বিষয় সত্যজিৎ




সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে তাকে নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা চোখে পড়ে। দিনে দিনে তা বাড়ছে। আমরা এইটুকুই করতে পারি। তাকে নিয়ে লিখতে পারি, তার সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে পারি, তার সিনেমা, তার সাহিত্য, তার সুরারোপ, তার আঁকা --- সব নিয়েই কেউ না কেউ কিছু না কিছু বলে চলেছেন। বাঙালীর নখদর্পণে থাকা মানুষটাকে নিয়ে আতসকাঁচে ফেলে নিত্যনতুন বইও বের হচ্ছে, কেবল হচ্ছে না তার উত্তরসূরি। সে প্রসঙ্গে কেবল পারি নিজের ছেলেমেয়েদের বলতে, “ওসব সিনেমার ভুত মাথা থেকে নামাও, চাকরীটা লাগিয়ে তারপর যা খুশি কর, আমরা কিছু বলব না।”

ফলে বাঙালী ছেলেমেয়েদের অপেক্ষা করতে হল DSLR ক্যামেরা আসা অবধি, YouTube আসা অবধি, আর JIO ছয়মাস নেট ফ্রী করে দেওয়া অবধি। এখন তাদের নৌকা হালে খানিকটা পানি পেয়ে দৌড়াচ্ছে বটে। কিন্তু ঐ... ‘চাকরিটা আমি পেয়ে গেছি বেলা সত্যি’-র আগে পর্যন্ত।

আমরা সত্যজিতের চিঠিপত্র অবধি ধাওয়া করেছি। পত্রাবলী বেরোলো বলে। কিন্তু তার সিনেমা নির্মাণ নিয়ে যে চিন্তা ভাবনা, সেটা ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক আর ছাত্র-ছাত্রীদের বাইরে বেরোলো না। ফলে ফ্রেম ধরে ধরে তার যে গভীর কাজ সেই গভীরতার অন্তর্দৃষ্টি আমরা পেলাম না, অস্কারের ডায়ালগগুলো মুখস্থ করে কলার তুলে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম।

একটা ঘটনা বলি, তখন আমি ক্লাস টুয়েলভ। আমাদের বন্ধুদের মধ্যে বই দেওয়া নেওয়ার রীতি ছিল। ফলে, আমার জন্মদিনে বেশিরভাগ বন্ধুই আমাকে বই দিতো। আমার এক বন্ধু ছিল। সে বেচারা বই পছন্দ করতো না, কিন্তু আমায় পছন্দ করত। এখন পছন্দ বড় বালাই। ফলে পছন্দের জনের জন্মদিনে পছন্দের জিনিস না দিলে সে জনটি অপছন্দ করে পাছে দূরে সরে যায়, সেই কারণে সে আমাদের মফস্বল উজাড় করে বই খুঁজল এবং অবশেষে যে মহার্ঘ বইটি আমার হাতে তুলে দিল তা দেখে মনে মনে আমার মুখ এবং হৃদয় দুটোই বেঁকে গেল।

বলা বাহুল্য, আমাদের কাছে কিন্তু টাকাটার মুল্য অপরিসীম। যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়টায় হাতে টাকা ব্যপারটা অনেকটাই ‘সোনার পাথরবাটির’ মতো। টাকা ছিল, কিন্তু সেই বয়সে তা হাতে পেতে হলে অনেক জবাবদিহি করতে হত। বন্ধুটি কত জবাবদিহির গোলকধাঁধাঁয় ঘুরে বইটা আমার হাতে তুলে দিতে পেরেছিল, সহজেই অনুমেয়। কিন্তু দেওয়ার আনন্দে মশুগুল হয়ে যেটা আমার হাতে তুলে দিল, সেটা হল এই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’ বইটা। সে তার বাড়ীর পেপারওয়ালাকে বলেছিল, দুশো টাকার মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের লেখা যা হোক কিছু একটা বই আনতে। পেপারওয়ালা এবং আনন্দ পাবলিশার্স --- দুজনেই দুজনকে চিনত না। যখন চিনল তখন এই বইটাতেই তারা নিজেদের মধ্যে রফা করল। বন্ধুটি বইটা হাতে নিয়ে আমার কাছে এল। আমিও গ্রহণ করে তাকে ঋণী করে মনে মনে বললাম, হে বন্ধু, বিদায়।

কিন্তু, পরবর্তীকালে যতবার বইটা হাতে নিয়েছি, মনে মনে তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনি। রাস্তায় এখনোও চোখাচোখি হলে, কথা হলে মনে মনে তাকে অজস্রবার ধন্যবাদ দিই। তাকে অনেকদিন কৃতজ্ঞতাস্বরূপ রান্না করে খাইয়ছি। সে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বিদায় নিলেও মনে হয়েছে, কম কৃতজ্ঞতা জানানো হল।

একজন পরিচালক তো আর ক্যামেরা ধরলেই অস্কার পায় না। তার পেছনে অনেক পড়াশোনা থাকে। অনেক চিন্তার প্রেক্ষিত থাকে। অনেক রিসার্চ থাকে। সেটা শুধু গল্প নিয়ে নয়। সেটা পরিচালনা করার আর সিনেমা দেখার অন্তর্দৃষ্টিও। সেটার প্রতিফলন এই বইতে এত বেশি যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই।

আঠারোটা প্রবন্ধ মণিমুক্তার মতন। অনেক জায়গায় বিতর্কের অবকাশ থাকতেই পারে। কিন্তু চিন্তার স্পষ্টতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি সিনেমা ভালো বুঝি না। কোনদিন সিনেমা করবও না, অভিনয় তো নয়ই। কিন্তু এই শিল্পটা যে বর্তমান সময়ে কতটা আমাদের কাছাকাছি তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আর সত্যজিতের অনেক সিনেমাই বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। তার কারণ একটাই, বিষয়বস্তুর আবেদন। আর সত্যজিতের সত্যজিৎ হয়ে ওঠা? সেটার ইঙ্গিত এই প্রবন্ধগুলোতে মেলে। যারা সিনেমা নিয়ে ভাবছেন তাদের কাছে এই বইটা একটা বড় সহায়। বর্তমানে তার সমস্ত প্রবন্ধগুলোকে নিয়ে একটা সংকলন বেরিয়েছে শুনেছি। আনন্দ থেকেই। কিন্তু সেই সময়ে সবেধন নীলমণি এই একটিই প্রবন্ধের বই ছিল।

বন্ধুর দেওয়া উপহারটি সযত্নে বুকের কাছে নিয়ে আবার বসলাম। চোখ বোলাতে লাগলাম। এবং কখন যেন আবার ডুবে গেলাম। অনেকবারের পড়া প্রবন্ধ। চেনা বিষয়। কিন্তু কি সাবলীল! পড়তে পড়তে আবার মুগ্ধ হলাম। এই মুগ্ধতাবোধ যাওয়ার নয়। বাংলা সিনেমায় সত্যজিৎ রায় এমন এক ইন্সটিটিউশান, যেখানে ছাত্রসংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। আর এই বইগুলো Out Of Print এর দিকে এগোচ্ছে।

 

================

বিষয় চলচ্চিত্র

সত্যজিৎ রায়

আনন্দ পাবলিশার্স 

Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে