রবীন্দ্রনাথের মহাভারত

আমার রবীন্দ্রনাথ - পর্ব ২


সুখ বা হোক দুখ বা হোক, প্রিয় বা অপ্রিয়,

অপরাজিত হৃদয়ে সব বরণ করিয়া নিয়ো॥

[শান্তিপর্ব ১৭৪/৩৯]

 

রবীন্দ্রনাথ মহাভারত থেকে মাত্র দুটি শ্লোক অনুবাদ করেছেন। করেছেন শান্তিপর্ব থেকে। তার মধ্যে উপরোক্ত অনুবাদটির আরোও দুটো পাঠান্তর আছে। এতেই বোঝা যায়, শ্লোকটি তার কাছে কতটা মূল্যবান ছিল। হতে পারে, তার কাছে এই শ্লোকটিই সমগ্র মহাভারতের ভরকেন্দ্র, অথবা মহাভারতের হৃদয়, কিম্বা মহাভারতের মূল কথা।

কিছুদিন ধরে চোখে পড়ছে মহাভারতের চরিত্রগুলিকে নিয়ে তুমুল কাটাছেড়া চলছে। নায়ক খলনায়ক হয়ে যাচ্ছে, খলনায়ক নায়ক, প্রতিনায়ক নিয়ে টানা-হ্যাঁচড়া চলছে। মূল কথা, সিনেমা কিম্বা গল্প-উপন্যাসে নেগেটিভ চরিত্রকে মুখ্য করে দেখার যে ট্রেন্ড শুরু হয়েছে, মহাভারত তার হাত থেকে রক্ষা পায় নি। এতে করে দুটো বিষয় পরিস্কার হচ্ছে --- এক, মহাভারতকে এমন আঙ্গিকেও দেখা যেতে পারে; আর দুই, মহাভারতকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গীর বদল। এমনটা কি আগে হয় নি? হয়েছে। তবে তখন তেমন কল্কে পায় নি। কিম্বা তার সংখ্যা নগণ্যমাত্র। এখন ফেসবুকে সবাই রাজা।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি ভাবতেন? তিনি জাতির অভিভাবক, মহাত্মা গান্ধীর মতে। তাকে লোকে মানুক চাই না মানুক, তার চিন্তাশক্তিকে হতচ্ছেদ্দা করতে গেলে অনেক বড় মুর্খ হতে হবে আর সেই মুর্খতাকে প্রদর্শন করতে গেলে আরোও বড় বুকের পাটা থাকতে হবে। এতএব তারই স্মরণাপন্ন হলাম।

রবীন্দ্রনাথ অনেকভাবে মহাভারতের কথা অনেক জায়গায় বলেছেন। আমি কাব্যগুণ এবং চরিত্রগুণ থেকে সরে গিয়ে মূলত তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা, আমার মনে হয়, ভারতভূমির ভিত্তিপ্রস্তর। মানবচরিত্র, মানবসমাজ এবং মানবধর্ম।

প্রথম কথা, রবীন্দ্রনাথের কাছে মহাভারত কখনই শুধুমাত্র কাব্য ছিল না। ছিল ভারতবর্ষের ইতিহাসও। প্রাচীনসাহিত্যে বলছেন সেই কথা, ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে-- রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই।

অর্থাৎ, ভারতীয় সমাজ, যে সমাজের আমরা অংশ, সেই সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির কিম্বা বিদুর --- ন্যায়স্বরূপ। দুর্যোধন, শকুনি, কর্ণ, ধৃতরাষ্ট্র --- অন্যায়স্বরূপ। অর্থাৎ, ভারতবর্ষীয় সমাজে ন্যায় এবং অন্যায়ের সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা এবং উদাহরণ যদি নির্ণয় করতে হয়, তাহলে এই সমস্ত চরিত্রগুলোকে মানদণ্ড হিসাবে ধরতে হবে। মজার ব্যাপার, দেবদত্ত পট্টনায়েক একই কথা বলে বলে মুখে ফ্যানা তুলে দিচ্ছেন। আর আমরা মানদন্ডকেই পরিবর্তন করতে চাইছি। এবং সেটা চাইছি অন্য সংস্কৃতির মানদণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে। যার ফলে মহাভারতের বিশ্লেষনে কোথাও একটা বড় বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ সাবধান করছেন, স্তব্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে, সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কিরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আমি যতবড়ো সমালোচকই হই-না কেন, একটি সমগ্র প্রাচীন দেশের ইতিহাস-প্রবাহিত সমস্ত কালের বিচারের নিকট যদি আমার শির নত না হয় তবে সেই ঔদ্ধত্য লজ্জারই বিষয়।

দ্বিতীয় কথা, মহাভারত শুধুমাত্র একজন নির্দিষ্ট কবির রচনা নয়। আজ সেটা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। অনেক নিক্ষিপ্ত শ্লোক জ্বলজ্বল অক্ষরে তার প্রমাণ দেয়। কিন্তু, যেটা আসল কথা, তা হল, মহাভারত অনেক যুগ ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে ভারতীয় সমাজ গড়ে ওঠার সাথে সাথে। অর্থাৎ মহাভারতের কূটশ্লোকগুলি সামাজিক প্যাটার্নের মানদণ্ড। কালে কালে অনেক যুক্ত হয়ে, অনেক বিযুক্ত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। অর্থাৎ, ব্যক্তির সাথে সাথে এই মহাকাব্য সমাজের মানদণ্ডও বটে। শান্তিপর্ব তার একটা বড়ো উদাহরণ। “সমগ্র জাতির সরস্বতী ইঁহাদিগকে আশ্রয় করিতে পারেন -- ইঁহারা যাহা রচনা করেন তাহাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের রচনা বলিয়া মনে হয় না। মনে হয় যেন তাহা বৃহৎ বনস্পতির মতো দেশের ভূতলজঠর হইতে উদ্ভূত হইয়া সেই দেশকেই আশ্রয়চ্ছায়া দান করিয়াছে। বলছেন রবীন্দ্রনাথ। অর্থাৎ, সমাজব্যবস্থার পরিকাঠামোও অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর যে যায়গায় এসে স্থিতিলাভ করেছে তারই আদর্শ রূপ মহাভারতে স্থান পেয়েছে।

তৃতীয় কথা, ভারতবর্ষীয় ধর্ম ও দর্শন। ভারতে যা ধর্ম, তাই দর্শন। পাশ্চাত্যের মতো দুটোতে কোন পার্থক্য নেই। স্বামীজী স্বয়ং বিশ্বাস করতেন গীতা বুদ্ধের সময়ের পরবর্তীকালের রচনা। কারণ গীতার কর্মকান্ড এবং জ্ঞানকান্ড (বিশেষত মধ্যমপন্থা) বুদ্ধের চিন্তাধারারই অনুসারী, এবং ভাগবতেও আমরা দেখি, দশাবতারে ভগবান বুদ্ধের স্থান এক অবতার রূপে আছে। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মহাভারত রূপক। আর রূপক বলেই তার মধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রের সূচনাকল্পে ভারতবর্ষীয় মূল দর্শনকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হল। গীতা যদি ভালো করে খেয়াল করা যায় তাহলে দেখা যাবে সমগ্র ভারতবর্ষীয় সমাজের বিভিন্ন ভাবধারাগুলোর এক মেলবন্ধন ঘটেছে। এবং সমগ্র ভারতসমাজ গীতাকে মূল গ্রন্থ বা ভারতবর্ষীয় ধর্মের মূল বলে মেনে নিতে দ্বিধাবোধ করে নি। ভারতে এমন কোন জাতি নেই, বর্ণ নেই, ধর্ম নেই যারা গীতাকে অস্বীকার করে। গীতাই হল ধর্ম ও দর্শনের মানদণ্ড। এটা আরোও ভাল করে বুঝতে হলে দেবদত্ত পট্টনায়েকের MY GITA সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

অর্থাৎ, রূপকের আকারে সম্পূর্ণ ইতিহাসকে ব্যক্ত করা। কীসের ইতিহাস? আমাদের ইতিহাস। ভারতভূমির ইতিহাস। এমন এক ইতিহাস, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রথমে শ্রুতিতে, পরে সম্ভবত গুপ্তযুগে লিখিত আকারে তার সম্পূর্ণতা লাভ করে। সেই সাথে, এক আদর্শ মানবসমাজ কেমন হতে পারে তার রূপদান করারও চেষ্টা চলে। সে ইতিহাসের মুল্য আছে বলেই এত ধরনের মহাভারত রচনা হয়, আজও তার ব্যাখ্যা হয়। শিল্পে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে তার রূপায়ন হয়ে চলে। সে আছে বলেই তার মূল্য। কিন্তু সেই মূল্য মূল আঙ্গিকটি ধরে না হলে সমস্তটাই ত্যাজ্য। সেই মূল্য মহাকবিরে প্রেক্ষিতে সৃষ্ট মূল্য। অন্য কারো মূল্যবোধ যদি মহাকবির চিন্তনের সাথে মেলে তা গৃহীত হবে, অন্যথায় বর্জন করাই শ্রেয়।

রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, আর রবীন্দ্রনাথ বলছেন, দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। লিখলে তার পরবর্তী সংষ্করণে পরিবর্তন সাধন সম্ভব। কিন্তু মুখের কথার ক্ষেত্রে তা হয় না। ১৯৩৯ সালের একেবারে শেষের দিকে অর্থাৎ প্রায় আশি বছর বয়সের কাছাকাছি সময়ে তার দৃষ্টিতে মহাভারত ঠিক কি তা মৈত্রেয়ী দেবীকে বলে গেছেন। সেটা দিয়েই এ কথাপ্রসঙ্গের সমাপন ঘটাই,

“একটি কথা মনে রাখতে হবে যে মহাভারতের সম্পূর্ণ গল্পটা রূপক। এর একটা কথা বলবার আছে এবং সে কথা কৃষ্ণকে অবলম্বন করে। কৃষ্ণই এর নায়ক। পঞ্চপাণ্ডব গ্রহণ করেছিল কৃষ্ণকে অর্থাৎ কৃষ্ণের Cult-কে। তা না হলে পঞ্চভ্রাতাকে এক কন্যা মালা দিল, সেও কখোনো সম্ভব? কৃষ্ণকে যারা বরণ করলে, কৃষ্ণের তারাই আশ্রিত। লড়াইটা জমির জন্য নয়, লড়াই কৃষ্ণকে নিয়ে, --- লড়াই মতের। তা যদি না হতো তাহলে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাঝখানে হঠাৎ ওই একশো গজ লম্বা গীতা আওড়ানো কখনো সম্ভব হতো না, কোন মানে হতো না তার। ... মহাভারতের সবচেয়ে যে গভীর মর্মকথা, যে উপদেশ, সে মুনিঋষিদের উপদেশ বা যুধিষ্ঠিরের আদর্শবাদীতার মধ্যে নেই, সে মহাপ্রস্থানে। এত বড় যুদ্ধ, এত মারামারি হানাহানি, সে লোভের জন্য নয়, স্বার্থের ঘৃণ্যতার মধ্যে তার সমাপ্তি নয়। ত্যাগের জন্যই যে আকাঙ্ক্ষা, বর্জনের জন্যই গ্রহণ, সেই নির্দেশই এই কাব্যের প্রধান কথা।”

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে