গাঁধী উত্তর ভারতবর্ষ




কিছু কিছু বই মনে বিস্ময় জাগায়। বিস্ময় এই কারণে যে বইটার মধ্যে দিয়ে গেলে নিজের চিন্তাধারা একটা নতুন দিকে বাঁক নেয়। একটা উত্তরণ ঘটায়। বইটা তখন একটা অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। ‘গাঁধী উত্তর ভারতবর্ষ’ বা ‘India After Gandhi’ সেইরকমেরই একটা বই।

প্রথমেই বলে নিই, এই বইটা মহাত্মা গান্ধী’র ওপর নয়। তাই যে সব তামাম বাঙালী বইয়ের নামটা দেখেই তেড়েমেড়ে আসবেন জাতির জনকের ওপর দুকলম লিখে নিজের তথাকথিত বিদ্যা জাহির করার জন্যে তারা দয়া করে এই লেখাটা এড়িয়ে যান।

রামচন্দ্র গুহ একটা করে কলাম প্রতি শনিবার করে টেলিগ্রাফে লেখেন। আমি গোগ্রাসে পড়ি। অসম্ভব ভাল লাগে। তার গান্ধীপ্রীতি সর্বজনবিদিত। গান্ধীজিকে নিয়ে লেখা জীবনীটা আদৌ বাংলায় অনুবাদ হবে কি না জানি না। হওয়ার সম্ভবনাও খুব কম। তবে কৌতুহলীরা ওটাও পড়তে পারেন। নেতাজী প্রীতির সানগ্লাস পরা না থাকলে আলো পাবেন অনেক। নেহেরুর ওপরেও ভালরকম টান আছে তার। একটু কংগ্রেস ঘেষা বোঝাই যায়। সমস্যা হল সেই একদেশদর্শিতা দিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না। যদিও আজ পর্যন্ত আনবায়াসড কোন ইতিহাস লেখা হয়েছে কি না জানা নেই। রামচন্দ্র গুহ যতটা সম্ভব আনবায়াসড হয়েই স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে চেষ্টা করেছেন। সম্পূর্ণ সাফল্য লাভ না করলেও অনেকটাই পেরেছেন। এটা লিখতে গিয়ে অনেকটা সাবধান হয়েছেন। নিজেকে এবং পাঠককেও সাবধান করেছেন। এবং যেটা লক্ষ্য করার মত বিষয় তা হল, কি পরিমান পড়াশোনা করেছেন! এমনকি একটা আমেরিকার খবরের কাগজে লেখা অজ্ঞাত পরিচয়ধারী লেখকের কলামও তার নজর এড়ায়নি।

১৯৪৭ সালের পরবর্তী ইতিহাস আমাদের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা। আমরা মনে করি জানি বটে। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানেন? আমরা যেটা জানি তা ভাষা ভাষা। যেভাবে ইতিহাস বইতে লেখা থাকে সেভাবে নয়। অনেকটাই বায়াসড। বাবা-কাকা-জ্যেঠা-স্যার-বন্ধু-কলিগদের মুখ থেকে পাওয়া স্মৃতিনির্ভর কিছু তথ্য, বা পুরনো খবরের কাগজ, কিম্বা কোন বইয়ের মধ্যে থাকা টুকরো টাকরা কিছু মুহূর্ত। কিন্তু তাকে ক্রোনোলজিকালি সাজানো, বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে দিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করা এবং তার মধ্যে দিয়ে সম্পূর্ণ আবহকে বোঝা, তাকে বিচার করা, সত্যটাকে সামনে এনে অনুভব করার চেষ্টা করা --- এত সহজ কাজ নয়।

রামচন্দ্র গুহ সেটাই করার চেষ্টা করেছেন। এমন অনেক অনেক ঘটনা ঘটেছে যা আমি সত্যিই জানতাম না। যেমন স্বাধীনতা পরবর্তী সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্র গঠন। বিদেশ নীতিতে জোট নিরপেক্ষতা। সংবিধান গঠন করে প্রজাতন্ত্র ব্যবস্থাকে সুসংগঠিত করা। ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া। এরকম আরোও অনেক কিছু। ভারতবর্ষ ইংরেজ আমলের থেকেও অনেক বড় ঝড়ঝাপটা সামলে আজ ২০২২ সালে এসে দাঁড়িয়েছে। সেটা এত সহজ ছিল না। কিন্তু কতটা কঠিন ছিল? সেটা জানাও ভারতবাসী হিসাবে দরকার। আমি যে সময়ে জন্মেছি সেই সময়ের আশেপাশে কি চলছে, কেন চলছে তা জানব না? নিশ্চই জানব। এবং এমন একজনের কাছ থেকে জানতে চাইব যিনি আতশ কাঁচের তলায় এই যুগটাকে ধরে, বাছবিচার করে তবে আমাদেরকে জানাচ্ছেন। রামচন্দ্র গুহ এত সুন্দরভাবে ১৯৪৭ থেকে শুরু করে ২০০৭ পর্যন্ত এসে থেমেছেন যে মনে হল একটা যুগকে চাক্ষুষ করলাম। যে কটা দিন বইটার সঙ্গে ছিলাম, মনে হল ভারতকে নতুন করে দেখলাম, জানলাম। ১৯৪৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত।

বইটার বাংলা অনুবাদ অসম্ভব সুন্দর। মূল ইংরাজীটা নিয়ে কিছু বলার নেই। রামচন্দ্র গুহের ইংরাজী ঝরঝরে। লেখেন গল্প বলার মতো করে। মনে হয় যেন সামনে ঘটছে। নেহেরু থেকে শুরু করে মনমোহন সিং --- অতগুলো প্রধানমন্ত্রীর আমলকে ৮০০ পাতার মধ্যে ধরা সহজ কথা নয়। অসম্ভব ভালো একটা বই, এ অনস্বীকার্য।

এই বইটা পড়া উচিৎ। আমি খুব ভেবেচিন্তেই বলছি। ইতিহাসকে খুব কাছ থেকে দেখা দরকার। বাবা-কাকা টাইপ লোকেদের মুখের ঝাল খেয়ে নয়। একজন প্রকৃত ইতিহাসবিদের কাছ থেকে জানাটাই শ্রেয়। যদিও শুধুমাত্র রামচন্দ্র গুহ’ই শেষ কথা নয়। তাহলে তো রামচন্দ্র গুহের চশমাই নিজের চোখে পরা হল। কথা হল, শুরু তো কোথাও থেকে একটা করতে হবে? সেক্ষেত্রে এই বইটা সবচেয়ে ভাল ‘স্টার্টার’।

=========

India After Gandhi: The History of the World's Largest Democracy

Ramachandra Guha

Picador India

855/-


গাঁধী উত্তর ভারতবর্ষ

অনুবাদঃ আশীষ লাহিড়ী

আনন্দ পাবলিকেশান

৭৫০/-

 


Comments

Popular posts from this blog

যে বুকে আগুন জ্বলে

জেরক্স কপির উন্নত ভার্সানে ‘আবার প্রলয়’ এসেছে

শারদীয়া আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে