নেতাজী, শাস্ত্রীজী, রাজনীতি এবং একটি জন্ডিস কেস

 



লাল বাহাদুর শাস্ত্রী’র নাম আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর জানি। দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী। রাশিয়ায় হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছিল তার, এবং এই মৃত্যুকে ঘিরে অনেক রহস্য আছে। অনুজ ধরের বই ‘Your Prime Minister is Dead’, সুজিত রায়ের ভাবান্তর ‘তোমার প্রধানমন্ত্রী মৃত’ এবং ‘The Taskent File’ সিনেমাটা পাশাপাশি রাখলে মোটামুটি যে সমস্ত ‘কনস্পিরেসী থিওরী’ উঠে আসে সেগুলো একবার দেখে নেওয়া যাক প্রথমে ---

মৃত্যুর কারণ --- ইনফাক্‌ট মায়োকর্ডাটা।

যে হোটেলে থাকার কথা সেটা হঠাৎ করেই পরিবর্তন করে তার থাকার ব্যবস্থা একটা কটেজে করা হয়। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে একটা বড়সড়ো প্রশ্নচিহ্ন রয়ে যায়।

ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার না থাকাদু’বার হার্ট অ্যাটাক হওয়া প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে এটা একটা বড়োসড়ো উদাসীনতাওনার ব্যবহৃত থার্মোফ্লাক্স মিসিং। এবং যখন তার হার্ট অ্যাটাক হয় তৎপরবর্তী তিনি এই ফ্লাক্সের দিকেই আঙ্গুল তুলে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও ওনার দৈনন্দিন ডায়রীটাও আর মেলে নি

হার্ট অ্যাটাকের পরেই ইন্ট্রামাসকুলার ইঞ্জেকশান দেওয়া হয়, যেখানে দেওয়া উচিৎ ছিল ইন্ট্রাভেনাস ইঞ্জেকশান। এছাড়াও তাকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড না ক্যালশিয়াম ক্লোরাইড দেওয়া হয়েছিল সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে

মেডিকেল রিপোর্ট নিয়ে চুড়ান্ত দ্বন্দ্ব এবং ধন্দ। ভারতীয় মেডিক্যাল রিপোর্ট এবং রাশিয়ান মেডিক্যাল রিপোর্ট আলাদা। তার দেহে বিভিন্ন ক্ষতস্থান ছিল। মুখ নীল হয়ে গিয়েছিল। যদিও কোন দেশের তরফ থেকেই কোনোরকম পোস্টমর্টেম করা হয় নি। এবং পরবর্তীকালে এ নিয়ে কোন তদন্তের দাবী উঠলে বারবার খারিজ করে দেওয়া হয়েছে তৎকালীন সরকারের তরফ থেকে

নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ওরফে গুমনামী বাবা-র সাথে গোপন মিটিং

CIA এবং KGB কর্তৃক হত্যাতত্ত্ব। শাস্ত্রীজীর মৃত্যুর পাশাপাশি কিছুদিন বাদে হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা-র বিমান দুর্ঘটনা এই তত্ত্বকে আরোও জোরদার করে। সেইসাথে কিছুদিন পর ডঃ চুঘ এবং রামনাথের এক্সিডেন্ট। দুজনেই বর্তমানে মৃত।

বিষপ্রয়োগ যদি করা হয়েও থাকে তাহলে কিভাবে হয়েছে? দুধের সঙ্গে, খাবারের সঙ্গে, ঘরের আবহাওয়ার সাহায্যে কিম্বা অন্য কোনভাবে?

শাস্ত্রীজীর মৃত্যুর জন্যে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কোনরকমভাবে দায়ী হতে পারে কি? অথবা, কারণ হতে পারে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব! কিম্বা লোভনীয় বিদেশনীতি?

১০মিত্রোখিন আর্কাইভ --- এই ফাইলেও শাস্ত্রীজী সম্পর্কিত তথ্যের উল্লেখ আছে।

 

এই লেখাটা লেখার আগে অনুজ ধরের অন্যান্য বইগুলোতে চোখ বোলাচ্ছিলাম। ওনার মূল কাজ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসকে নিয়ে, তার অন্তর্ধান রহস্যকে নিয়ে। নেতাজী ভারতীয় জনজীবনে এমন একজন প্রতিনায়ক, কর্ণের মতো। ওনাকে নিয়ে যে কোন কথা, লেখা, এমনকি বাক্যও ভারতভূমিতে এটম বোমের মতো ফাটে। ফলে একটা ছবিকে ঘিরে যে আবেগময় রহস্য তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকেও অনুজ ধর এই মৃত্যুর ওপর একটা হত্যারহস্যের আবহাওয়া তৈরী করার চেষ্টা করেছেন। কারন এর ফলে একটা কনস্পিরেসি থিওরিকে ধরে আরেকটা কনস্পিরেসী থিওরি তৈরী করা খুব একটা কঠিন নয়। এই বইটাতে একটা চ্যাপ্টারই উনি লিখছেন নেতাজীকে নিয়ে, যা এই বইটার মূল বিষয়বস্তু থেকে অনেকটাই সরে এসে

       অনুজ ধরের পরিশ্রমের কোনো জবাব হয় না। একের পর এক সন্দেহ বা ইতিহাস নিয়ে কাটাছেড়া করার এবং তাকে ঠিকঠাকভাবে রিপ্রেসেন্ট করার মুন্সিয়ানা তারিফযোগ্যঅনেক জায়গা পড়তে হয়েছে দমবন্ধ করা উত্তেজনা নিয়ে। কিন্তু দিনের শেষে সত্য কুয়াশাতেই আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।

       এই মৃত্যুরহস্যের আরেকটা বড় দিক হল শাস্ত্রীজী পরবর্তী রাজনৈতিক পটভূমিকা। ইন্দিরা গান্ধীর যে ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অন্যতম কুটিল ইঙ্গিত। বইতে এবং সিনেমাতেও মিত্রোখিন ফাইলকে কেন্দ্র করে সেই থিওরিকে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টায় রাজনীতির গোপন কুটিল অন্ধকারকে তুলে ধরতে গিয়ে কোথাও লাল বাহাদুর শাস্ত্রীজীকে মহানায়কের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার যে একটা চেষ্টা, তার সত্যিই কি যোগ্য শাস্ত্রীজী ছিলেন? তার পরীক্ষা কিন্তু মহামান্য প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হয় নি। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে ভারতীয় জনজীবনে তিনি এমন এক রহস্যময় ও আবেগময় প্রতিনায়ক হয়ে গেলেন, যে নায়ক হতে পারার ক্ষমতা তার ছিল কি না তা নিয়ে দ্বন্দ্ব চলবেই, যে দ্বন্দ্বের শীর্ষে অবস্থান করছেন বর্তমানে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস

       অনুজ ধর ‘আনবায়াসড’ কি না জানি না। কিন্তু কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব কোথাও বোধহয় সত্যের থেকেও মিথ্যার চক্রব্যুহকে অনেক বেশি করে দেখাতে থাকে। অনেকটা ব্ল্যাক হোলের সামনের ‘ইভেন্ট হরাইজনের’ মতো। যে যে তথ্যকে কেন্দ্র করে আমরা থিওরি দাড় করাচ্ছি, সেই সেই তথ্যও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না সেটা স্থির করা আগে প্রয়োজন হয় সেই সেই তথ্যগুলো যে সমস্ত উপাত্ত দিয়ে নির্মিত হয়েছে তখন আবার সেগুলোকে সত্যের আলোকে দেখতে পাওয়াটা খুব জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। ফলে গোটা কর্মকান্ডটাই একটা সততার উপর নির্ভর করে। কিন্তু রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সততাটাই যেখানে প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি সেখানে তার পোস্টমর্টেম করবে কে? যে কোন ধরনের ‘বায়াসড’ মানুষই এক্ষেত্রে ফেল করে যাবেন।

       ‘ইয়োর প্রাইম মিনিস্টার ইস ডেড’ বইটার আগে ‘দ্য তাসখন্ড ফাইল’ সিনেমাটা মুক্তি পেয়েছিল। অনুজ ধর সেখানেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন সিনেমাটিকেবিবেক অগ্নিহোত্রী যতই ‘12 Angry Men’ -কে ফলো করে তার চিত্রনাট্য নির্মাণ করুন না কেন, এই ধরনের কনস্পিরেসিকে দাড় করাতে গেলে যতটা লজিকাল হতে হয়, ততটা হতে পারেন নি। সেটা কি কোথাও বিষয়টার ওপর আত্মবিশ্বাস না থাকার দরুণ, না কি ভারতীয় জনগণ একটু গান, আর অনেকটা অবেগপ্রবণতার মিশেল না থাকলে দেখতে পারে না বলে? মাঝে মাঝে হেসে-কেঁদে-চীৎকার করে কিম্বা আবেগপ্রবণ বক্তৃতা দিয়ে কি সিনেমাটা বানানো খুব একটা দরকার ছিল? অনেক ভুল আছে সিনেমায়, তা নিয়ে এখানে আলোচনা করব না। কিন্তু যেভাবে তথ্যসমৃদ্ধ একটা সিনেমা বানাতে পারতেন সেটা গুবলেট হয়ে গেল খানিকটা এই অতি আবেগময়তার কারণেই।

       অনুজ ধর অসামান্য লেখক। একজন জার্নালিস্ট জানেন কীভাবে পাঠককে কনভিন্স করতে হয়। তিনি তার অনেকটাই পেরেছেন। কিন্তু মূল বিষয় নিয়েই ধন্দ রয়ে গেল। উদ্দেশ্য কি ছিল? নেতাজীর চশমা দিয়ে শাস্ত্রীজীকে দেখা? না হলে এমন একটা বইয়ে একটা চ্যাপ্টার নেতাজীকে নিয়ে কেন? এছাড়াও অনেকবার নেতাজী এসেছেন, যার হয়তো ততটা প্রয়োজন ছিল না। অহেতুক ভানওয়ারি দেবী, কিম্বা ইয়াসের আরাফতকে নিয়ে এত এত পৃষ্ঠা খরচ কেন? পরিশিষ্ট বলে তো একটা অংশ থাকে বইতে। অনুজ ধর কি অজান্তেই একটা আবেগকে খোঁচা দিয়ে আরেকটা আবেগকে জাগাতে চাইছেন?

       সুজিত রায়-কে নিয়ে কিছু বলার নেই। এমন অসামান্য ভাবানুবাদ সত্যিই অনেকদিন পর পড়লাম। কোথাও কোন ফাঁক নেই। অনুজ ধরের লেখাকে এবং তার চিন্তাধারাকে রীতিমতো আত্মস্থ করেই এই বইতে হাত দিয়েছিলেন এবং পুর্ণমাত্রায় সফল। এমনকি মূল বইয়ের চ্যাপ্টার সংখ্যাকেও নিজের মতো করে ভেঙে নিয়েছেন। ১১টা চ্যাপ্টারকে ১৩টা চ্যাপ্টারে রূপান্তরিত করেছেন। কিন্তু স্যার, বানান যে বড্ড ভুল! একেকটা পাতায় প্রায় তিন-চারটে করে বানান ভুল, বাক্য কোথাও কোথাও অসম্পূর্ণ। এত ঠোক্কর খেয়ে পড়তে গেলে মেজাজই নষ্ট।

       সবশেষে বইটা পড়ার পর মনে হল, যে উদ্দেশ্যে অনুজ ধর বা বিবেক অগ্নিহোত্রী কাজটা করলেন, ‘সত্য উদ্‌ঘাটন’, তা হল কি আদৌ? না। বরং এক বিখ্যাত লেখকের একটা বিখ্যাত বাক্য মনে পড়ে গেল,

Say not, “I have found THE truth,” but rather, “I have found A truth.


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে