেলে খুশিই হতেন তিনি। একে একে লিখেছেন বনফুল, কবিকাহিনী, শৈশব সঙ্গীত, রুদ্রচন্ড, মালতীপুঁথি। কয়েকটি নাম বারবার ঘুরেফিরে আসে কাব্যে --- প্রমদা, নলিনী, কবিশেখর। এরই মধ্যে নারীর আঁচলের স্পর্শ কেমন করে লাগল?

বস্তুত সেই সময়ে গড়পড়তা কিশোরের মনে প্রেম আসে না। কৌতুহল থাকে বাইরের জগতে। সেখানে নারী অতি দুর্লভ বস্তু। বিয়ে হয়ে গেলে আলাদা কথা। অথবা বাড়ির মা-বোনদের সঙ্গ কখনই প্রেমের এমন আগুন জ্বালাতে পারে না।

কিন্তু তিনি তো রবীন্দ্রনাথ। এর মধ্যেই যিনি সম্পূর্ণ ম্যাকবেথ ও কুমারসম্ভব অনুবাদ করে স্বয়ং বিদ্যাসাগরের প্রশংসা আদায় করে নেবেন, তিনি কি কম কেউকেটা! তার হৃদয়ের গভীরতা এমন অতল যে তার পক্ষে এমন লাইন রচনা করা অসম্ভব কিছু নয়। যে যতই ইঁচড়ে পাকা বলে মনে হোক না কেন তাকে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। তার সাথে যোগ করুন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের অতুল উৎসাহ।

হিমালয় থেকে ফিরেই মা ছাড়া আর একজন যিনি তার সমস্ত স্নেহসুধা ঢেলে দিয়েছিলেন, এবং পরবর্তীকালে অনেক হাসিকান্নার সঙ্গী হবেন তবে কি তিনিই মনের অগোচরে কোথাও প্রমদা হয়ে স্থান করে নিয়েছেন? কে জানে! আন্না তড়খড়ে তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। বিলাত যাত্রীর ডায়রী থেকে অনেক নীলচোখের অপাঙ্গ ইঙ্গিতের আভাস মেলে, তারা কেউ এই প্রমদা নয়। এই প্রমদা একদম বাঙালিনী, তার অভিমান আছে, তিরস্কার নেই। সে নীরবে সব সহ্য করে, তবু মুখ ফুটে কোন প্রতিবাদ করে না। তবে ইনি কে?

রবিবাবু, আপনিই জানেন সে কে। সে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। এই রচনাগুলিকেও আপনি সমূলে বিনাশ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার পরবর্তী লেখাগুলোতেও যে এই প্রমদার ইঙ্গিত মেলে তাকে বিনাশ করবেন কি ভাবে? ঠিক এর পরেই যে আপনি লিখবেন, এবার প্রমদার হয়ে লিখবেন। লিখবেন ---


তুঝ মুখ চাহয়ি শতযুগভর দুখ

    নিমিখে ভেল অবসান

লেশ হাসি তুঝ দূর করল রে

    সকল মান-অভিমান

 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে