RAPE, দুটি সিনেমা ও কিছু প্রশ্ন



Rape বা ধর্ষণ --- শব্দটা উচ্চারণ করলেই মনে যা ভেসে আসে তা হল, এক বা একাধিক মানুষ মিলে অন্য একজন অনিচ্ছুক মানুষের সঙ্গে মূলত যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে। সমাজের স্বাভাবিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে এই 'অন্য একজন' বললে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারীর মুখ মনে আসে। যদিও বর্তমানে এর জটিলতা অনেক বেশি।

ভারতবর্ষে NCRB –র তথ্যানুযায়ী, প্রতি ষোল মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষণের শিকার। সত্যি কথা বলতে কি, প্রায় প্রত্যেক মহিলাই জীবনের কোন সময়ে এক বা একাধিকবার যৌন হেনস্থা বা মলেস্টেশানের শিকার হয়েছেন বা হন। যে ভারতবর্ষ মেয়েদের ‘মায়ের জাত’ বলে পূজা করে, তার সন্তানদের এই আচরণের তথ্য দেখলে মনে হয় দেশটা হিপোক্রিটের দেশ।

আরোও আছে, এইটুকু পড়ে অনেকে যারা মেয়েদের এহেন দুর্দশাতে চোখে জল আসছে বলে মনে করছেন এবং একটা সহানুভূতির ‘চুক্‌চুক্‌’ শব্দ সারা হৃদয় জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে, তাদের কজন মেয়েদের দিকে অন্য নজরে তাকাননি বলতে পারবেন? খবরের কাগজে, কিম্বা নিউজ মিডিয়ায় যেভাবে যৌন হেনস্থার খবর দেওয়া হয় তাতে করে বোঝা যায় যে, এই বিষয়ের TRP কতটা উচ্চগামী। খুন আর ধর্ষন --- এই দুটোতে মানুষ যে পরিমান কৌতুহল অনুভব করে তা আর কোন কিছুতেই নয়। OTP প্ল্যাটফর্মগুলোর বিষয়বস্তুও বড় একটা প্রমাণ। ফলে ভারত জুড়ে, বা বলা যায়, বিশ্বজুড়ে #ME_TOO এত শোরগোল ফেলেছিল। এত এত মেয়ের প্রতিদিন প্রতিক্ষণ সংসারে, কিম্বা সমাজে যে পরিমাণ সন্মানহানি হয় তা আর বিস্ময়কর না হলেও, যন্ত্রণাদায়ক।

উত্তরে একটা কথা বারবার উঠে আসে। মেয়েদের জন্যে আইন। সত্যি কথা, অনেকাংশ ক্ষেত্রেই আইন মেয়েদের পক্ষে। Domestic Violence, কিম্বা Social Molestation –এর ক্ষেত্রে কড়া দাওয়াই আছে। এবং ঠিকঠাকভাবে বিচারের লাভের জন্যে অনেক NGO এখন মেয়েদের পাশে। ফলে দুই দশক ধরে ভারতে মেয়েদের লড়াই করার জমি তৈরী হয়েছে অনেকটাই। আর এখান থেকেই কয়েনের উল্টোপিঠটা আস্তে আস্তে চোখে পড়ছে, যেটা ছেলেদের পক্ষে কোনঠাসা হওয়ার পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে।

সম্প্রতি একটি ওয়েব সিরিজ বেরিয়েছে নেটফ্লিক্সে – Anatomy Of A Scandal. যেখানে এই ‘ধর্ষন’ ব্যপারটা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সিরিজটাতে যদিও এই মূল বিষয়টা থেকে একটু সরে গিয়ে এই বিষয়টাকে ভিত্তি করে তিনটি চরিত্রের (Sienna Miller as Sophie Whitehouse, Michelle Dockery as Kate Woodcroft, Naomi Scott as Olivia Lytton) মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে আবদ্ধ থাকলেও বিষয়টাকে ফেলে দেওয়া যায় না। আমার মনে হয়, আইন কখনও প্রকৃত সত্য খুঁজে বের করতে পারে না। কতকগুলো তথ্যের ভিত্তিতে সত্যের কাছাকাছি পৌছনোর চেষ্টা করে। কখন ধর্ষন আর কখন যৌন সম্ভোগ --- এই সীমারেখাটা কে কীভাবে নির্ণয় করবে? ইচ্ছা আর অনিচ্ছা কারোও মুখের কথায় কেন ঠিক হবে? অর্থাৎ, দুজনের সন্মতিতে যদি শুরুও হয়, মাঝপথে একজন সরে আসতে চাইলে, অনিচ্ছুক সঙ্গী অথবা সঙ্গীনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে যদি ঘটনাটা ঘটে তবে তাহলে সেটা ধর্ষণ বলে পরিগণিত হবে! এবার, সমস্যা হল, কে চেয়েছে আর কে চায়নি সেটাই বা ঠিক হবে কি করে? শরীরে তৈরী হওয়া ক্ষতচিহ্ন দিয়ে? রক্তপাত দিয়ে? কিম্বা মুখের কথায়? এখানে মেয়েদের কথারই গুরুত্ব বেশি। দেশে কিম্বা বিদেশে --- সব জায়গায় এক অবস্থা। এর ফলে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অনেক সময় একটা বিশাল প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

সিরিজটা দেখতে দেখতে আরেকটা সিনেমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, Section 375, সেই সিনেমায় সরাসরি এই হেনস্থাকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে ভিকটিম, দেখা গেছে সে অনেকদিনের সম্পর্ককে ছিন্ন করার প্রতিশোধ নিয়েছে একদিনের প্যাশনেট যৌনতাকে সুপরিকল্পিতভাবে ‘রেপ’-এর কাঠামোয় দাঁড় করিয়ে। ঐ সিনেমাটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, একটা বড় সমস্যার সামনে আইন এবার পড়তে চলেছে। সেটা হল, যৌন সম্পর্ক আর অত্যাচার --- দুটোর পার্থক্যকে আলাদা না করতে পারার ব্যর্থতা। সিনেমায় একটা সময়ে যুযুধান দুই আইনজীবী মুখোমুখি কথা বলতে বলতে একজন (অক্ষয় খান্না) অপরজনকে (রিচা চাড্ডা) বলেন, আমরা দুজনেই আমাদের ক্লায়েন্টের কথা বিশ্বাস করে জাস্টিস পেতে চাইছি। আসল কথাটা হল এই যে, ঐদিন বন্ধঘরে ঠিক কি হয়েছিল, তা তারা দুজন ছাড়া আর কেউ জানে না। ফলে আসল জাস্টিস তুমি নির্ণয় করবে কিভাবে? আর ওয়েব সিরিজটাতেও একটা সময় আসামী পক্ষের আইনিজীবী (Josette Simon) চীৎকার বলে ওঠেন, সেক্স হয়েছে কি না বড় কথা নয়, আমাদের আগে নির্ণয় করতে হবে, রেপ হয়েছে কি না! না হলে জাস্টিস মিলবে না।

ওয়েব সিরিজ এবং সিনেমা --- দুটোই দেখার মত। একটি আছে নেটফ্লিক্সে, সদ্য রিলিজ করেছে। অপরটি আছে আমাজন প্রাইমে, যা বছর তিনেক আগেই রিলিজ করে গেছে। দেখার প্রধান কারণ গল্পের বিষয়বস্ত। যদিও ওয়েব সিরিজটাতে মানসিক জটিলতা, গল্প বলার ভঙ্গি, এবং অবশ্যই অভিনয় অনেক বেশি সাবলীল এবং গ্রহণযোগ্য। হিন্দী সিনেমাটা বরং দুর্বল অভিনয় আর ইমোশনাল ডায়ালগ ছবির মূলভাবটাকে নষ্ট করে, যদিও আমরা এভাবেই ভারতীয় সিনেমা দেখতে অভ্যস্ত। দুটো বই-ই আমার কাছে বেশি রেটিং পাবে না, কিন্তু, দুটো বই-ই দেখতে বলব, কেবলমাত্র বিষয়বস্তুটা নিয়ে আরোও গভীরে ভাববার জন্যে।

সবশেষে বলি, আমার মত কি। অনেক পুরুষ হয়তো আর্টিকেল ৩৭৫-এর ভুল বিচারের শিকার। কিম্বা এই কঠোর আইনের কারণে অল্প দোষে গুরুদণ্ড ভোগ করে। কিন্তু আজও যে পরিমাণে মেয়েরা অসন্মানের শিকার হয়, সেইদিকে তাকিয়ে বলা যায়, আইন আরও কড়া হওয়া উচিৎ। যে বীভৎস অত্যাচারের শিকার প্রতিদিন প্রতি মূহূর্তে মেয়েরা হয়ে চলেছে তাতে করে পুরুষদের ক্ষেত্রে এ ধরনের অন্যায় শাস্তির পরিমাণ অনেক কম। এইপক্ষে যদি বেশি সহানুভূতিবান/বতী হই, তাহলে অপরপক্ষকে অনেক অনেক বেশি লালসার শিকার হতে হবে। এখন তো পুড়িয়ে মেরে দেওয়ার বা গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ হয়েছে বেশ কয়েকটা জায়গায়। ফলে প্রমাণ লোপাটের তাগিদে নৃশংশতা অনেক অনেক বেড়ে যাচ্ছে। মানহানির পাশাপাশি প্রাণহানিও লাফে লাফে বাড়ছে। দাড়িপাল্লা উভয়দিকে সমান থাকলে নীতির কথা বলা যায়, কিন্তু যেখানে দুর্নীতি বেশি, সেখানে জাস্টিসকে অন্ধ না হলে চলে না।

 


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে